১.
স্বপন পাড়ের ডাক শুনেছি
জেগে তাইতো ভাবি
কেউ কখনো খুঁজে কি পায়
স্বপ্নলোকের চাবি?
রবিঠাকুর বোধকরি আমার কথা ভেবেই লিখেছিলেন এসব। আমিই কি পেয়েছি স্বপ্নলোকের চাবি? জীবনটা বড় অদ্ভুত! অদ্ভুত তার হিসেব নিকেশ। কিছু স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে যায়। তার জন্য দোষ কাকে দিবো? কার উপর অভিযোগের আঙ্গুল তুলবো বলার সুযোগ নেই। কখনো নিজেকে, কখনো পরিবারের কাছের মানুষগুলোকে আবার কখনো সমাজের নিয়মকে দোষ দিয়ে, অভিমানের কষ্ট পুষে রেখে জীবনকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়। কিছু আবেগ, কিছু অনুভূতি কখনোই পুরনো হয় না। কেবল পরিস্থিতিতে তা রং বদলায়, ধরণ পাল্টায়। প্রথম প্রেমও জীবনে তেমনই এক অবদমিত আবেগ। যা বেশিরভাগ মানুষের জীবনে অধরা হয়েই থেকে যায়। আমার জীবনে নয়ন নামটিও তেমনই এক অধরা আবেগ।
জীবনের অনেকগুলো বছর পার করেও নয়নের কথা ভুলতে পারিনি। কিছু স্মৃতি, প্রথম প্রেম কখনোই চাইলেই কি ভুলে থাকা যায়।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ওর সাথে পরিচয় বান্ধবী সুমীর বড়বোনের বিয়েতে। আর সব ছেলেরা যেখানে ফ্লার্ট করছে ও তাদের মধ্যে একেবারেই আলাদা! আমি এখনো ৩২ বছর আগের সেই দিনটিকে পরিস্কারভাবে দেখতে পাই!
তোমরা যাকে ক্রাশ বলো অথবা প্রেম যাই বলো, কিন্তু আমি জানি না আমার কী হয়েছিল! মনে হয়েছিল নয়নই আমার স্বস্তি। যেমন করেই হোক নয়নের কাছে আমাকে পৌঁছুতে হবে।
সুমীর শরণাপন্ন হলাম। ও জানালো নয়ন আনন্দমোহন কলেজের ভূগোল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রশীদ স্যারের ছেলে। জেলা স্কুলে আমাদের ব্যাচে পড়ে। সুমীর মাধ্যমেই নয়নের সাথে প্রথম পরিচয়, বন্ধুত্ব। নয়ন তখন থেকেই খুব ভালো গিটার বাজাতো।
যেহেতু আমাদের পরিবারে গিটার বাজানোর চর্চা ছিল তাই ওর সাথে সময়টা খুব ভালো কাটতো এসব কথা বলে। গিটারের পিক্স, থাম্বস, সুর তোলা গান গাওয়া কতো কথা!
মনে আছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নয়নের পিঠে পিঠ রেখে চোখ বন্ধ করে আমি পুরো বিকেল ওর গিটারের তালে গান শুনেছিলাম। সন্ধ্যার আগে যখন বাসায় ফিরতে নিবো তখনই ঝম ঝম বৃষ্টি! নয়ন আমার হাত ধরে অনেকটা পথ বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিলো।
বাসায় ফিরতে দেরি হওয়াতে আম্মা রতন আর সুমীকে ফোন করেছিল। সুমী বলেছিল আমি রতনদের বাসায় । আর রতন বলেছিলো সুমীদের বাসায় গিয়েছি। তখনই আম্মার সন্দেহ হয়। কারণ দু'জনের দু’রকম কথা! তখনকার সময়ে পুরোনো ডায়ালের ল্যান্ড ফোনই ছিলো ভরসা। তাই রতন বা সুমী কেউ আমাকে জানাতে পারেনি আমার উপর নেমে আসা সমূহ বিপদের কথা!
বাসায় আম্মার কাছ থেকে কোনভাবেই পার পেলাম না! আম্মা সব জেনে গেলেন। মেয়েকে বনবাসে পাঠানোর আয়োজন হিসেবে ঢাকায় বড় আপার বাসায় পাঠানোর আয়োজন সম্পন্ন! ঢাকায় যাওয়ার আগে অনেক কষ্টে আরেক বৃষ্টির দিনে নয়নের সাথে দেখা করে ওর বুকে মুখ রেখে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। এক অজনা শঙ্কায় বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছিলো।। কথা ছিল যোগাযোগ করতে না পারলেও আমরা অপেক্ষা করবো দু'জন দু'জনের জন্য।
ঢাকা যাওয়ার পরপর সাময়িক পাসপোর্টে বড় আপা আর দুলাভাইয়ের সাথে কলকাতা যেতে হলো আমাকে। জীবনটা তখন অদ্ভূত বর্ণহীন আমার। কলকাতার সিনেমা হল, যাদুঘর, বাহারি শপিং কিছুই টানেনি আমাকে।
শুনছিলাম ঢাকায় আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হবে। তখনো ক্লাস নাইন এর রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। তার আগেই সব ঠিক করতে হবে।
কলকাতা থেকে ফেরার পর হঠাৎ করে আম্মার চিঠি পেয়ে আমাকে ময়মনসিংহ পাঠানোর খবরে আনন্দের সীমা রইলো না। আমার নয়নের সাথে এবার আমার দেখা হবে।
কিন্তু এতোবড় দু:সংবাদ শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি। কল্পনাও করতে পারিনি আমার জন্য আসলে কী অপেক্ষা করছিলো।
বাড়ি ফিরলে সুমী আর রতন জানালো রশীদ স্যার অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে ময়মনসিংহের বাইরে বদলী হয়ে গেছেন। বাকী আর কিছু জানে না! আসলে ওরা হয়তো আম্মার অনুরোধ ফেলতে পারেনি। তাই আমাকে জানায়নি।
২.
আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু?
গ্রাম পোস্ট অফিস নাই জানা
তোমার আমি হলেম অচেনা!
গানগুলো কেন আমার কথাই বলে!
অনেক কষ্টে ক্লাস টেন-এ উঠলাম। টেন এর প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় উচ্চতর গণিতে ডাবল জিরো পাওয়ায় জলিল স্যার ক্লাস ক্যাপ্টেনকে দিয়ে বেত আনিয়ে আমার হাতে ভেঙেছেন। আমার অপরাধ ছিলো সব লিখেও কেটে দিয়েছি।
এসএসসির আগে বাসা থেকে পালিয়েছিলাম মাসখানেকের জন্য। ধরে এনে ঘরে আটকে রেখে আমার বিয়ের আয়োজন করেছিল। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছি। নয়ন ছাড়া এ জীবন রেখে বাঁচবো কেমন করে? মরিনি কিন্তু পা ভেঙে বিছানায় পড়েছিলাম। ভাঙা পা নিয়ে ক্রাচে ভর করে পরীক্ষার হলে গিয়েছি পরীক্ষা দিতে। কোনরকমে একটা সেকেন্ড ডিভিশন নিয়ে পাস করে কলঙ্কমুক্ত হওয়ার বৃথা চেষ্টা!
নয়ন! তুমি শুনতে পাচ্ছো বৃষ্টির সেই ঝম ঝম শব্দ?
হাত থেকে ছাতা উড়ে তোমার গিটারটা ভিজে গিয়েছিল! তারপর দু’জনের হাত ধরাধরি করে অনেকটা পথ হেঁটে আসা!?
নয়ন! তুমি শুনতে পাচ্ছো?
আমার বর্ণহীন জীবনটা তোমাকে ভেবেই কেটে যাচ্ছে!
৩.
কোজাগরী রাত! আকাশ ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। বাড়ির ছাদে সেদিন প্রথম আমি নয়নের সাথে সারারাত জেগেছিলাম। আমার জীবনে এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ রাত। ১৯৮৮ সালে আমাদের ছাড়াছাড়ির ৩২ বছর পর দেখা। আমি সামলাতে পারিনি নিজেকে। নয়ন ওর সবটা ভালোবাসা দিয়ে আমার সঙ্গে ছিল সেই রাতে।
রাত তখন একটা বাজে। আমার চোখে ঘুমটা একটু লেগে এসেছে। ঝম ঝম করে নয়নের গিটারটা বেজে উঠলো। আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। গিটারের সাথে ওর মাদকতায় ভরা কণ্ঠে গেয়ে উঠলো। আমি ডুব দিলাম নয়নের গিটারে, কণ্ঠে! একটা সময় আবিস্কার করলাম আমি কাঁদছি। দু'চোখে বাঁধভাঙা অশ্রু। আমি লুকোনোর চেষ্টা করিনি। নয়ন খুব বিচক্ষণ মানুষ বরাবর। আমাকে থামায়নি, সান্তনা দেয়নি। আমরা দু'জনেই জানি চোখের এই জলের মানে। আমরা দু'জনেই জানি এই অশ্রু নদীর দুইপারে আমাদের বসবাস।
অনেকটা সময় ওকে ঘেষে বসেছিলাম থম মেরে। ভেবেছি সেই রাতে ও হয়তো আর গাইবে না।
ওর গিটার সেই মাঝরাতে আবার সুর তুললো। আইয়ুব বাচ্চুর "ভাঙা মন নিয়ে তুমি আর কেঁদো না। সব চাওয়া পৃথিবীতে পাওয়া হয় না।"। সেই রাতে নয়ন ওর সুর আমাকে উত্সর্গ করলো।
৩.
সিঙ্গেল মাদারের যন্ত্রণা, একাকীত্ব, দায়িত্ব পালন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আমার শত্রুতেও বলবে না আমার দিক থেকে কোন সমস্যা ছিলো। কিন্তু সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ পতি আমার বড় বেশি অশান্তি করে ছেড়েই গেল!
একা জীবনের যাত্রা বড় কষ্টকর। তাই চাই না কোন আপনজন, প্রিয়জন আমার মতো সিঙ্গেল মাদারের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াক।
আশালতা চৌধুরী, ওর কথা তোমাদের বলেছি আগে । উত্তম পুরুষে লিখতে হয়েছে ওর কথাগুলো। ওর নয়নের কথাগুলো। তাই সবাই ভেবেছে সে আমিই।
নয়নের সাথে আশার প্রথম দেখা ১৯৮৮ সালে। এক বান্ধবীর বড়বোনের বিয়েতে। আশা সেই যে ডুবেছিলো নয়নে এতোবছরেও নয়নের প্রতি ওর মুগ্ধতা কমেনি।
মাঝে প্রায় ৩২ বছর ওদের যোগাযোগ হয়নি! কিন্তু তারপর ঠিকই ওদের দেখা হয়েছে।
নিয়তির এ ছিলো চরম পরিহাস।
নয়ন কানাডা থেকে এসেছিলো আশার সাথে দেখা করতে। ওরা দু'জন কোন কিছু না ভেবে সদরঘাটে গিয়ে লঞ্চে উঠে বসেছিলো। কারণ আর কিছু নয়। নয়নকে চাঁদপুরের ইলিশ খাওয়াবে সামনে বসে। ইলিশের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহের কথা আশা সেই ছোটবেলা থেকেই জানতো। কখনো সাধ মিটিয়ে খাওয়ানোর সুযোগ পায়নি জীবনে। তাই এবার আর হাতছাড়া করেনি সুযোগটা।
ডাবল বেডের কেবিন নিলেও ওরা সারাক্ষণ ঘেষে বসেছিলো এক বেডেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ বড় অশোভনীয়। অবাঞ্চিত কথা মনে আসতেই পারে। কিন্তু ওদের কেবিনের দরজা খোলা ছিলো পুরোটা সময়। পুরোটা সময় জুড়ে নয়নের গিটারের, কণ্ঠের সুরে আশা মোহাচ্ছন্ন হয়েছিল। কতোটা কেঁদেছে, কেনইবা কেঁদেছে তার হিসেব কে রাখে।
চাঁদপুরে সরষে ইলিশ খাওয়ার সময় নয়নের গলায় কাঁটা আটকে গিয়েছিলো। আশা খুব ঠান্ডা মাথায় ভাতের বল বানিয়ে ওর গলায় ঠেলে দিয়েছিলো কাঁটা সরাতে। বল বানানো ভাত গিলতে গিলতে নয়ন অদ্ভুত মুগ্ধতায় আশার দিকে তাকিয়ে ছিলো। যেনো এই প্রথম আশার সৌন্দর্য দেখছে।
সবটাই আশার কাছ থেকে শুনেছি। সেদিন ও সম্ভবত কয়েকশ ছবি তুলেছিলো নয়নের সাথে।
আশা আসলে নয়নের ব্যক্তিত্ব, নাকি গান না ওর গিটারের ঝংকারের প্রেমে পড়েছিলো তা আমাদের কাছে একটা বড় প্রশ্ন। কখনো কৌতুহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেসও করেছিলাম ওকে। ও কেবল গভীর চোখে তাকিয়ে হেসেছিলো। কিন্তু কোন জবাব দেয়নি। মূলত ওর প্রেমকাহিনি লিখতে বা বলতে গেলে গান আর কবিতার মাঝেই ডুব দিতে হয়।
কয়েকদিন পর আশার খুব বড় একটা অপারেশন হবে। কিডনিতে নাকি লাইপোমার সমস্যা হয়েছে। কিন্তু নয়নের কাছে কোনভাবেই মুখ খুলছে না। কেবল আমার কাছে নয়নের জন্য ছোট্ট একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে।
নয়ন,
ঠিক কতোবার তোমার নাম ধরে ডাকলে আমার মন তৃপ্ত হবে জানি না।
ঠিক কতোটা ঘৃণা তুমি আমায় করলে ভুলতে পারবে তাও জানি না। কিন্তু কেমন করে বলি তোমায় " বড় বেশি ভালোবাসি"। আমি কোনভাবেই তোমার থেকে বেরুতে পারছি না। তুমি কোনদিন জানতে পারবে না আমার কতোটা জুড়ে আছো তুমি। আমি কেবল তোমার সরব অস্তিত্বের জানান পেতে চাই। খুব করে ঘৃণা করো। আপত্তি নেই। সত্যি বলতে তাই চাই। কিন্তু তারপরেও জানাতে চাই না, আমার সবটা জুড়ে কেবল তোমার গিটারের ঝংকার।
একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
মনে পড়ে যাবে সব কথা
কথা দিয়ে কথাটা না রাখা
ফেলে আসা চেনা চেনা ব্যথা-
তুমি ভাবো তুমি হেরে গেছো। আর আমি ভাবি আমি হেরেছি।
হয় তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয় তো গিয়েছি হেরে,
থাক না ধ্রুপদী অস্পটতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে ।
-হেলাল হাফিজ
কোনদিন বলবো না, “দু:খিত”।
শুধু বলি ভালো থেকো।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
কিছু না পাওয়ার সঠিক কারণ জানা যায় না। অধরা থেকে যায় ইচ্ছে, স্বপ্ন, প্রেম। অবদমিত অভিমানেরা দীর্ঘশ্বাসের হাহাকার তোলে। জীবন এভাবেই কেটে যায় না পাওয়ায়।
২৮ মার্চ - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
২২ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৩৩
বিচারক স্কোরঃ ২.৩৩ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪