বৃষ্টিভেজা ভালোবাসা

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

সুস্ময় পাল
  • ৫৩
  • 0
  • ১৮
আজ যেন আকাশটা ভেঙে পড়েছে –

মুহুর্মূহ মেঘের গর্জন, তীব্র বেগে ছুটে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমাকে বারবার বিচলিত করে তুলছে। খুব জোরে বৃষ্টি হওয়াতে চারপাশে ধোঁয়াময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, মনে হয় এক শীতের ভোরে বাইরে এসেছি। রাস্তা – ঘাটে মানুষজন নেই, কখনো সখনো দু – একটা রিকশা চলে যাচ্ছে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলোকে নিয়ে। দূর থেকে দেখা যায় না, তবে বুঝতে পারি তাদের মনের চাওয়াটা কী।

এই শহরের মানুষগুলো আমার মত বৃষ্টি বিলাসী নয়। বৃষ্টি দেখলেই যেমন আমি বাইরে ছুটে আসি, বাবা – মার শত ধমক সত্ত্বেও আমি ছাদে না এসে পারি না; তেমনি করে এই মানুষগুলো নিজকে বেশি করে গুটিয়ে নেয় ঘরের মধ্যে। তারা বৃষ্টির পরশ গায়ে মাখতে চায় না। তাই এর মাহাত্ম্যও তাদের বোধগম্য নয়। তারা শুধু পারে ঘরে বসে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে, ইলিশ ভাজা - খিচুড়ি খেতে এবাং তথাকথিত বাঙালী সাজতে। এই একই কাজ বারবার তারা করে ... বারবার ... প্রত্যেক বৃষ্টিবারে করে; তবু হাঁপিয়ে উঠে না।


চেনাশোনার কোন বাইরে
যেখানে পথ নাই নাই রে ......
আমি সেখানে অকারণে যাই ছুটে –
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন নেচে উঠে!


বৃষ্টি = বৃষ্‌ + তি।

সেই ক্লাস থ্রি থেকে এই সন্ধি বিচ্ছেদটা নিয়মিত পড়ে আসছি। এটি উচ্চারণ করতে যে কি মজা পেতাম ছোটবেলায়, তার অনুভূতি আমি এখনো ভুলতে পারিনি। যখনই বৃষ্টিতে ভেজা হয় আমার, তখনই সে অদ্ভূত সুন্দর অনুভূতির পরশ আমি পাই। কি যে মজা তাতে, বলে বোঝানো যাবে না!

হ্যাঁ, মজাই পেতাম আমি আগে ...... কিন্তু এখন সেভাবে আর পাই না। এক ফোঁটা বৃষ্টি এখন আমায় ছুঁইয়ে গেলে এক ধরনের কষ্ট অনুভূত হয়। না পাবার কষ্ট ...... না পাবার বেদনা। একখানি স্বর্গীয় মুখ আমার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠে ...... যা চেষ্টা করেও ভুলতে পারিনি।


সেদিনও এমনি করে বৃষ্টি পড়ছিল, যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। যথারীতি আমি ঘরের সকল বাধা উপেক্ষা করে ছাদে এসে ভিজছি। যতবারই মেঘের গুড়ুগুড়ু ধ্বনি শুনতে পাই, ততবারই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠি। চঞ্চল এক জোড়া চোখ চারপাশে ঘুরছিল প্রকৃতির সৌন্দর্য অন্বেষণে, ঠিক তখনই দেখতে পাই তাকে।

কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়ানো চুল, ফরসা একটা গোল মুখ আর মায়াময় দুটি চোখ – প্রথম দেখাতেই মনে হতে থাকে বোধহয় কোন অপ্সরীকে দেখছি! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এত সুন্দরও কি কেউ হতে পারে! কেমন যে ঘোর লেগে যাচ্ছিল ... নিজকে বারবার হারিয়ে ফেলছিলাম।

সে অবিশ্বাসের ঘেরাটোপ থেকে আমাকে মুক্তি দিল মেয়েটির চঞ্চলতা। ১৫ – ১৬ বছরের এক মেয়ে বৃষ্টির জল ধরার জন্য কি আকুল চেষ্টাটাই না করে চলেছে! বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বলে সেভাবে ভিজজে না তার হাতটা, তবুও সে হাল ছাড়ছে না; চেষ্টা করেই যাচ্ছে ...... করেই যাচ্ছে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম কতক্ষণ বলতে পারি না। বোধহয় আধ – একঘন্টার মত হবে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমি সঠিক কাজটা করছি কিনা। এভাবে আরেক ঘরের মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা কোন সভ্যতার পর্যায়ে পড়ে, আমি তা জানি না। আসলে তখন সমাজের চলতি সভ্যতা – ভভ্যতার ধার ধারতে ইচ্ছে করছিল না ...... কেবল সৌন্দর্য অবলোকনে ব্যস্ত ছিলাম। মনে হচ্ছিল এই সম্মোহনী শক্তি আমাকে গ্রাস করেছে, মুক্তির পথ সহজে পাব না ......।

তবে মেয়েটি হঠাৎ করে ঘরে চলে যাওয়ায় আমার ঘোর কেটে যায়। বোধ করি তার মা তাকে বকা দিয়েছে এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। সকলে ত আর আমার বাবা – মার মত নয়!


সেদিন রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর এসেছিল, বেশিক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার শাস্তি এটি। বাবার দৌড়াদৌড়ি, মার আকুল হয়ে সুস্থতা কামনা, বড় ভাইয়ের ঘ্যানঘ্যানানি, সকল কিছু আমি বিছানায় পড়ে থেকে বুঝতে পারছিলাম। পাশাপাশি মনে হতে থাকে সেই মুখখানি, যার রয়েছে দুটি মায়াময় চোখ আর তাতে তীব্র আকুলতা!


আমি জাদুকরের আঙুলে মুগ্ধ হয়ে
অনেক ম্যাজিক দেখেছি,
তাস হয়ে যায় তারাবাতি, ছেঁড়া কাগজ
মুঠোভর্তি কয়েন, টেবিলের
কমলালেবুগুলো লাল পিঁপড়ের মতো সার বেঁধে হেঁটে যায়;

আমি তার চেয়েও বেশি জাদু দেখেছি তোমার চোখে,
দেখেছি কিভাবে বেহেশত নেমে আসে;
কিন্তু আমার কোন সম্মোহনবিদ্যা নেই, আমি
হিপনটিজম জানি না।

তাই ভালোবাসা ছাড়া আর কোন জাদুবিদ্যা দিয়েই
আমি তোমাকে সম্মোহিত করতে চাই না।


দুই – তিনদিনের মাথায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। বাসা থেকে কড়া নিষেধ জারি করা হয় আমার উপর, “আর কক্ষণো বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না।” আমি তাতে থোড়াই কেয়ার করি! বৃষ্টি এলে আমাকে কেউ ঘরে আটকে রাখতে পারবে না, তা ভালো করেই আমি জানি।

সুস্থ হবার পর থেকে আমি সেই মেয়েটির খোঁজ নিতে থাকি। ছোটবেলা থেকেই আমি লাজুক, মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারি না। তাই তদন্তে বিশেষ সুবিধা করা যায় না। মেয়েটার সম্পর্কে শুধু এটুকুই জানি, সে আমাদের সামনের বিল্ডিং এ থাকে।

আমি এ সুযোগটাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে, কলেজের ড্রেস পরতে পরতে, কলেজ থেকে ফিরে ড্রেস ছাড়তে ছাড়তে, বিকেলে প্রাইভেটে যাবার সময়, প্রাইভেট থেকে এসে ক্লান্ত আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে, সন্ধ্যায় নাস্তা খাবার সময় এবং রাতে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে – এক কথায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকি মেয়েটাকে দেখার আশায়। কিন্তু সফল হই না।


রাতের পরে ফিরেছে রাত, রাতের মতো নামে প্রভাত
তোমার খবর রটিয়ে হঠাৎ বনের শাখায় চেরি
বুকের ঘেষটে আবারও যাই ততক্ষণে তুমি ত নাই
তোমায় পেতে আবার হলো এক মুহূর্ত দেরি


এভাবে দুই দিন পার হয়। এরপর এক রাতে তাকে দেখতে পারি। না, এবার বারান্দায় আসেনি। তাদের ঘরের দরজাটা খোলা ছিল, তার মধ্য দিয়ে মেয়েটাকে দেখি। দেখি সে তার চুল সযতনে আঁচড়াচ্ছে। মেয়েদের অনেক কাজের মধ্যে আমি এই কাজটাকে খুব অপছন্দ করি। দীর্ঘক্ষণ একটা চিরুণী নিয়ে তারা এই বিরক্তিকর কাজটা কিভাবে করে, তা আমার মাথায় ঢুকে না। কিন্তু আজ মনে হল চুল আঁচড়ানো ত খারাপ কিছু না! কি চমৎকারভাবেই না মেয়েটা কাজটা করছে। কি যে ভালো লাগছে তাকে!

এরকম আরো বেশ কয়েকবার আমি তাকে দেখি। সে আমাকে দেখে না, শুধুমাত্র আমার তরফ থেকেই তাকে দেখা হয়। বুঝতে পারি, মেয়েটার প্রেমে পড়েছি আমি। মনের মধ্যে ভালোবাসার ঢেউ আছড়ে পড়ে, কিন্তু তা কাউকে বুঝতে দিই না। একপাক্ষিক ভালোবাসা, মিলন না হবার সম্ভাবনা শতকরা নব্বই ভাগ, তবুও আমি ঝুঁকি নিই। কারণ এরকম স্বাধীন ভালোলাগার অনুভূতি আমি ভুলতে পারি না, কিছুতেই না।


একদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখি মেয়েটির ঘরের সামনে একটি ট্রাক, তাতে কিছু আসবাবপত্র তোলা হচ্ছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠে। হায়! এ কি হতে চলেছে? মেয়েটা কি চলে যাচ্ছে? স্থির থাকতে পারি না। অস্থিরচিত্তে ঘরে ব্যাগটা রেখে বাইরে চলে আসি। দেখি বন্ধু আরিফকে। তাকে ধরে এতদিনের লাজ – লজ্জার মাথা খেয়ে বলে বসি, “কারা চলে যাচ্ছে? দোতলার মেয়েদের ফ্যামিলিটা?”

আরিফ মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, কথারা চলে যাচ্ছে।” এরপর একপাশের ভ্রূ নাচিয়ে বলে, “কেন? তাতে তোর সমস্যা কি?”

আরিফের শেষ কথাটা আমার কানে ঢুকে না। তখন শুধুমাত্র একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরছে – “কথারা চলে যাচ্ছে ......... কথারা চলে যাচ্ছে”। তাহলে মেয়েটার নাম কথা ছিল! কেন চলে যাচ্ছে সে? কেন? কেন সে আমাকে এই কষ্টে ফেলে যাচ্ছে? কেন? কেন?


আজ সকাল থেকে আঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সবকিছু তার ছোঁয়া পেয়ে সতেজ হয়ে উঠছে। চারদিকে তাই খুশির আমেজ। সাধারণ মানুষ এই ব্যাপারটি ধরতে পারবে না, কিন্তু আমি পারি। কারণ সবাই প্রকৃতি থেকে দূরে সরে গেলেও আমি তার কাছাকাছিই থাকি।


আজকের দিনটি আমার জন্য বিশেষ একটা দিন। ঠিক এই দিনেই ৫ বছর আগে কথার দেখা পেয়েছিলাম আমি। কাকতলীয়ভাবে আজ বৃষ্টি নেমেছে। পরীক্ষার পড়া ফেলে আমি যথারীতি ছাদে চলে এসেছি। তবে আজকের ভেজাটা কেবলই আনন্দ অনুসন্ধানের জন্য না। আজ আমি ভিজছি শুধুমাত্র কেয়ার জন্য ............ আমার বৃষ্টি ভেজা ভালোবাসার জন্য!


অপেক্ষায় আমি কাল গুনি আজও কেউ তো এল না আর
দরজার পাশে সিক্ত শাড়ির নিশান উড়ছে কার?
যার যা-ই ছিল সবই তুলে দিল কেবল তুমিই বাকি
তোমার দুয়ারে দাঁড়িয়ে ভিখারি কড়াটি নাড়বে নাকি!
খালি হাতে যদি চলে যাই আমি তুমি কি তৃপ্ত হবে
আমার জীবন কেটে গেছে যেন জয় নয় পরাভবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সুস্ময় পাল 'ক্ষুধা' নিয়ে আমার গল্প রেডি করা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে ২০ অগাস্ট এর ঠিক দুই একদিন আগে আমার পিসিটা ট্রাবল দেয়া শুরু করেছিল। তখন একেবারেই চালানো যাচ্ছিল না। এটাকে এখন কোনমতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অনাকাঙ্ক্ষিত এ সমস্যাটা না হলে আমার গল্পটা এখানে থাকতে পারত।:( যাই হোক, আপনার প্রতিও রইল আমার তরফ থেকে ঈদ মোবারক!:)
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
M.A.HALIM বন্ধু, ঈদ মোবারক। এই সংখ্যায় আপনার লিখা নেই তাই মন্তব্য করা গেলো না।
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল 'কথা' এর 'কেয়া' হবার কারণ আর কিছুই না, অমনোযোগিতা! @ সূর্য
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল পড়ার জন্য ধন্যবাদ। @ আমার
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল ধন্যবাদ। @ মিজানুর রানা
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল আমার নামটা ত 'সুস্ময়', 'সুস্স্ময়' না! যাই হোক, ধন্যবাদ। @ মুক্তি সাহা
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল ধন্যবাদ। @ আনিস মানিক
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল আপনার আলোচনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ! @ তৌহিদ উল্লাহ শাকিল
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল ধন্যবাদ। @ এমডি আখতার
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সুস্ময় পাল ধন্যবাদ। @ প্রজাপতি মন
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪