বিপ্রতীপ

ত্যাগ (মার্চ ২০১৬)

আরজু আহমাদ
  • ১২১

আদিবের ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। আরো কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কতক্ষণ পর পর মা এসে ফজরের নামাজের জন্য তাগাদা দেন। অনেকটা অনিচ্ছা নিয়েই বিছানা ছাড়ে সে। ওজু করে মসজিদের দিকে পা বাড়ায়। নামাজ শেষে মনটা কেমন যেন নতুন উদ্যোম পায়। একটু বাড়তি চঞ্চলতা আসে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে বায়ের রাস্তাটা ধরে সোজা চলে যায় আমলাপাড়ার দিকে। গিয়ে দাঁড়ায় দু তলা একটা বাড়ির সামনে। বাড়িটাতে এখন পৌঢ়ত্ব ভর করেছে বটে কিন্তু এককালে বাড়িটার পৌরুষ ছিল তা দেখেই বোঝা যায়। বাড়িটা দক্ষিণমুখো, মস্ত বড়ো সদর দরজা। উঠোনের ডানপাশে তুলসী গাছ, গাছের পেছনেই ছোট্ট ঠাকুর ঘর। দেয়াল দিয়ে পুরো বাড়ি ঘেরা। গেট থেকে সদর দরজা প্রায় চল্লিশ হাত মতন দূরে। দুবেলা বাড়ির বউরা ঠাকুর ঘরে আর তুলসি তলায় পুজো দেয়, শঙ্খ বাজায়। এ বাড়িরই ছেলে অনুপকান্ত। আদিবের কলজের টুকরো বন্ধু। একসময় অনুপকান্তর পরিবারের জমিদারি ছিল। ওর কাকারা দেশভাগের সময় চলে গিয়েছিল ভারত। কিন্তু অনুপকান্তর বাবা দেশেই থেকে যায়। ভাইয়েরা সাথে যাবার জন্য জোর করলে বলেছিলেন, দেশ ছেড়ে যাব কোথায়? এখানে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি। এখানকার মাটির কাছে, বায়ুর কাছে আমি চিরঋণী। মায়ের কোলই সন্তানের উপযুক্ত আশ্রয়। এই দেশমাতাকে আমি ত্যাগ করতে পারব না। মাতৃপরিচয়হীন সন্তান হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অনাথ। প্রাচুর্য তাকে সুখ দিতে পারে না। তোমরা যাবেই যখন যাও। আমায় জোর করো না। সেসব সাতচল্লিশ সালের কথা। অনুপকান্ত পৃথিবীতে যে বছর জন্ম নেয় তখন ছিল চুয়ান্ন সাল। দেশভাগেরও অর্ধ যুগ পর। অনুপকান্তের বয়স এখন সতেরো। আদিবেরও একই বয়স। অনুপকান্ত ও আদিব দুজনেই লম্বা চওড়া। দুজনেরই দাড়ি গোফ গজাতে শুরু করেছে। ফর্সা মুখে পাতলা পাতলা দাড়ি ওদের মুখটা যেন আরো সুন্দর করে তুলেছে। ওদের দুজনের মধ্যে এতো দিক থেকে মিল যে অচেনা যে কেউ ওদের জমজ ভাই ভেবে বসবে। আদিবের আর ভাই বোন নেই। মা গৃহিণী, বাবা রুহুল আমিন মুসলিম লীগের নেতা। পাকিস্তান হবার পর পরই তিনি একবার মুসলিম লীগের হয়ে নির্বাচন করে জিতেছিলেন। এরপরে আর কখনোই নির্বাচনে না জিতলেও এলাকার মানুষ তাকে সমীহ করত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার জোর ভূমিকা ছিল। 'আজাদ করো পাকিস্তান' স্লোগানে তিনি রাজপথ কাপিয়ে তুলতেন। স্লোগানে যে তপ্ততা ঝরে পড়ত, মনে হত চীনের মহাপ্রাচীরও বুঝি এ উত্তাপে গলে যাবে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলোনের সময় অজস্রবার কারানির্যাতন ভোগ করেছেন কিন্তু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি। অথচ পাকিস্তান হবার পর তার আদর্শ বদলে গেল। শোষণের নেশায় মেতে উঠলেন। পার্লামেন্টে ঢুকে বঞ্চিত আর শোষিত মানুষগুলোর কথা ভুলে গেলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তার আচরণ দেখে মনে হলো, ব্রিটিশদের হাত থেকে শোষণের অস্ত্র নিজেদের হাতে আনবার জন্যই বুঝি এ স্বাধীনতা তাদের দরকার ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জঘন্যতম শোষকগোষ্ঠীর লেবাস ধারণ করলেও আদিবের বাবা আর তার মত কিছু লোক শুধুমাত্র ক্ষমতার মোহে এই শোষণ ও বঞ্চনার বিরোধিতায় টুঁ শব্দটি করে নি। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েও বাংলাদেশ হয়ে উঠে নতুন পাকিস্তানি উপনিবেশিক ভূখণ্ডে। এ যেন সেই পতিতার ভাগ্য যে এক খদ্দেরের হাত থেকে অন্য খদ্দেরের হাতে সমর্পিত হয়েছে। অনুপকান্তের বছর তিনেকের ছোট এক বোন আছে। নাম দীপ্তি। ছিমছাম দেহ। চোখ দুটো টানা টানা। ভ্রুযুগল যেন বহ্মপুত্রের শাখা নদীর মতই বাকা। হাসলে গালে টোল পড়ে। দীপ্তির হাসির অপার সৌন্দর্য এ বাড়ির প্রত্যেকটা ইট কাঠ আর আসবাব সব কিছুকেই যেন দীপ্তিময় করে তুলেছে। মুখাবয়ব খুব সাদা নয়, দুধের মাঝে লাল রঙ মেশালে যেমন হয় সেরকম। অর্থাৎ দুধেআলতা। কোমর পর্যন্ত চুলের বিস্তার। অনুপকান্তের আরো এক ভাই ছিল। মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা পিছলে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যান। অনুপকান্তের বাবা নির্মলকান্তের জুয়েলারির ব্যবসা আছে। কান্ত জুয়েলারি নামে দোকানটা আমলাপাড়ার পাশেই দুর্গাবাড়ি রোডে। আদিব অনুপকান্তের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশ খানিকক্ষণ হলো। গেট ভেতর থেকে তালাবন্ধ। আজ বোধহয় অনুপ এখনো জাগে নি জাগলে গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকত নয়ত আদিবের জন্য মসজিদের সামনেই চলে যেত। অনুপকান্তকে সবাই অনুপ বলেই ডাকে। অনুপ খুব বেশি দিন যে সকাল সকাল জাগে এমন নয়। বেশিরভাগ দিনই যে জাগিয়ে দেয় সে দীপ্তি। শ্রীমতী দীপ্তিকান্ত। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। এটা আদিবের দেখা রোজকার রুটিন। আসলে ছাদে যে ও আদিবের এ বাড়িতে আসা দেখতেই দাঁড়িয়ে থাকে সেটা আদিব প্রথম প্রথম ধরতে পারে নি। একদিন আদিব অনুপদের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে দীপ্তির খুব জ্বর। আদিব আর অনুপ একসাথেই দীপ্তির ঘরে দীপ্তিকে দেখতে যায়। তখন অনুপ ওর মার ডাকে কী এক প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরুলে দীপ্তি আদিবকে বলেছিল, আপনি কাল আসেন নি কেন? সেই  ভোর থেকে আপনার জন্য এই হাড় হিম করা শীতে দাঁড়িয়ে থেকেই তো জ্বরটা বেধেছে। ' বলেই অভিমানের ভঙ্গিতে শরীরটা অন্যপাশে ফিরিয়ে নেয়। আদিব বেশ লজ্জা পায়। গতকাল খুব শীত পড়েছিল আর সেই শীতের জন্যই ও বের হয় নি। অথচ দীপ্তি ওর জন্য ছাদে অপেক্ষা করে জ্বর বাধিয়ে বসে আছে। কিন্তু কেন সে আদিবকে দেখতে এতোটা উদগ্রীব ছিল? প্রশ্নটা আদিব করতে যাবে তখনই অনুপ ফিরে এল। জানা হলো না আর।
গেটের সামনে অনেকটা সময় ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আদিবের বিরক্তি ধরে গেছে। তাছাড়া বেশ চিন্তাও হচ্ছে। দেশে মিলিটারি নেমেছে। ময়মনসিংহ শহরতলির খাগডহরের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ক্যাম্পে বাঙালি সৈনিকরা সেই পঁচিশ মার্চ রাতেই প্রতিরোধ গড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। পরদিন সকালে ওর বাবার মুখে গালাগালির আওয়াজ শুনে আদিবের ঘুম ভাঙে। 'শালা হিন্দুস্তানের চর। পাকিস্তানের খায়পরে আর হিন্দুস্তানের দালালি করে। আরে এরা কি জানে। পাকিস্তান আজাদ করতে কতোটা সংগ্রাম করতে হয়েছে। একটা স্বাধীন মুসলিম আবাসের জন্য কত আল্লাহর বান্দা শহীদ হয়েছে। আর তারা কিনা দেশটা ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কাউকে ছাড়া হবে না। একবিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না।' আদিব বুঝেছিল গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। আর তা যে ঘটিয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনতা, সেটাও বুঝতে বাকি নেই ওর। সারাদেশব্যপী তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে পাক আর্মি। ঢাকায় পাখির মত গুলি করে মানুষ মেরেছে। সারাদেশে মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে সে কথা। রেডিওতে বলা হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ধরতে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু মানুষ সত্যিটা কী তা জানে। ভয়ে মানুষ দলে দলে শহর থেকে গ্রামে পালাচ্ছে। হিন্দু মুসলমান কারোর ছাড় নেই। তবুও হিন্দুরা ভয় পাচ্ছে একটু বেশিই। আচমকা অজানা আশংকায় আদিবের বুক কেঁপে উঠলো। তাহলে কি অনুপদের বাসায় মিলিটারি ঢুকেছিল। যদি তাই হয়, তবে গেট ভেতর থেকে তালা লাগানো থাকবে কেন? নিশ্চয়ই ভেতরে লোক আছে। গেটের উত্তরদিকের দেয়ালটা খানিক নিচু। আদিব সেই দিকটা দিয়ে দেয়াল টপকে ভিতরে পৌঁছল। সেখান থেকে শূণ্য ঠাকুর ঘরটা দেখা যাচ্ছে। ঠাকুর ঘর থেকে প্রতিমা মিলিটারি নামার সাথে সাথেই সরিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে সেটা আদিব আগে থেকেই জানত। তবুও প্রতিমাহীন ঠাকুর ঘরটার দিকে সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। সম্বিৎ ফিরে পেতেই বাড়ির সদর দরজার দিকে এগুল। কিন্তু সদর দরজাতেও তালা লাগানো দেখে আদিব বিস্মিত হলো। তাহলে কি বাড়ির সবাই অন্যকোথাও চলে গেছে? একবারের জন্যও আদিবকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না? বলে যেতে পারলো না? অনুপ বা দীপ্তি কেউই না? দীপ্তির কথা মনে পড়তেই অজানা অভিমানে পুরো বুকটা ভারী হয়ে উঠল আদিবের। এ সময় বাড়ির পুরোনো বিশ্বস্ত বৃদ্ধ চাকর বশির আসলো। 
-আদিব বাবাজী, সাহেবরা তো সবাই চইলা গেছে।
-কোথায় গিয়েছে? জানেন কিছু?
-ঠিক কোনহানে উঠব তা তো জানি না। ভারত গেছে এতটুকুন নিশ্চিত জানি। ভাইদের কাছে কলকাতায় উঠব না সেইটা বইলা গেছে।
আদিব জানে অনুপের বাবা কেন তার ভাইদের কাছে গিয়ে উঠবে না। দেশভাগের সময় তিনি ভাইদের সাথে ভারত না গিয়ে যে দেশে গর্ব করে থেকে গিয়েছিলেন সে দেশ থেকে আজ উনি পালিয়ে গিয়ে তার ভাইদের কাছেই উঠবেন! এটা কখনোই উনি অন্তত করবেন না। আদিবের চোখটা ছল ছল করে উঠছে। আদিব আর অনুপ একসাথে কত স্বপ্নের জাল বুনেছে। যে দিন স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো, সেদিন সারাদিন ওরা ব্রহ্মপুত্রের বুকে নৌকায় বসে গল্প করেছে, দেশটা এবার স্বাধীন হবেই। ওরাও যুদ্ধ করবে। মুক্তিযুদ্ধ। একসাথে লড়াই করবে। ওরা দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে, একসাথে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রু মুক্ত করবে। নইলে দুজন একসাথে মরবে। অনুপ বলেছিল, 'চিতায় পুড়ালে তো ছাই হয়ে যাব। মরার পরে তো আর দুজন একসাথে থাকতে পারব না। তার চেয়ে মরার পর যেন অনুপকে চিতায় না পুড়ানো হয়। দুজনে ওরা এক কবরে থাকবে। ' আদিব বলেছিল, 'তাহলে তোর অধর্ম হবে না?'
'অধর্ম হবে কেন? ভগবান কি মরা মানুষের পোড়া মাংসের ভোগ নেন না পোড়া মাংসের গন্ধ গায়ে মাখেন যে না পুড়ালে উনি ক্ষুব্ধ হবেন? ' অনুপ কঠোর কণ্ঠে জবাব দিয়েছিল। আদিব আর কোনো যুক্তি খুঁজে পায় নি। 
আজকে অনুপ সব ভুলে চলে গেল? আর দীপ্তি? সেও কি আদিবকে ভুলে গেল?
-বাবাজী কী চিন্তা করতাছেন? 
বশিরের কথায় সচকিত হয়ে উঠে আদিব।
- না বশির চাচা। কিছু ভাবি না।
- ও আইচ্ছা। এই যে দুইটা চিঠি। একটা অনুপ দাদাবাবু আর একটা দীপ্তি দিদিমণি দিছে। চিঠি দেওনের লাইগাই আমি থাইকা গেছি। নইলে রাইতেই চইলা যাইতাম গ্রামে। কেন থাকমু কন? দেশটাই তো নাই হইয়া যাইতাছে। গতকাল সাহেবরা যাওনের ঘণ্টাদুই পরেই মিলিটারি আইছিল। আমি পেছন দিয়া পালাইয়া বাঁচছি। কাউরে না পাইয়া উর্দুতে গালাগালি কইরা ফিইরা গেছে। সাহেবরা চইলা গিয়া ভালাই করছে। নইলে যে কী হইত আল্লাহ মালুম! 
আদিব আর কথা বলতে পারছে না। চিঠি দুটো হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। বশির গেট খুলে দিল। গেট থেকে বেরিয়ে বাড়িটা আরেকবার চেয়ে দেখল। কান্না টলমল চোখে বাড়িটা আবছা দেখাচ্ছিল। মাথাটা নিচু করে বাড়ি ফিরে গেল আদিব।

আদিব চিঠি দুটো বারবার উলটপালট করে দেখল। দুটো চিঠিই খাকি রঙের খামে ভরা। একটা খাম ছিঁড়ল। চিঠিটা দীপ্তির।
আদিব, 
চিঠি লিখবার সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, চিঠি যার উদ্দেশ্যে লেখা হয় তাকে শ্রদ্ধেয়, স্নেহের অথবা প্রিয় লিখে সম্বোধন করা হয়। আমি সোজা তোমার নাম ধরে লিখছি। তোমাকে আপনি বলে ডাকতাম। আজ তুমি বলে লিখছি। রাগ করো না। ভীষণ ইচ্ছে হত তোমায় আমি তুমি বলে ডাকি। কিন্তু সামনাসামনি কখনো ডাকতে পারি নি। বড়দের আপনি বলে ডাকতে হয়, পারিবারিক এই রেওয়াজ ভাঙবার সাহস আমি দেখাই নি। যা হোক, আজ তো ডাকতে পারছি। আসলে তোমার নাম ধরে সম্বোধন এ জন্য করেছি যে, কাউকে নাম ধরে ডাকায় কেমন যেন প্রবল অধিকারবোধ অনুভূত হয়। সেরকমটা অন্য সবারওই হয় কি না সত্যি তা আমি জানি না। কারোর হোক বা না হোক, এখন আমার অন্তত এমন মনে হচ্ছে যে, আমার সুতীব্র অধিকার রয়েছে তোমার প্রতি। এই যে, বাবা আমাদের নিয়ে সীমান্তের ওপারে পাড়ি দিচ্ছেন, আমার মনে হচ্ছে তিনি সীমাহীন অনধিকারচর্চা করছেন। তার কি অধিকার আছে বলো, আমায় জোর করে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাবার। উনি কিন্তু ঠিকই আমাকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যেতে পারেন নি। যে বস্তুর জন্য মানুষ জানোয়ার না হয়ে মানুষ, সেই মনটা কিন্তু আমার এপারেই পড়ে রয়েছে। সুতরাং বাবা মানুষ দীপ্তিকে নয়, বরং দুপেয়ে সফেদ প্রাণী দীপ্তিকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। যে মানুষ দীপ্তি এপারে রইল তাকে মিলিটারি কোথায় খুঁজে পাবে বলো? ওটা তো তোমার বুকের বাঁ পাশটায় জায়গা করে নিবে। মিলিটারি নিশ্চয়ই ওকে খুঁজে পাবে না। কারণ মন খুঁজে পেতে মনের দরকার হয়। মনহীন হিংস্র জানোয়ার তা খুঁজে পেতে পারে না। মিলিটারিরা তো মনহীন। পাকিস্তানি শাসকেরা আর তাদের সেবকরা প্রত্যেকেই আর যাই হোক মানুষ নয়। 
এই দেখ, কত ভারি ভারি কথা বলে ফেলছি। তোমার কাছে মনটাও জমা দিয়ে দিলাম। আসলে মন তো বহু আগেই দিয়েছি। কিন্তু বলতে পারি নি। ভয় ছিল। আজ হুট করে এত সাহস কী করে সঞ্চার হলো বলো তো? শুনেছিলাম বিজয়ের আগে সত্যিকারের বীরেরা সাহসী হয়ে উঠে, পুরো জাতিই আজ সাহসী হয়ে উঠছে। তাহলে এই জাতি কি বিজয়ের পথে হাঁটছে? সম্ভবত তাই।
আদিব, বাবা ডাকছে। এখনোই বেরুতে হবে। তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। রোজ যাকে দেখবার জন্য, শীত, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতাম তাকে আবার দেখতে পাব কি না তার পুরো অনিশ্চয়তা নিয়ে আজ দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। ভালো থেকো।
আর হ্যাঁ, তোমার কালো রঙের শার্টটার বুকের দিকের একটা বোতাম ছিঁড়ে আছে। মাকে দিয়ে লাগিয়ে নিও। কালো রঙের শার্টে তোমায় খুব সুন্দর লাগে। আচ্ছা, আমায় তোমার ঘরে আনবে? তোমার ছুটে যাওয়া বোতাম ঠিক করে দিতে? ঐ যে, হাতের কাছের বোতাম তুমি লাগাতে জানো না, সেটা লাগিয়ে দিতে? আর তোমার বুক পকেটে আমার হাতে সুগন্ধি রুমাল রাখতে? আর সহধর্মিণী করতে? স্বাধীন দেশের মাটিতে? 
ইতি
দীপ্তি। 
দীপ্তির চিঠিটায় অনেক জায়গা ভিজে কালি লেপ্টে লেখা এলোমেলো হয়ে গেছে। লেখার সময় কান্না আর কলমের কালি দুইই একসাথে ঝরেছে বলেই এরকমটা হয়েছে।
পরের চিঠিটা অনুপের। অনুপ লিখেছে-
প্রিয় আদিব,
কিছুক্ষণ আগে বাবা আমাদের প্রত্যেককে তৈরি হয়ে নিতে বললেন। আমরা এখনোই ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব। খবরটা যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্যই বাবা মাকে অবধি আগে থেকে জানান নি। এই বাড়ি, এই দেশ, এই এলাকা ছেড়ে যেতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমরা চলে যাচ্ছি শুনবার পর আমি তোর কাছে যেতে চেয়েছিলাম। বাবা আটকে দিয়ে বলেছেন, মানুষ জেনে যেতে পারে। তাতে নাকি আমাদের পরিবারের প্রাণ সংহার হতে পারে। তাই তোর কাছে যেতে পারি নি। রাগ করিস না বন্ধু আমার। তুই স্বভাবসুলভ ভাবেই খুব অভিমানী। আসলে ভালোবাসা যত প্রবল হয়, অভিমান তত বেশি হয়। এটা আমি জানি। আর সে জন্যেই তুই অত অভিমান করিস আমার উপর। আচ্ছা সীমান্তের ওপারে আমার সাথে কে অভিমান করবে? রোজ সকালে একসাথে হাঁটতে বেরুনো, অন্ধকার রাতে গলাগলি ধরে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে হেঁটে বেড়ানো, ব্রহ্মপুত্রের চরে বালুর মধ্যে মুখোমুখি বসে জ্যোৎস্না স্নান আর কি করা হবে না? মনে আছে একদিন আমলকী পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে আমার পা ভেঙে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবু আমায় যখন হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে রেখেছিল, তখন তুই রোজ রাতে কাউকে না জানিয়ে আমার বেডের সোজাসুজি যে বারান্দা সেখানটায় এসে থাকতি? কী দুর্নিবার বন্ধুত্বের বন্ধনে আমরা আবদ্ধ ছিলাম! আচ্ছা, আদিব আমাদের আবার কি দেখা হবে?
আমি তোকে জড়িয়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি দেশের জন্য যুদ্ধে যাব। তুইও করেছিলি। আমি ভুলে যাই নি সে কথা। দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে তুই আমায় ভুল বুঝিস না। ভারতে বাংলাদেশি ছেলেদের ট্রেইনিং দেওয়া হচ্ছে। তারপর অস্ত্র দিয়ে দেশে পাঠানো হচ্ছে। একবার সীমান্ত পেরুতে পারলে আমি সেখানে নাম লিখাব। আর একটা কথা বলবার ছিল। আজ দীপ্তি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সদ্য বিধবার মত নিস্পন্দ চলন। আমি জানি দীপ্তি তোকে প্রবল ভালোবাসে। আমি সেটাকে কখনোই প্রশ্রয় দিই নি। আবার দমিয়েও দিই নি। দেশটা যদি স্বাধীন হয় তবে দীপ্তির আর তোর... না থাক। সে তখন দেখা যাবে। তুই নিজের প্রতি খেয়াল রাখিস। মন খারাপ করিস না। একদিন দেখিস এ দেশ স্বাধীন হবে। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার তুই, আমি, দীপ্তি সবার মুখে হাসি ফুটবে। 
ইতি
তোর অনুপ।
চিঠি দুটো বারবার পড়ছিল আদিব। ভাবছিল, অনুপ তো ওর প্রতিশ্রুতি রাখতে যুদ্ধে যোগ দিবে। ও কি করবে এখন। যে করেই হোক দেশটা যে স্বাধীন করতে হবে। নইলে অনুপরা ফিরতে পারবে না। দীপ্তির আর ও ফিরে পাবে না কোনোদিন।
ঘণ্টা তিনেক ধরে আদিব অনুপের আর দীপ্তির চিঠি পড়ছে। তবুও পড়েই যাচ্ছে। প্রত্যেকবার কাঁদছে। যেন আরো কাঁদা আবশ্যক তাই আবার পড়ছে। বাড়ির বৈঠক ঘরে ওর বাবা কিসের মিটিং করছিলেন। সেখানে হঠাত অনুপের বাবার নাম শুনতেই ও সচকিত হয়ে উঠল। 
- শালা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে পুরো পরিবার নিয়ে। খাসা একটা মেয়ে ছিল শালার। ক্যাপ্টেন সাহেবরে দিতে পারলে বহুত খুশি হতেন। নাকি বলেন হুজুর? 
আদিব অবাক হচ্ছে? ওর বাবার চারপাশের মানুষগুলো এতো নোংরা। আর এতো ঘৃণ্য চিন্তা। 
এবার আদিবের বাবা বলছে।
-দেখো মিয়া, ওসব বলে তো লাভ নাই। পালায়া গেছে তো গেছে। গিয়া দেখো ঘরে কোনো মূল্যবান জিনিস আছে কি না? থাকলে নিয়া আসো। ওসব হলো এখন পাকিস্তানের সম্পত্তি। গনিমতের মাল। এর মানে ঐসব এখন থেকে পাকিস্তানের সেবকদের। আমরা পিস কমিটিতে যারা আছি, যারা রাজাকার আর আল- বদর বাহিনীতে যারা আছে তাদের। আর শুনো বাড়িটাতে আগুন লাগায়া ছাই করে দিবা। কিছু যেন না থাকে বদমায়েশদের।
- জ্বি হুজুর। তবে আপনি নিজে সাথে থাকলে ভালো হয়।
-  ভালো যখন হয় তো চলো। 
আদিবের মাথায় রক্ত উঠে পড়ে। এ দেশের এই বিশ্বাসঘাতকগুলো তো পাক আর্মির থেকেও এ দেশের জন্য বড়ো শত্রু। এদের পরাজিত করতে না পারলে দেশ স্বাধীন করা যাবে না। আদিবের চোখ পড়ে ঘরের পশ্চিমের দেয়ালের সাথে ঝুলানো বন্দুকটার ওপর। আর তার পাশের সারিবদ্ধ কার্তুজের ওপর। আদিব সিদ্ধান্ত নেয়, সে অনুপদের বাড়ি লুট করতে দিবে না, এ বাড়ি অনুপের অনুপস্থিতিতে অনুপের আমানত, দীপ্তির স্মৃতি। বন্দুকটা হাতে নিয়েই এক দৌড়ে সে পৌঁছায় অনুপদের বাড়িতে। বাড়ির গেট খোলা, দরজা ভাঙা। রাজাকার সদস্যরা লুটপাটে ব্যাস্ত। দরজার সামনেই পড়ে আছে চাকর বশিরের গুলিবিদ্ধ দেহ। আদিব এবার আর স্থির থাকতে পারে না। সে আনাড়ি হাতে গুলি ছোড়ে। বেশ কয়েকটা লাশ পড়ে যায়। বাকিগুলো পালিয়ে বাঁচে। আদিবের বাবাও কোনোক্রমে পালিয়ে বাঁচেন। পাক আর্মির কাছে খবর পৌঁছে যায় সাথে সাথে। তারা আদিবকে টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যায়। আর মুক্তিযোদ্ধার বাবা-মা হওয়ার অপরাধে খাঁটি পাকিস্তানি দালাল হওয়া সত্ত্বেও আদিবের বাবা আর নিরপরাধ মাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়েজ উল্লাহ রবি সুন্দর বেশ ভাল, শুভেচ্ছা রইল।
রুহুল আমীন রাজু সুন্দর গল্প........ ভালো লাগলো.
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,আমার কবিতা ও গল্প পড়ার আমন্ত্রন রইল।ভোট রেখে গেলাম।

১৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী