ক্ষমা সুন্দর।

ঋণ (জুলাই ২০১৭)

সালমা সেঁতারা
  • ২০
পাঁচ বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় বোন জেবার পঞ্চাশতম বিয়ে বার্ষিকীর অনুষ্ঠান থেকে ফিরে সর্ব কনিষ্ঠ বোন দিবা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লো।
আসলে বিমল আনন্দেরও বোধ হয় একটা ক্লান্তি আছে, যা সত্যিই খুব সুখকর! সেটুকু পুরোটা উপভোগ করতেই হয়তোবা, দিবা হাতের কৃত্রিম সোনার বালা দুটি আর কানের দুলগুলি খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে বিছানায় এলিয়ে পড়লো।

রাত এগারোটা বেজে বিশমিনিট। দিবার একমাএ- ছেলে যুবরাজের ফোন। আধোবোজা চোখে ফোন রিসিভ করলো-
ঃ কী বাবা?
যুবরাজ বললো-
ঃ মা? তোমার বউমা তো আজ আসেনি। তোমার অসুবিধা হবে নাতো একা থাকতে?
ঃ না বাবা। আমি ঠিক আছি। আমায় নিয়ে চিন্তা করিস না।
ঃ তা কেমন হলো? খালামার Golden anniversary?
ঃ হাঁ, বুঝিসতো বাবা? পয়সাওয়ালা মানুষ! কত আয়োজন! এমন কি এই ম্মৃতিটুকু ম্মৃতিময় করে রাখতে আপা দুলাভাইয়ের যুগল ছবি দিয়ে সিরামিক মগ চিত্রিত করে সকলকে গিফট করেছে।
ঃ যুবরাজ বল্লো বাহ! তো ভালই আনন্দ হলো, কি বলো মা? শুধু আমিই থাকতে পারলাম না। আসলে কি জান মা? এই সব পারিবারিক গেট-টু-গেদারগুলো মিস্ করা মানে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনাবিল ভালবাসার মূহুর্তকে হারিয়ে ফেলা।
ঃ আচ্ছা বাবা, ঘুমিয়ে পড়। কাল আবার তোর ডিউটি আছে। রাত জাগিস না বাবা। কোম্পানীর চাকুরী! বুঝিসতো পান থেকে চুন খসলেই--------। ওরাই হর্তা কর্তা!
ঃ ঠিকা আছে মা, Good Night.

দিবার ঘুম ভেঙেই দেখে দশটা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি করে উঠে কাযা নামাজ পড়ে, রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো। চায়ের পানিটা বসিয়ে দিয়ে এসে রুমে ঢুকতেই ড্রেসিং টেবিলের উপর বালার মধ্যখানে রাখা কানের দুলগুলো চেয়ে দেখলো, একেবারে সোনার মতো চকচক করছে।
আজকাল কেউ আর স্বর্ণ ব্যবহার করে না। সিটি গোল্ডগুলোই অনেক সুন্দর। ভদ্রতার খাতিরে কেউ সন্দেহ করলেও জিজ্ঞাসা করে না কেউ কাউকে। তবে কিছু লাভ হয়নি। নিজেকে অলংকৃত করা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু স্বর্ণকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। না বাড়ীর লকারে রেখে, না ব্যাংকের ভল্টে রেখে।

আর যেখানে সেখানে রাখলে তো প্রস্তুত থাকে বাড়ীর হেল্পার রা। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দিবা চা ঢেলে এনে দুখানা টোষ্ট নিয়ে বসতেই কলিং বেল। ঐ বুঝি এলো ময়না। দিবা হাত থেকে কাপ নামিয়ে রেখে সদর দরোজা খুলে বললো আয়।

ময়না, ছ’মাস হলো ওদের ঘরে কাজ করে। শ্যামলা ক্ষিনাঙ্গী অথচ চেয়ে থাকার মতো একটা চেহারা। কি দারুন মিষ্টি হাসি! অত্যন্ত কাজ সহিষ্ণু আর বিনয়ি। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, কাজল রেখাদের পড়শি মেয়ে।

প্রথমদিন দিবা যখন জিজ্ঞেস করেছিলো ওর নাম ও বলেছিলো ‘ময়নামতি’ তো ওকে সবাই ময়না বলেই ডাকে। ও কাজ করার সময় দিবা তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকে গোপনে, আর ভাবে, সত্যিই আল্লাহপাক তার সৃষ্টির শৈল্পিকতাকে মনে হয় গরীব ধনি করেনি। ও যেন আপনার মনে প্রকৃতির কোলে ফুটে থাকা এক ফুল।

ময়নার কাজকর্মে দিবা খুব খুশি। কোনদিন কোন খারাপ আচরণ দেখেনি। প্রতিদিনের মতো আজও ময়না কাজ করে চলে গেল।

দিবা টি.ভি স্ক্রিনটা মুছে মুছে ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরেই দেখে কানের দুল একটা পড়ে আছে মেঝেতে আর একটা নেই! এদিক সেদিক খোজাখুজি করেও পেলনা। নেহায়েত দাম কম নয়। বালা দুল দুটো মিলিয়ে তো পাঁচশত! দিবা চিন্তা করলো এটা কি ময়নার কাজ? নাহ্, ময়নাকে তো কোনদিন কোন জিনিস নাড়তে দেখিনি। কিন্তু ঘরে তো ময়না আর আমিই ছিলাম।

সন্দেহটা একটু করে প্রকট হয়ে উঠলো। দিবা ভাবলো কাল আসলে পরে অন্যভাবে ময়নাকে জিজ্ঞাসা করবে। কি জানি, যুবতি মেয়ে সারাদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যে কটা টাকা রোজগার করে তাতো দালালদের পকেট ভরতে আর ঘর ভাড়া দিতেই যায়। স্বামী ঠেলা চালায় কোন দিন যায় তো কোনদিন যায় না। এই ঢাকা শহরে আলসে স্বামী কি আর বৌ এর একটু আধটু আবদার মেটাতে পারে?

কিন্তু নারী? সে কাজের বুয়া হোক আর সাত মহলার বেগম হোক, সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যেই সজ্জিতা হয়ে আপনার মনে বিলায় তার রুপ সুষমা “আমি সুন্দর” এ যেন শ্বাশ্বত এক উচ্চারণ।

পরদিন ময়না, যথারীতি আসলো। দিবা খুব সাধরণভাবেই বললো।

ঃ ময়না? ঃ জ্বি খালাম্মা?
ঃ তুই কালকে ড্রেসিং টেবিল ঝাড়তে আমার কানের জিনিসটা কোথায় ফেললি? একটা আছে তো আর একটা নেই। আমি তো অনেকক্ষণ খুজে ভাবলাম---- দিবার মুখের কথা শেষ না হতেই ময়না আঁকু পাঁকু ভাবের সাথে স্বভাব সুলভ মিষ্টি মিশিয়ে বলতে লাগলো-
ঃ খালাম্মাগো আমি ওরুম না। মানুষের সোনা পইরা থাকলেও আমি কোন দিন চোখ দেই নাই কা। আমরা গরীব মানুষ। আমাগো কাম কইরাইতো খাওন লাগবো। আল্লাগো খালাম্মা মনে করতাছে আমি বুঝি নিছি। দিবা ওর ভাবভঙ্গী থেকে বুঝেই নিলো যা বোঝার। বার বার ওর কথার ফাঁকে বলতে লাগলো না না, তোকে আমি বলছি না যে, তুই নিয়েছিস। আচ্ছা যাক, বাদ দে ওসব কথা। কাজ কর।

ময়না কাজ করে চলে গেল। দিবা ভাবতে লাগলো, একে অন্য ভাবে একটু পরীক্ষা করতে হবে। পরদিন ময়না এসে একটু তড়িঘড়ি করতে লাগলো। দিবা জিজ্ঞেস করলোঃ কিরে ময়না? কাজ না হতে, তাড়াহুড়ো করছিস কেন? তোর ভাইয়া ভাবী নেই। এই সময় একটু ঘর ঝাড়াঝাড়ির কাজগুলো সেরে ফেলতাম।
ঃ ময়না বললো, আইজ আমার শরিলডা বালা না। আমার স্বামী কামে যায় নাই। ঘরে কিচ্ছু নাই কি রান্দুম। খাওন দিতে না পারলে তো আবার কিলাইবো ধইরা।

একথা শুনে দিবার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল, পঞ্চাশ টা টাকা ওর হাতে দিয়ে বললো- যা এটা দিয়ে তরিতরকারি কিনে রান্না করবি আর আমার জন্য শাক কিনে পরিস্কার করে ধুয়ে ভাজি করে বিকালে আমাকে দিয়ে যাবি কেমন? ময়না বলতে লাগলো, খালাম্মাগো কি কন, আফনে আমাগো হাতের রান্দা খাইবেন?
ঃ কেন খাবো নারে? কেন দেখিস না? আমাদেরি মতো মায়ের ছেলেরা পড়া শোনার জন্য চাকুরির প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় মেসে থাকে? তখন তো তোদের মতো বুয়ারাই রান্না করে খাওয়য়।

জানিস ময়না? হিসেব করে বলতে গেলে, বলতেই হয় ওরাও জাতির “মা।” কারণ ওদেরি হাতের রান্না খেয়েই তো আমাদের ছেলে মেয়েরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শেষ করে উপযুক্ত হয়ে, কর্ম ক্ষেত্র থেকে দেশের কাজ করে।

ঃ হঃ খালাম্মা আপনার মত কইরা কয়জন এমন চিন্তা করেগো? দিবা বললো-
ঃ আমার কী মনে হয় জানিসতো, জাতির জীবনের একটা সময় ওরাই মায়ের দায়িত্ব পালন করে শুধু কটা টাকা বেতনের বিনিময়ে। তবে স্বীকৃতিহীন।
ঃ খালাম্মা? সবাই বড় বড় অফিসার অয়। কিন্তু বুয়াগোরে কেউ মনে রাহে? নিদান বইলা ঈদে চান্দেও কেও একখান শাড়ি কি কয়ডা ট্যাহা দেয় না।
ঃ আচ্ছা যাগগে, তুই যা। আমাকে কিন্তু শাক দিয়ে যাবি ঠিক আছে? হঃ খালাম্মা আমু।
এর পর থেকে দিবা একটু সচেতন হলো। তিনদিন পর্যন্ত আর ওর শাক ভাজার দেখা নেই। চার দিনের দিন দিবা বাকি কানের দুলটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। উদ্দেশ্য, ময়না কী করে এটা দেখা।

ময়না যথারীতি এলো। দিবা জিজ্ঞেস করলো-
ঃ কীরে আমার শাকভাজি কই?
খালাম্মা, পোলাটারে মারছি ওর বাহেও মারছে।
ঃকেন? মারলি কেন?
ঃটেকা নাই হাতে একটা বন রুটি খাইবো আর লাটিম কিনবো,হের লাইগা মারছি। খালাম্মাগো রাগ অইয়েন না। আপনার ট্যাকা দিয়া কিন্না দিছি।
দিবা মনে মনে ওর অপরাধ মিশ্রিত মিষ্টি করুন মুখখানার দিকে তাকিয়ে খুব নরম সুরে বললো-
ঃ তো কবে আমাকে শাক খাওয়াবি? বলে ছেলের রুমে গিয়ে শুয়ে একখানা বই হাতে নিলেন। ময়না ঘর মুছে হাতে দুলটা নিয়ে দিবার কাছে গিয়ে মাথার পাশে দাড়িয়ে বললো খালাম্মা এই দুল? দিবা ওর বলার ভঙ্গীতেই বুঝে নিলো ময়নার চোখের নীরব আর্তি। দিবা হ্যাঁরে বলে বললো তুই নিয়ে যা এটা। ময়না বললো-
ঃ একটা নিয়া কি করুম? দিবা বললো আরেকটা কিনে নিয়ে কানে পরবি। ময়না বললোঃ সোনাও ফেল এ্যতো সোন্দর! তয় ফেরি আলারে দেহায়ে কমু এরুম একজোড়া আইন্না দেন। দিবা বললোঃ হাঁ হাঁ তাই বলিস।
ময়না আপন মনে বলতে লাগলো গরীব মানুষ কিনতারিনা। মনে চায় এক জোড়া কিন্না কানে দেই। দিবা ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে মনে মনে ভাবলো সূর্যোর আলো পেয়ে সব ফুলইতো ফুটে উঠতে চায়।

যৌবনও তার পশরা সাজিয়ে ধনি গরীব নির্বিশেষে সকলের দেহে আসে। সৌন্দর্যব্যাকুল করে তোলে এক নিদারুন পিপাসায়। তাতে কার কী এলো গেলো? তা যেন ভাববার ফুরসত নেই!

ময়নার এই আক্ষেপ মাখা কথাগুলো যেন দিবার কাছে ঝরে পড়া চাপা কলি হয়ে রইলো। মনে হতে লাগলো একেই কী বলে - ছোট প্রাণ ছোট ব্যাথা?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান পরিপক্ক লেখা, সূর্যের আলো পেয়ে সব ফুলই ফুটে উঠতে চায়,,,,,অসাধারণ লাইন, ভোট সহ শুভেচ্ছা রইল।
নাস‌রিন নাহার চৌধুরী মনে হলো চোখের সামনে দেখলাম যেনো। ভোট সহ শুভেচ্ছা রইল।
রুহুল আমীন রাজু অনেক ভাল লাগলো । শুভেচ্ছা নিরন্তর । আমার পাতায় আমন্ত্রণ ।
ইমরানুল হক বেলাল হৃদয় ছুঁয়ে গেল গল্পটা পড়ে । পাঠে ভোট এবং মুগ্ধতা রেখে গেলাম ।

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী