টুম্পার সাথে এক ছাদের নিচে থাকার আজ সাত বছর পূর্ণ হলো। যদিও আজকের দিন নিয়ে আড়াই বছর হলো আমি তার সাথে থাকিনা। সে একা থাকে। সাত তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় একটা এপার্টমেন্টে তার নিত্যদিনের কাজ কারবার। একলা হাসে, একলা কাদে - সঙ্গী অবশ্য আছে কিন্তু আমি নেই এযেন তার বিশাল শূন্যতা। কিন্তু এ বিরহের আগে সে এসব নিয়ে কেয়ারই করত না। আমি কি করছি, কোথায় যাই, কি চাই এসবের বালাইয়ে সে নেই। তার পথ চলা অন্যজনকে নিয়ে। সেই একজন কে নিয়েই তার চাওয়া পাওয়া দেনদরবার। মাঝে মাঝে খুব হিংসে হতো আবার ভালোও লাগত। ভাবতাম সবই তো আমার ছায়াতল, আরশিনগর।
বিয়ের দুবছর আগে টুম্পার সাথে পরিচয়। একটা মজার ঘটনা দিয়ে। আমি আর সে আলাদা আলাদা ভাবে শপিং শেষে ক্যাশ কাউন্টারে টাকা দিয়ে যার যার শপিংব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে আসি। এসে দেখি হায়! মেয়েলি কাপড় চোপড় দিয়ে ব্যাগ ভর্তি। কিন্তু আমার ব্যাগে তো একটা প্যান্ট, একটা শার্ট, দুইটা টিশার্ট ছিল কিন্তু এসব দেখে তো আমার মাথায় হাত কপালে ঘাম -।
এসব ক্যামনে হলো। মনে করতে লাগলাম কি হতে কী হয়েছে। একই সেলসম্যানের কাছ থেকে আমি আর একটা মেয়ে ব্যাগদ্বয় নিয়েছিলাম।মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে ব্যাগটা নিয়েছে। গড়বড় নামক এই বিপদ বুঝি সেখানেই হয়েছে! কি করব কি করব করে মাথা চুলকাচ্ছি আবার চরম রাগে আবোল তাবোল বকবক করছি। প্রায় একঘন্টা সময় লস করে এই কাপড় গুলো পছন্দ করেছি এখন যদি সব হারাতে হয়। মনে হলো চতুরতা হবে - নাহ! সমমূল্যের জিনিসই আছে ব্যাগে। জিনিসপত্র দেখে মনে হলো মেয়েটির পছন্দ আছে, বলতেই হয়। মাথা গুড়াতে গুড়াতে সিদ্ধান্ত নিলাম যেখানে গলদঘর্ম হয়েছে সেখানেই যাই.... অন্তত যদি মেয়েটা এসে ফেরত দেয় তবে দুজনেই দুজনেরটা ফেরত পাবো... যেই ভাবা সেই কাজ।
বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলাম। যদিওবা স্বন্ধ্যার কিছুপর তাড়াতাড়ি রিকশা পাওয়াটা ভাগ্য বলা যায়। রিকশায় বসে মেয়েটার চেহারা মনে করতে লাগলাম- ফর্সা, স্কার্ফ দিয়ে সুন্দর করে মাথা ঢাকা, ঠোট গুলো ঈষদ মোটা সাথে খয়েরি কালারের লিপিষ্টিক, খদ্দর কাপড়ের তৈরি ফুলহাতা সালোয়ার কামিজ,হ্যান্ড এমব্রয়ডারি কাজ করা সালোয়ার কামিজের রং সাদা। লম্বা অনুমানিক ৫' ৪" হবে। মনে রাখার কারন শপিং করার সময়কালে আমার সামনে দু-চারবার চক্কর দিয়েছে মেয়েটি। দেখে মনে হয়েছে চঞ্চল আর তাড়াহুড়া টাইপের মেয়ে.........।হলোও তাই। রিকশায় করে যাচ্ছি, অতশত ভাবনায় হারিয়ে গেছি...... বাস্তবে ফিরলাম দুজন রিকশা চালক তাদের কুশল বিনিময় করার প্রাক্কালে।আমি যে রিকশায় বসে আছি সে রিকশা সামনের একটা রিকশাকে অভারটেইক করছে সে সময় তারা উভয় পরিচিত হওয়ায় তাদের এ আলাপন। অপর রিক্সার যাত্রীর দিকেই তাকাথেই আমি তো অবাক - যার খুজে যাওয়া তাকেই পিছনে ফেলে যাচ্ছি। চোখাচোখি। দু রিকশার চলমান যাত্রীদ্বয় একসাথে সম্ভোধন -- "এই যে................... "।
পাশে একটা টি-ক্যাফেতে বসলাম।নাম টুম্পা, আমি সামিয়ান রহমান। পাশাপাশি দু-বিল্ডিংয়ে থাকি আমরা তবে টুম্পার আগমন মাস ছুঁইছুঁই করছে, আমি চার বছরের ঠিক কাছাকাছি। দেখা হয়নি আজই প্রথম -
টুম্পাই বলল ব্যাগটা অদলবদল হয়েছে মনে হয়
- জ্বী, তাই যাচ্ছিলাম
-হুম, আমার মনে হয় তাড়াহুড়োয় ভুলটাই হয়েছে
-ম্যায় বি, আমার ও তাই মনে হয়।
ব্যাগটা অদলবদল হলো,চুক্তিপত্র হস্তান্তরের মতোই। টুম্পাকে যত টা চঞ্চল আর মনে হয়েছিল ততোটুক নয়। পুরোই গম্ভীর। ব্যাগটা নেয়ার সময় অর হাতটা কাঁপছিল, অবাক হই আমি।মনে হলো হয়তো চলনে বলনে ভারসাম্য রাখে মেয়েটি।
-দেখুন তো সব ঠিক আছে কিনা (আমি বললাম)
-কী, আপনি এসব দেখেছেন!
- বারে, না দেখলে বুঝতাম কিভাবে এটা আমার ব্যাগ নয়
- সরি, তাই তো
টুম্পা যেন লজ্জায় লাল হলো, রুপালি আলোয় সোডিয়াম বাতির মিশ্র প্রভায় টুম্পাকে আরো মায়াময় করে তুলছে......
-এবার তাহলে উঠা যাক। টুম্পা বলল
- হে হে চলুন...........
রিকশার জন্য অপেক্ষা..... টুম্পা রিকশায় উঠে বসল আমি অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম অন্য রিক্সা জন্য.....
আমাকে অবাক করে দিয়ে টুম্পা ডাক দিলো, এই যে যাবেন না .. হাত ঈশাড়ায় বসতে বলল।
অপ্রস্তুতের মতো বসলাম তার পাশে...
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে একটু আগের লজ্জাবতী টুম্পা চঞ্চলতায় ফিরল.........
জন্ম নেয়া থেকে আজ পর্যন্ত - সামারি আলোচনা করতে করতে বাসার ঠিক সামনে চলে আসলাম.....
নেমে বললাম আজ ইতি
- হায়! হায়! আমি শুধু বকবক করলাম, আপনি কিছুই বললেন না...
বললাম - আজকের শুরুটা কেন আজই শেষ করতে চাইছো, সুর্য উদয়ের সাথে নতুন দিনের সূচনা....ডাকলেই পাবে.....
-হুম, ডাকলে আসবেন তো, টুম্পা বলল
- বললাম - " একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতটা কাঙাল, কত হুলুস্থুল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার "।
- টুম্পা হাসল, হাত নেড়ে বিদায় জানালাম।
সেই থেকেই যোগাযোগ আর একপথে চলার রসায়ন শুরু।
মেয়েটা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসতো। সব কাজে নাছোড়বান্দা - কি এক মায়াময়তায় জড়িয়ে রাখতো আমাকে সেই ভালো বলতে পারবে। লেখাপড়া শেষ করে যখন আর আগের মতো বের হতে পারতোনা তখন বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো আর নিত্য নতুন প্ল্যাকার্ড নিয়ে আমাকে শুভেচ্ছা জানাতো। একদিন দেখতে না পেলে কি যে কান্না করতো বলাই মুশকিল। একদিন কোথা হতে ভোর রাতে এসেছি, সে আমাকে দেখবে। কি আর করা বাধ্য ছেলের মতো দেখা দিয়ে আসলাম। না গেলে হয়তো মারাই যেতো। বলতো - তোমার ভালোবাসাহীন টুম্পা বদ্ধ উন্মাদ।
সবাই কে নিয়েই টুম্পাকে ঘরে তুললাম। টুম্পা আর আমি আমাদের কাঙখিত সোপানে। বদলে যাওয়া টুম্পাকে আবার দেখলাম। প্রথম রাতে ম্রিয়মাণ, চুপচাপ ছিল সে। একটি কথা ও বলেনি... আমার হাতে একটি কাগজের টুকরোয় লিখে দিয়েছিল "ভুলের পাহাড়ে থাকি যদি, ভুলে যেয়না- চলে যেয়োনা "। হাসলাম আমি
টুম্পার পাগলামো বেড়েই চলল, সে আমায় ছাড়া থাকতে পারেনা, অফিস কামাই করতে বলে - সে চায় আমি থাকি তার চারিপাশ, জড়িয়ে ধরি, চুমুয় এঁকে দেই ঠোটে নলে কপালে। রাতে ঘুমালে ওকে আমার হাত ধরতে হয়, শরীর লাগিয়ে ওর দিকে মুখ করে ঘুমাতে হয়। অফিসে যাবার সময় সে কি কান্না - যদিও স্বন্ধ্যার আগেই আমি বাসায় চলে আসি তবু ও তার কান্নায় মনে হবে আমি যেন দূর বনবাসে যাত্রা করছি। প্রতিদিন এ আয়োজন দেখতে ভালোই লাগতো আমার। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করবে, ছবি শেয়ার করবে, সারাটা দিন আমার জামাকাপড় গায়ে দিয়ে ঘুরেবেড়াবে এতে নাকি আমিহীন আমিই তাকে জড়িয়ে থাকি। এসবে পাগল বলতাম তাকে - বলত, আমি কে আমি নিজেই জানিনা, তুমিহীন এই টুম্পা বদ্ধ উন্মাদ।
শুভ্রতার জন্ম হলো, মায়ের মতোই হয়েছে। চারদিনেই বাবাকে ছাড়া সে কিছুই বুঝেনা। টুম্পার বদলে যাওয়া আরেক রুপ আমাকে দেখতে প্রস্তুত হতে হলো - সেই টুম্পার আমাকে নিয়ে আর কোন ভাবনা নেই, যেন আমি এখন পরগাছা। মেয়েকে নিয়ে তার সকল আয়োজন, উৎসব। অফিসে যাওয়া আসায় আগের সেই দৃশ্যমান টুম্পার অস্তিত্ব যেন বড়ই বেমানান। বহিঃপ্রকাশ ছিল আরো কঠোর। তাকে আর আগের মতো পাওয়া যায়না। মেয়েই যেন সব, আমায় নিয়ে তার কোন উদ্ধেগ, উৎকণ্ঠা, চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য নেই বললেই চলে। মেয়ে আমার এত আদর সোহাগে বাবা ভুলেনি, বাবা আসলেই তার চাই চাই। এসব দেখে টুম্পা মাঝে মাঝে বলত শুভ্রতাকে তুমি কখনোও আমার কাছ থেকে আলাদা করতে যেয়োনা। শুভ্রতা ছাড়া এই টুম্পা বদ্ধ উন্মাদ।
ব্যাগ গুলো গুছিয়ে নিয়েছি, অফিসের কাজে বিদেশ সফর আজ শেষ হবে। একটু পরেই আমি চলে যাবো আমার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষায় প্রহর গুনা, কাদতে থাকা, পাগলামো করতে থাকা আমার টুম্পার কাছে। যে বলত যার আমাকে ছাড়া একটি ক্ষণ ও বেচে থাকা অসম্ভব। সাথে আমার মেয়ে, আমার সব স্বপ্ন, আমার বেহেস্ত....
যে বলে বাবুই, তুমি আমাকে আদর করোনা পচা।
শুভ্রতা ফোন দিয়েছিল জানতে চায় কখন আসছি, মা বলেছে বাবুই আসবে... জানো আব্বু, আম্মুটানা আমার সাথে কথা বলছেনা বলে বাবুই আসলে নাকি কথা বলবে...
দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, টুম্পা নয় আমি চাই শুভ্রতাই দরজা খুলোক -টুম্পাই দরজা খুলেছে।
দরজা খুলে বড় একটা প্ল্যাকার্ড ঠাঙ্গিয়ে রেখেছে - আমার বরাবর
"তুমি কাকে চাও, টুম্পা না শুভ্রতা "
আমি বললাম " টুম্পার শুভ্রতা ছাড়া এই আমি বদ্ধ উন্মাদ" ।