অন্তকাল

দিগন্ত (মার্চ ২০১৫)

Shohanur Rahman Anonto
১.
অবশেষে দূরত্বটা আমাদের মাঝে বেড়েই গেলো। আমি সংক্রামক টিবি পেশেন্ট। রোগটা ধরা পড়ার পর থেকেই আমার পৃথিবীটা পুরো পাল্টে গেছে। ভালবাসার দিগন্তে জমে থাকা নীলচে আল্পনাগুলো, কালো মেঘে ঢেকে গেছে। আমার স্ত্রী মোনালিসা চৌধুরি, সংক্ষেপে মোনা। একটি মেয়েকে সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা সবি আছে ওর মাঝে। আমার একমাত্র মেয়ে তৃণা সবে চারে পা রেখেছে। আপনজন বলতে ওরাই আমার সব। কিন্তু আজকাল আর ওদের আপন ভাবা যায়না। যেদিন থেকে আমার রোগটির খবর মোনালিসা জেনেছে সেদিন থেকেই আমার স্থান হয়েছে বারান্দার ফ্লোরে। এক রুমের বাসা, বারান্দাটা তুলনামূলক ভাবে বড়। সারাক্ষণ বারান্দার দরজা লাগিয়ে রাখতে হয়। রুমের ভেতরের দৃশ্য দেখার উপায় নেই। ওয়াসরুমে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করলে, দরজায় তিন টোকা দিলেই ঘর থেকে ওরা বের হয়ে যায়। কেউ আমার কাছে আসে না, কথা বলে না। প্রথম প্রথম মোনালিসা মাস্ক পড়ে আসতো কিন্তু এখন আর আসে না। খোঁজ নেয় না আমার, খেয়েছি কি খাইনি। অথচ এমন সময় পার করে এসেছি আমাকে ছাড়া মোনালিসা এক মলা ভাতও মুখে তুলেনি। মানুষ কত রাতারাতি বদলে যায়, নিজেকেই নিজে বোঝাতে চেষ্টা করি। মেয়েটাও আমার কাছে আসে না, বড্ড বেশি বোঝা হয়ে গেছি আমি। চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা সব খরচ হয়ে গেছে। রোগের কারণে চাকরিটাও হারিয়েছি। এখন আর কোন টাকা পয়সা নেই। মোনালিসাও আমার পেছনে আর টাকা খরচ করতে চায় না। আমাকে নিয়ে ভাবার সময় ফুরিয়ে গেছে, মুখে না বললেও বুঝতে পারি। সব কিছু মুখে বলতে হয়না। মোনালিসার মন থেকে প্রয়োজন ফুরালেও আমার মন থেকে ভালবাসা মুছে যায়নি। নিজ স্ত্রী’র দু’দিনে এমন মনোভাব দেখে বিন্দুমাত্র আহত হইনি। না খেয়ে পড়ে থাকি, বেলা অবেলায়। দরজার কাছে খাবার রেখে গেলেও ঢাকার অবহেলায় মাছির রাজত্ব দেখে আর খেতে ইচ্ছে করে না। মোনালিসা যখন বাসা থেকে বের হয়, আমি তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। একনজর দেখি, প্রিয় মানষটিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, অনুভব করি আমার চোখে বৃষ্টি নেমেছে।
২.
তৃণার ডাকে ঘুমটা ভাঙলো, বারান্দায় প্রবেশ করেনি, ঘরের ভেতর থেকেই ডাকছে। বলো মা, শুনছি। বাবা তুমি কি মারা যাবে?। মেয়ের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে যাই। মোনালিসা বাসায় নেই, আজকাল কোথায় যেন চলে যায়। হয়তো চাকরির খোঁজ করছে, আমার জন্যতো ওর লাইফটা থেমে থাকতে পারে না। আমি বললাম, তোমার এটা মনে হলো কেন মা?। আম্মু বলেছে। আম্মু আর কি বলেছে?। বলেছে তোমার কাছে যেতে না, তোমার ভয়ানক অসুখ, কাছে গেলে আমাদেরও হবে। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, কষ্টে গলা ভারি হয়ে আসছে। কাঁিশটা চেপে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হই। আজকাল কাশির সাথে রক্ত বের হয়। র“মালটা শক্ত করে মুখে চেপে ধরি। ইচ্ছে হচ্ছিলো দরজাটা খুলে মেয়েটিকে একটু কোরে তুলে নেই। আদর করি, কপালে চম্বুন দেই। আমি এক হতভাগা মানুষ, ইচ্ছেটা কেমন যেন অতিত হয়ে গেছে। তাই তাকে আর বর্তমানে টেনে আনতে পারি না। সেদিন খুব রাত করে ফিরলো মোনালিসা। সাথে আমার বন্ধু মঈন পাশা। বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদে কর্মরত। মনে মনে ভাবলাম হয়তো আমাকে দেখতে এসেছে। ঠোটের এক কোনে হাসি ফুটে উঠলো, কিন্তু আমার ধারনা একেবারে ভুল প্রমাণিত হলো। দরজার ওপাশে মঈন আর মোনালিসার তীব্র হাসির শব্দ আমার কাছে বিশের বাঁশির মতো লাগছিলো। কথার মাঝে মাঝেই হাসি, তীব্র থেকে তীব্র। আমি কানে হাত দিয়ে রাখি, আশ্চর্য্য হই, আমার দুর্বলতার সুযোগ হয়তো আমার বন্ধুও কাজে লাগাছে। এটাই হয়তো পৃথিবীর নিয়ম।
৩.
আকাশের চাঁদটা আজ অনেক বড় দেখাচ্ছে। ভরা জ্যোস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে বারান্দা। মঈন পাশা চলে গেছে না আছে আমি জানি না। দরজার ওপাশে কি ঘটে গেছে তাতেও অজ্ঞ। খুব সাহস করেই ডাকলাম মোনা....এই মোনা। কোন সাড়া শব্দ নেই, চতুর্থবার উত্তর এলো। কি হয়েছে? বেশ ঝাঁঝালো গলা। মঈন এসেছিল?। হু?। কেন?। কেন মানে, সে কি আসতে পারে না?। পারে, আমার সাথে দেখা করলো না যে?। যে রোগ বাধিয়েছো তাতে কি আর দেখা করার উপায় আছে। ও..ভুলেই গিয়েছিলাম, তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে?। আমি এখন ঘুমাবো। আর উত্তর এলো না মোনার। বারান্দার শিক ধরে আমি দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমন জ্যোন্সা মাখা রাত এক সাথে দু’জন কত কাটিয়েছি। সেগুলো আজ পুরনো হয়ে গেছে। পুরনো হয়ে গেছে আরো অনেক কিছুই। কেবল পুরনো হলো না ভালবাসাটুকু। এর কয়েক দিন পর আবার একদিন তৃণা বলেছিল বাবা তুমি কি সত্যি মারা যাবে?। সেদিন হ্যাঁ বলেছিলাম, জানিনা আমার কথা শুনে মেয়েটির কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।
আজকাল রোজই মঈন পাশা বাসায় আসে। কালো পাজারোতে করে মোনালিসাকে কোথায় যেন নিয়ে যায়। ঘরের মধ্যে অনেক রাত পর্যন্ত থাকে, একটি বারের জন্য আমার খবর নেয় না। আমি একজন মানুষ, কেন মঈন পাশা মোনালিসাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেটা অজানা থাকার কথা নয়। জেনেও না জানার ভান করে পড়ে আছি। মানুষ অসহায় হয়ে পড়লে, কঠিন ¯^রে কথা বলতে ভুলে যায়। আমর বেলাতে বুঝি তাই ঘটেছে।

৪.
ফিস ফিস করে বললাম, মোনা..এই মোনা। আজও চতুর্থ ডাকে উত্তর এলো। আমি কাল চলে যাচ্ছি। মোনা কিছুইটা নিরব থেকে বলল, আর ফিরবে না তো?। না, কোথায় ফিরবো, ফেরার জায়গাটা আর নেই। তোমার মনের জায়গা যেদিন থেকে হারিয়েছি সেদিন থেকে সব হারিয়ে গেছে। তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি আর ফিরবো না, তোমার কাছে। আর একটা কথা, তৃণাকে একটিবার দেখে যেতে চাই। যদি বেঁচে থাকি তাহলে হয়তো মেয়েটিকে দেখতে আসবো। মোনা বলল, সেটা সম্ভব নয়। আমি আর কিছুই বলিনি, বলার ইচ্ছেটাও নেই। পরদিন চলে যাওয়ার সময় মোনার দিকে একবার তাকিয়ে ছিলাম। আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে। আমার থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিযে পড়লাম। ডাক্তার বলেছিল, নিয়মিত ভাল খাবার খেতে কিন্তু সাধারণ খাবারই আমার কপালে জুটেনি। তাই শরীরও অনেক দুর্বল, রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি জানি না। হঠাৎ চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। কেবল কানে একটা মেয়েলি শব্দ ভেসে এলো। আমাকে কে যেন ডাকছে।
৫.
চোখ মেলে তাকাতেই বুঝলাম, একটি ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। পাশের ঘরে থেকে গরম দুধ হাতে এসে দাঁড়ালো একজন তরুণী। চিন্তে কষ্ট হয়নি, ভার্সিটি লাইফের কাছের বান্ধবি মিতা মুখার্জি। কি হয়েছিল তোমার? মুখ দিয়ে এভাবে রক্ত বের হলো, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। পজেটিভ টিবি রোগী এটা বললে ভয় পেয়ে যেতে পারে। শুধু বললাম, তোমার এখানে কয়েকটা দিন থাকা যাবে। মিতার মুখের হাসি মলিন হয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল, আমার ওনি আসুক, একটু জিজ্ঞেস করি। ঠিক আছে। মাঝরাতে মিতার ¯^ামি এলো মদ পান করে। এসেই যখন শুনেছে, ঘরে একটি ছেলে রয়েছে তখন থেকেই মিতাকে গালমন্দের সাথে মারধোর শুরু করেছে। বেচারি আমার জন্য কতটাই না মার খেলো। একসময় মার থেমে গেলো, ভেসে আসলো কান্নার শব্দ, মিতা কাঁদছে। আর আমি বুঝতে পারলাম, সবার ঘরের দরজা আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। দরজাটা খুলে নিরবে বের হয়ে গেলাম। এই পথ ধরে কত মোনালিসার সাথে রিক্সায় ঘুরেছি, তার হিসেব নেই। চেনা স্মৃতিগুলো অচেনা, তবে স্পর্ষ্ট। রাস্তার দুপাশে অন্ধকার, রাত গভীর। আমি কেবল হেঁটে যাচ্ছি, এই শহর থেকে অনেক দূরে চলে যাবো, নতুন কোন জায়গায়, নতুন কোন মানুষের মাঝে। আবারো মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে, চোখে ঝাপসা দেখতে থাকি। কাঁধ থেকে পড়ে যায় ব্যাগটা। মাথাটা ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে চোখের সামনে অন্ধকারটা তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকে। চোখের পাঁপড়ি বন্ধ করতেই মনে হলো, মনোলিসা আমাকে ডাকছে। অনেক কষ্ট আবার চোখ মেলে তাকাই, কোথাও কেউ নেই। চোখের কোণ দিয়ে এক ফোটা অশ্রæ মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। অন্ধকার আকাশের নীচে, ধুলোমাখা রাস্তায় পড়ে থাকে একটি কষ্টে মোড়ানো দেহ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রিন্স ঠাকুর ভাল লাগল। শুভকামনা নিরন্তর। আমার কবিতাটি (দিগন্তের মাঝে বিন্দু) পড়ার আমন্ত্রন রইল।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ লেখার মাঝের আবেগের কাতরতা খানিকটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেল । মনেই হচ্ছে না, এটা প্রথম লেখা । ভাল লাগল ।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল।
মনজুরুল ইসলাম েমানািলসা এবং িমতা এই দুই নারী চিরত্রর মাধেম দ্বািন্দক রুপ চরমভােব ফুেট তুেলেছন। পৃিথবীর স্বাথর্পরতার কােছ অাসেল েমানািলসার স্বামী িকংবা িমতা মুখার্জীর ভঅেলালাগার মানুষরা অিত অসহায়।অেনক ভােলা লাগল।
মোঃ আক্তারুজ্জামান অনেক সুন্দর ভাবনার ফসল। ভালো লাগলো। শুভ কামনা।

২৫ ফেব্রুয়ারী - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪