মা

মা (মে ২০১১)

অজানা আমি KHURSHED ALAM
  • ২৯
  • 0
  • ৯৬৮
ফেব্রুয়ারি থেকেই লিখা জমা দেবার ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, শব্দের সংকীর্ণতা, সর্বোপরি বিষয়বস্তুর অসামঞ্জস্যতার কারণে জমা দেওয়া হয়নি এবারের বিষয়বস্তু নিয়ে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকায় লিখাটা জমা দিয়েই দিলাম। যদিও তা গল্প হিসেবে লিখা, তবুও এর বিশেষত্ব হল একটি সত্য ঘটনা নিয়েই আবর্তিত হয়েছে এ লিখাটি।

আসল নাম চাঁদনী। প্রকৃত নাম টা মনে করতে মিনিট দু-এক সময় লেগেছিল তার। এখন নাম ললিতা। চাঁদনী নামটি এই ললিতা নামের আড়ালে মুছে যেতে বসেছিল। বর্তমানে পেশায় একজন ভাসমান যৌনকর্মী। ভদ্রসমাজে যার পরিচয় নগণ্য কীট হিসেবে।
কিন্তু তার জীবন তো এমন ছিলনা। ছোট একটি ভাই সহ বাবা-মা কে নিয়ে তাদের পরিবারটি অতি সচ্ছল না হলেও মোটামুটি সচ্ছল ছিল। তখন বয়স কত হবে ১৩ কি ১৪। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে মাত্র। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালই ছিল। হঠাৎ একদিন একটি ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সে টা ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এর পর থেকে সে ছেলে তাকে প্রতিদিনই বিরক্ত করত। খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে এলাকার মেম্বার এর ছেলে। তাই কেউ কিছু বলতে পারছে না। মুখ বুজে সব সহ্য করেই ললিতা স্কুলে যাওয়া আসা করতে লাগল। তখন বর্ষাকাল। এক বৃষ্টির দিনে স্কুল থেকে ফেরার পথে ঐ ছেলে তার বন্ধু সহ ললিতাকে একা পেয়ে পাশের মাঠে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। এ ব্যাপারে সালিশ বসিয়ে বিচার তো পায়ইনি উপরন্তু সবার ঠাট্টা বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। যেখানেই যায় সেখানেই সবার বিদ্রূপ দৃষ্টি তার জীবন বিষিয়ে তোলে। সহ্যের বাধ যখন ভেঙ্গে গেল তখন এসব থেকে পালাতে সে সর্বশেষ পথ হিসেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যায় ট্রেনে ঝাপ দিতে। কিন্তু বিধি বাম। সে তার কর্ম সম্পাদনে অসফল হয়। পরনে ছিল তার লাল জামা। তা দেখে ট্রেন থেমে যায়। ট্রেনে থাকা এক মধ্য বয়সী মহিলার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় সে। মহিলার আহবানে সাড়া দিয়ে চলে আসে ঢাকা। কিছুদিন যাবার পর বুঝতে পারল সে পতিতালয়ে আছে। আর ঐ ভদ্রমহিলা হচ্ছে এখানের সর্দারনী সবাই যাকে খালা বলে ডাকে। প্রথমে এখান থেকে পালানোর পথ খুঁজলেও সমাজের প্রতি জমে থাকা ক্ষোভ,ঘৃণা থেকে সে কিছুটা সাহসী হয়ে উঠল। সর্দারনী কিছু বলার আগেই সে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেল।

শুরু হল তার জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস। স্বপ্ন ছিল আর সবার মত একদিন তারও বিয়ে হবে,সংসার হবে। স্বামী সন্তান নিয়ে সে সংসার হবে সুখের সংসার। কিন্তু......।
দেখতে ভাল ছিল ললিতা। সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। পতিতালয়ে তার চাহিদা বাড়তে লাগল। ভালভাবেই কাটছিল তার এ জীবনের সময়গুলো। অন্তত বাইরের সমাজের কেউ তো কিছু বলতে পারছে না।
একসময় তার একটি কন্না সন্তান জন্ম নিল। সে ইচ্ছা করেই মেয়েকে পৃথিবীতে আনল। এর আগে সে অনেক ভেবেছে। ভেবে দেখল তার মাঝে যে অস্তিত্ব বেড়ে উঠেছে তার তো কোন পাপ নেই। তাহলে সে কেন বলি হবে পাপের। যদিও সে জানে মেয়ের কোন সঠিক জন্ম পরিচয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। জানার পরও দিতে পারবে না তার পিতৃপরিচয়। কিন্তু তারপরও মেয়েটির তো কোন দোষ নেই। সে দরকার হলে এক আমার পরিচয়ে বড় হবে। দরকার হলে এই নষ্ট সমাজ থেকে অনেক দূরে নিয়ে তাকে মানুষ করব। এইসব ভাবনা থেকে ললিতা শেষ পর্যন্ত মেয়েকে পৃথিবীতে আনে। নাম রাখে আশা।
কন্যা সন্তান পেয়ে তো সবাই খুব খুশি। খুশি হবারই কথা। ললিতারা যে সমাজে বাস করে সেখানে মেয়ে সন্তানকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হয়। একদিন ললিতাদের কদর কমে যাবে, তখন মেয়েই হবে তার লাঠি। ছেলে সন্তানকে এখানে কেউ কামনা করে না। কারণ তাকে দিয়ে এখানে আয়ের কোন সুযোগ নেই। উপরন্তু যত বড় হবে ততই তার চাহিদা এবং উৎশৃঙ্খলতা বাড়তে থাকে। তার উপর যখন সে বুঝতে শিখবে তখন মাকে ছেরে চলে যাবে। তাই মেয়ে হলে সবাই খুশি হয়।
কিন্তু ললিতা খুশি হতে পারেনি।কারণ সে জানে কখনোই সে তার মেয়েকে তার পিতৃপরিচয় দিতে পারবে না। যদিও সে জানে আশার পিতা কে। কিন্তু কে শুনবে তার মত নর্দমায় বাস করা এক কীট এর কথা। যতই দিন যায় ললিতার কপালে চিন্তার রেখা বিস্তৃত হতে লাগল। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো তার মেয়েকে এই পরিবেশ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। যেখানে তার এই কলঙ্কময় জীবনের স্পর্শ তার মেয়ের জীবনে লাগবেনা। দরকার হলে নিজের পরিচয়ও দিবে না। মনে মনে মেয়েকে নিয়ে আরও আরও কত স্বপ্ন দেখা শুরু করল।

মেয়ের বয়স যখন দেড় কি দুই বছর তখন সে একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে মেয়েকে একটি এতিমখানায় রেখে আসে। কিছুদিন পর সে চিন্তা করল যে তার মেয়ে তো এতিম নয়। বাবা মা দুজনই আছে। তাহলে সে কেন এতিমখানায় থাকবে। এই ভাবনা থেকে সে তার মেয়েকে এতিমখানা থেকে নিয়ে আসল। এবার তাকে সে দিয়ে দিল একটি চিলড্রেন কেয়ার সেন্টার এ। অবশ্য এখানে তাকে মাসে মাসে ফি দিতে হবে। তবে মাসে মাসে যাতে তাকে না আসতে হয় সেজন্য এককালীন কিছু তাকা পরিশোধ করে গেল। মেয়েকে ছাড়া থাকতে তার কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই ভেবে কখনো তিন মাস আবার কখনো ছয় মাস পর সে গিয়ে মেয়েকে দেখে আসত। যখন মেয়ের বয়স পাঁচ বছর তখন সে তাকে চিলড্রেন কেয়ার থেকে এনে একটি স্কুলে ভর্তি করে দিল। মেয়েকে রাখার ব্যবস্থা করল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার বাসায়। ললিতার মুখে সব কথা শূনে এবং মেয়েকে নিয়ে তার স্বপ্ন দেখে প্রধান শিক্ষিকা তার মেয়েকে বাসায় রাখতে রাজি হলেন। মাঝে মাঝে স্কুল ছুটির সময় এসে ললিতা মেয়েকে দেখে যেত। ম্যাডাম এর কাছ থেকে মেয়ের পড়ালেখার খোঁজখবর নিত। পড়ালেখায় ভাল জেনে ললিতা খুব খুশি হল। পড়ালেখায় যে সে আসলেই ভাল তার স্বাক্ষর সে প্রতিটি ক্লাসেই রাখতে লাগল। দেখতে দেখতে কেতে গেল আরও পাঁচটি বছর। সময় হয়ে গেল স্কুল পরিবর্তনের। দুশ্চিন্তা ভর করল ললিতার উপর। এখানে ম্যাডাম এর কাছে মেয়েকে রেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিল সে। একদিন সে এ বিষয়ে ম্যাডাম এর কাছে যায় পরামর্শের জন্য। ম্যাডাম তার কথা আগেই ভেবে রেখেছিল। আশা পড়ালেখায় ভাল। ম্যাডাম তাকে আশ্বস্ত করে বলল যে আশাকে তিনি একটি ভাল স্কুলে ভর্তি ও থাকার ব্যবস্থা করেছে। কথাটা শুনে ললিতা কেঁদে ফেলল। ম্যাডাম বলল কি হল তুমি কি মেয়েকে ভাল স্কুলে দিতে চাচ্ছনা। ললিতা সাথে সাথে বলে উঠল না না ম্যাডাম তা কেন বলব। এটা আমার খুশির কান্না। আমি আপনার ঋণ কোন দিন শোধ করতে পারবনা। আমি আর কি করলাম। একটা মেধাবী স্টুডেন্ট এর ভবিষ্যৎ টা দেখিয়ে দিলাম মাত্র। তবে আমি বলি কি এখন থেকে তুমি মেয়ের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দাও। কারণ মেয়ে বড় হচ্ছে। তার মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। তার এখন কোমল মন। যে কোন কিছু সে সহজভাবে নাও নিতে পারে। ললিতা বলল যদি যোগাযোগ কমিয়ে দেই তাহলে পড়ালেখা চলবে কি করে? ম্যাডাম বলল সে বিষয়ে তুমি চিন্তা করোনা। ওসব বিষয়ে আমি সকল খবর রাখব। তুমি আমার সাথে এসে মাঝে মাঝে খোঁজ নিয়ে যেও। এই কথা শুনে ললিতা ম্যাডাম এর পায়ে পরে গেল। ম্যাডাম আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন। আপনার এ উপকার আমি জীবনেও ভুলব না।
আজকের মত ম্যাডাম এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ললিতা চলে গেল। বাড়ি গিয়ে আজ নিশ্চিন্ত মনে একটা ঘুম দিল।
আজ আশাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করানো হল। ললিতা আসেনি। ম্যাডামই আশাকে নিয়ে গিয়ে সব ফর্মালিটি পূরণ করে ভর্তি করাল। ম্যাডামকে আশা কয়েকবার তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। ম্যাডাম বলে যে তার মা বিশেষ কাজে আটকে গেছে তাই আসতে পারেনি। ক্লাস শুরুর দিনে ম্যাডাম ললিতাকে নিয়ে স্কুলে যায়। অনেকদিন পর মা-মেয়ের দেখা হয়। কোন মতেই আশা তার মাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। অনেক বলে কয়ে বুঝিয়ে তারপর ওখান থেকে ললিতা আসে। মেয়েকে ছেড়ে আসতে ললিতার ও খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কিই বা তার করার আছে। দূরে থাকলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ তো সুন্দর হয়ে যাবে। যত কষ্ট সব সে তার বুকেই চেপে রাখল।
যতই দিন যাচ্ছিল মেয়ের সাথে তার যোগাযোগ কমে যাচ্ছিল। তবে সর্বদা ম্যাডাম এর কাছ থেকে সে মেয়ের খোঁজ খবর নিত। এভাবেই কাটছিল দিনগুলো।

আস্তে আস্তে মেয়ে বড় হচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। অন্য দিকে তার বয়সও বেড়েছে। মেয়েকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে বয়সের তুলনায় বেশিই তার শরীর ভেঙ্গে গেছে। ফলে খদ্দেরদের নিকট তার চাহিদা কমে গেল। যার পরিণাম উপার্জন কমে যাওয়া। ভাল স্কুলে ভর্তি করানোর পরও সে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে পারছিল না। কারণ ভালভাবে পাশ করার পর ভাল কলেজে ভর্তি করান,তারপর পড়া শেষ করে ভাল কোন চাকরি পেতেও বেশ তাকার দরকার। তাছাড়া মেয়কে ভাল দেখে একটি বিয়ে দিতে হলেও প্রয়োজন টাকার। তাই উপার্জন কমে গেলেও নিজে কষ্ট করে চলে মেয়ের জন্য সামান্য কিছু করে সে সঞ্চয় করতে লাগল।
এখন পর্যন্ত তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে মানুষরূপী হায়েনাদের থেকে তার মেয়েকে দূরে রাখতে। সবাই জানে ললিতা তার মেয়েকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। সবাই আসল ঘটনা জানতে পারলে হয়তবা আশারও তার মত পরিণতি হতে পারত। উপার্জন কমে যাওয়ার পর থেকে সর্দারনী মহিলাটি সবাই যাকে খালা ডাকে ললিতাকে অনেক চাপ দিয়েছে তার মেয়ের ব্যাপারে। কিন্তু ললিতা কিছুতেই মেয়ের ব্যাপারে একটি শব্দও মুখ থেকে বের করেনি। শুধু বলেছে যে তার মেয়ে তার দেশের বাড়ি আছে। এত কষ্টের পরও এই ভেবে ললিতা খুশি যে তার মেয়ে এখনো সুরক্ষিত।

দেখতে দেখতে কেটে গেল চার সাড়ে চার বছর। সামনে আশার এস এস সি পরীক্ষা। ম্যাডাম এর তত্ত্বাবধানে থেকে লেখাপড়া ভালভাবে শেষ করেছে এই কয়টি বছর। স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে নিয়ে আশাবাদী একটা ভাল রেজাল্ট এর। পরীক্ষার কিছুদিন আগে ম্যাডাম ললিতাকে নিয়ে তার মেয়ের কাছে আসল। এতদিন পর মাকে পেয়ে আশা আনন্দে কেঁদে ফেলল। মাকে সে কিছুতেই আর যেতে দিবেনা। এবার অনেক দিন পর এসেছে ললিতা। এ কারণে আশার কিছুটা অভিমান আছে মায়ের উপর। তাই এত সহজে মন গলল না আশার। ললিতা অনেক বলে কয়ে মেয়েকে মানাল। পরীক্ষার পর মেয়েকে নিজের কাছে রাখবে এই কথা দিয়ে তবেই মেয়ের কাছ থেকে ছুটে আসে।

আজ এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হতে বেশি দেরি নেই। ললিতা এসেছে মেয়েকে নিতে। সাথে ম্যাডামও এসেছে। দুজনই হলের গেটে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আশা বেরুল হলের গেট দিয়ে। সামনে মাকে দেখতে পেয়ে তার আনন্দের আর সীমা রইল না। ললিতা জিজ্ঞেস করল পরীক্ষা কেমন হয়েছে? আশা বলল খুব ভাল হয়েছে। এখানে বেশি দেরি না করে ললিতা মেয়েকে সাথে করে প্রথমে আশার হোস্টেল তারপর সেখান থেকে যা যা লাগে সব নিয়ে আর দেরী না করে ম্যাডাম এর কাছ থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে সোজা কক্সবাজার এর উদ্দেশে রওয়ানা হল। সেখানে আগে থেকেই হোটেল বুক করা ছিল। ললিতা ও আশা সোজা গিয়ে সেখানে উঠল। খুশি হওয়ার কথা থাকলেও আশা এতে কিছুটা বিস্মিত হল। সে ভেবেছিল তার মা তাকে নিয়ে কোন বাসায় উঠবে যেখানে থাকে তার মা। কিন্তু সোজা কক্সবাজার আসবে সেটা কল্পনাতেও আসেনি। যাই হোক অনেক জার্নি হয়েছে তাই মা মেয়ে দুজনই ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে দুজনে তাই একটা ঘুম এর প্রস্তুতি নিল। কিন্তু কিছুতেই আশার ঘুম আসছিল না। বার বার শুধু তার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল যে তার মা তাকে এখানে নিয়ে আসল কেন।
আজ রাতে খেতে বসে হঠাৎ আশা তার মাকে বলল-

আচ্ছা মা তুমি হঠাৎ আমাকে কিছু না বলে কক্সবাজার নিয়ে আসলে কেন?
কেন এখানে তোর খারাপ লাগছে?
না তা বলছি না। তবে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই এখানে নিয়ে আসলে তাই বললাম।
তুই তো বললি যে পরীক্ষার পর তুই কিছুদিন আমার কাছে থাকবি। তাই তো তোকে নিয়ে এখানে এখানে আসলাম। আমারও অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয়না। তাই ভাবলাম মা-মেয়েতে মিলে কিছুদিন বেরিয়ে আসি বাইরে কোথাও থেকে। তোর এখানে ভাল না লাগলে বল যেখানে তোর ভাল লাগবে আমরা সেখানেই যাব।
না আমার খারাপ লাগছে না এখানে। তবে আমি তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম।
কেন তুই কি এখন আমার সাথে না?
আমি সে কথা বলছিনা......।

আশা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ললিতা মেয়েকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। এখন আর কিছু বলতে হবেনা। খাবার সময় এত কথা বলতে নেই। খাবার শেষ কর।
খাবার শেষ করেও আশা আর কিছু বলতে পারেনি। কারণ এর পর দুজনে মিলে ঘুরতে বের হল। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ায় একবারে রাতের খাবার সেরেই এসেছে দুজনে। অবশ্য ললিতা এ কাজটা ইচ্ছে করেই করেছে যাতে রুমে গিয়ে সোজা বিছানায় চলে যাওয়া যায়। কারণ সে চাচ্ছে না রুমে এসে আশা আবার তাকে কোন প্রশ্ন করুক। যেই ভাবা সেই কাজ। ললিতা এসেই বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিল। আশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল –
কি ব্যাপার মা এসেই শুয়ে পড়লে যে।
ঘুরে টায়ার্ড হয়ে গেছিরে মা, তাই আর কি।
এত সকালে শুয়ে পড়লে। আমি এখন কি করব একা একা?
তুইও শুয়ে যা। ক্লান্তি ভাবটা চলে যাবে।
আমি ক্লান্ত না। তুমিই শুও।

আশা এখন কোন উপায় না পেয়ে টিভি অন করে বসে পড়ল। ললিতা ঘুমাতে পারল না। তার মনে শুধু আশার করা সকালের প্রশ্ন গুলো ঘুরপাক করতে লাগল। সে খুব ভয় পেয়ে গেল। আজ তো মেয়ের কাছ থেকে এড়িয়ে গেল। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন। একদিন না একদিন সত্য প্রকাশ পাবেই। তখন কি তার মেয়ে তার কাছে থাকবে। নাকি কোন কথা শুনবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল। শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। তখনো সকাল হয়নি পুরোপুরি। পাশে আশা তখনো গভীর ঘুমে। ললিতা আস্তে করে উঠে বারান্দায় গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসল। আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগল। কিন্তু খুশি হতে পারল না। কেন জানি তার শুধুই মনে হতে লাগল সামনেই আধার ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল ললিতা। পিছনে তাকাতেই দেখে আশা দাঁড়ানো। তুই কখন উঠলি, আমাকে ডাকলি না কেন। ললিতার কথার উত্তর না দিয়ে আশা বলল-
আচ্ছা মা তুমি সবসময় এমন আনমনা থাক কেন? মনে হয় সারাক্ষণ কোন দুশ্চিন্তা কর।
ললিতা বলল আমার আবার দুশ্চিন্তা কি, তুই ভাল থাকলে আমার আর কোন চিন্তা নেই।
আচ্ছা মা তোমাকে কিছু প্রশ্ন করি?
আবার কি প্রশ্ন? আমি তোর মত এত বিজ্ঞ নই যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিব। তাই প্রশ্ন করে কোন লাভ নেই। আর তাছাড়া আমরা এখানে এসেছি মা-মেয়েতে মিলে কিছুদিন একসাথে আনন্দে কাটাতে। তাই যত প্রশ্ন-উত্তর সব পরে হবে। এই কয়দিন আমরা শুধু ঘুরব, আনন্দ করব ব্যাস।
কিন্তু মা...।
আর কোন কিন্তু নেই। কেমন। আজ থেকে যতদিন এখানে থাকব ততদিন না কোন প্রশ্ন না কোন কিন্তু। এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও। বেরুতে যাব।
আর কোন প্রশ্ন না করে আশা চলে গেল। এখানে থাকাকালীন আর কোন প্রশ্ন হয়নি। সময় হয়ে গেছে আশার রেজাল্ট এর। ললতা ও আশা ফিরে যাবার বন্দোবস্ত শুরু করে দিল। আগামীকালই তারা ফিরে যাবে।

আজ রেজাল্ট বের হচ্ছে। আশা কিছুটা চিন্তিত। ললিতা তার সাথে আছে। একটু পর ই রেজাল্ট আসবে। ম্যাডাম এসে দুজনের সাথে দেখা করে ভিতরে গেল। একটু পর ফিরে এসেই খুশির খবরটা দিল। আশা প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছে। তার স্কুলের ইতিহাসে এটাই সর্বাধিক সাফল্য এই পর্যন্ত। খবর শুনে মা-মেয়ে দুজনই খুশিতে আত্মহারা। সাথে ম্যাডাম আরেকটি খুশির সংবাদ দিলেন যে আগামীকাল স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে সংবর্ধনা দিবে।
আজ আশার সংবর্ধনা। সবাই এসে গেছে। কিন্তু ললিতা এখনো আসেনি। আশা তার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষায় না থেকে আশা একাই তার অনুষ্ঠানে আসল।মার প্রতি তার ভীষণ রাগ হল। কাল এত করে বলার পরও আজ আসেনি। ওদিকে ললিতাকে তার আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়ে যেতে বলছে ওখানের সর্দারনী। দুই দিনের সময় দিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ঐ ভেজাল রেখে তার আসা সম্ভব ছিল না। সবাই আশাকে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করিতেছিল। যাক তারপরও অনুষ্ঠান ভালভাবেই শেষ হল। তবে তার প্রধান শিক্ষক তার মাকে দেখতে চেয়েছে। ম্যাডাম তাই আশাকে বলল থিক আছে তুমি ওনাকে আমার বাসায় কাল দাওয়াত দিয়ে দাও আর ওখান দিয়ে আমি তোমার মাকে বলছি কাল আসতে। তাহলেই সব হয়ে যাবে।

আশা ও ললিতা ম্যাডামকে নিয়ে তার স্যার এর অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর দরজায় বেল বেজে উঠল। ললিতাই গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলেই ললিতা একটা ধাক্কা খেল। একি বজ্রাঘাত খেল আশার স্যারও। ওনি জোরে বলে উঠলেন তুমি এখানে?
শকের তীব্রতায় ললিতা কিছু বলতে পারল না।
ওনি আবারো বলে উঠলেন তুমার এখানে কি। এটাতো ম্যাডাম এর বাড়ি।
ততক্ষণে আশা এখানে এসে গেছে।
স্যার আপনি বাইরে কেন, ভিতরে আসেন।
ললিতা দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। স্যার ভিতরে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করলেন ও এখনে কি করছে।
কেন স্যার, ওনিই তো আমার মা। আপনি চিনেন না কি?
ইনি তোমার মা?
হ্যাঁ!
কথাটা শুনে একটু যেন মুচকি হাসলেন ওনি। তারপর আর না বসেই আচমকা এখান থেকে চলে গেলেন। আশা ও ম্যাডাম অনেক বলেও তাকে রাখতে পারল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় ললিতা বাক শূন্য হয়ে পরে। কিছুই সে শুনছে না। আশা বা ম্যাডাম কেউই কিছু বুঝল না কি হচ্ছে এসব। আশার প্রশ্নে ললিতা সম্ভিত ফিরে পেল।
মা আজ তোমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে?
ললিতা কিছু বলছে না।
কি হল শুনছ আমার কথা?
বল। আজকে তো বলতেই হবে।কর কি প্রশ্ন তোর।
আজ স্যার তোমাকে দেখে এভাবে চলে গেল কেন?
থেমে গেলি কেন?আর কি প্রশ্ন আছে কর। সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিব।
বল আমার বাবা কে? কি বা আমার পরিচয়?যখন থেকে বুঝতে শিখেছি বাবা কে তা জানতেও পারিনি। তুমিই বা কেমন মা? বুঝ হবার পর থেকে তুমাকে দেখছি কখনো মাসে একবার,কখনোবা তিনমাসে । তোমার কাছেই বা আমাকে রাখ না কেন? তুমি থাকই বা কোথায়?
এবার ললিতা বলা শুরু করল-
প্রথম কথা হচ্ছে আমি যা বলব তা হয়ত তুমি অনেকটাই বিশ্বাস করবেনা। তারপরও বলছি। তোমাকে এর আগে একবার বলেছিলাম যে তোমার বাবা নেই। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে নেই মানে কি ? কিন্তু আমি তখন এর উত্তর দেই নি। আজ তোমাকে বলছি যে তোমার বাবা আছে। তুমি একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলে যে তোমার স্যার এভাবে চলে গেল কেন। তার কারণ উনি আমাকে ভাল করেই চেনেন। তাই আর এখানে থাকতে চাননি। আগেও বলেছি আজকের কথা তোমার বিশ্বাস নাও হতে পারে। তবু বলছি ঐ লোকটিই তোমার বাবা। আশ্চর্যের কথা এই যে তিনি নিজেও হয়ত একথা জানেন না। আর আমি বা তুমি কেউ তা প্রমাণ করতেও পারবনা। আর উনিও স্বীকার যাবেন না। তবে তুমি তাকেই জিজ্ঞেস করতে পার তিনি হঠাৎ এভাবে চলে গেল কেন। এর বেশী আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। তুমিই বাকিটা বুঝে নাও।

আর কিছু বলতে পারল না ললিতা। বের হয়ে গেল এখান থেকে। আশা এখন কি করবে বুঝতে পারল না। ম্যাডাম এতক্ষণ কিছু বলেনি। ললিতা চলে যাবার পর সে আশাকে তার মা সম্পর্কে সব খুলে বলল। একেবারে শুরু থেকে যখন সে এক বৃষ্টির দিনে এলাকার মেম্বার এর ছেলের দ্বারা হওয়া। তারপর দুর্ভাগ্যক্রমে আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে ঢাকা চলে আসা এবং নষ্ট সমাজে পদার্পণ করা। তারপর হঠাৎ করে আশার আগমন। এই আশার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা । মানুষরূপী হায়েনাদের কাছ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের কাছে পর্যন্ত রাখেনি। আমার কাছে অনেক কাকুতি করায় আমি তোমাকে আমার কাছে রাখতে সম্মতি দেই । সে চেয়েছিল তোমার জীবনটা তার মত না হোক তাই সে তোমাকে নিজের কাছে রাখেনি। ললিতার কাছে থাকলে তোমার পরিনিটিও তার মতই হত।
এখন তুমি জান কি করবে। সমাজের অন্য সবার মত মাকে দেখে ছিছি করবে না তার ভালবাসা দেখে বুকে জড়িয়ে নিবে। এর বেশী কিছু আমার বলার নেই।

আগেই সর্দারনী ললিতাকে বের হয়ে যেতে বলেছিল। মেয়ের কাছে সব প্রকাশ হয়ে যাবার পর সে আর এ পল্লীতে ফিরে আসেনি।
ওদিকে ম্যাডাম এর মুখে সব শুনে আশা ম্যাডামকে নিয়ে ললিতাকে খুঁজতে আসে। কিন্তু কোথায় ললিতা। কেউ তার খোঁজও দিতে পারলনা। এবার আশা সত্যি সত্যি একা হয়ে গেল।
ললিতা ঐ দিন থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ভেসে বেরাচ্ছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রওশন জাহান অনেক সুন্দর গল্প। মায়ের প্রতি আশার মানসিকতা ভাল লেগেছে।
শিশির সিক্ত পল্লব অনেক সুন্দর...আমাদের সচেতন হতে হবে
নাজমুল হোসেন এরকম কাহিনী আমাদের সমাজে অনেক আছে l কিন্তু কেউ কি ভাবে দেখেছেন কেন তারা আজ ওই পথে যাচ্ছে ? কেন মেম্বরদের ছেলেরা আইনের উদ্ধে ? কেন আজ মা-বোনেরা নির্যাতিত ????
বিষণ্ন সুমন ১৯৯০-১৯৯৫ সাপ্তাহিক চিত্রবাংলায় প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত থাকা কালীন এমন অসংখ যৌনকর্মীর সাথে আমার কথা বলার সুযুগ হয়েছিল. তোমার গল্পটি তেমনি একজনের জীবন থেকে নেওয়া অতি বাস্তব কাহিনী. তোমার সুন্দর লেখনীতে তা আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে. এমনি করে আজীবন সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষের কথা লিখবে, এই কামনায় শুভাশীষ রইলো.
অদৃশ্য সুন্দর গল্প বেশ ভালো লাগল।
শাহেদুজ্জামান লিংকন ধন্যবাদ সত্য ঘটনাকে গল্পে রুপ দেয়ার জন্য। ভালো লেগেছে।
অজানা আমি KHURSHED ALAM ধন্যবাদ মোঃ শামছুল আরেফিন ও সৌরভ শুভ (কৌশিক ) . আমার kobita porar আমন্ত্রণ রইলো
সৌরভ শুভ (কৌশিক ) তোমার লেখা বাস্তব ঘটনা ,লিখেছ ভালো ,করনি ছলনা /
মোঃ শামছুল আরেফিন এক কথায় সুন্দর লেগেছে।করুন একটি কাহিনী।

০৫ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪