বাতিঘর

কি যেন একটা (জানুয়ারী ২০১৭)

নাঈম
  • 0
শহরবাসী হবার পর থেকে মাঝে মাঝে আমি বেশ হাঁপিয়ে উঠি, বাবার চাকুরীর যুগে আমরা থাকতাম মফস্বলে, বাধাহীন ঐ জীবনটায় বেশ অভ্যস্ত ছিলাম। নামী স্কুলে যেতে হতনা, খুব ভাল ফলাফল করবারও চাপ ছিলনা কেমন যেন একটা আপন ভোলা জীবন। গাছের নীচে নিজের আপন চিন্তায় ডুবে থাকা, সাথীদের সাথে মাছ ধরতে যাওয়া, অথবা সবাই মিলে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার দেয়া, জীবনটা তখন খুব অল্প নিয়মে বাঁধা ছিল। বড় হবার পথে, সন্তান মানুষ করার ব্যাবস্থাপত্র অনুযায়ী বাবা - মা আমাকেও এক সময় বড় শহরের নামী প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠিয়ে দিলেন, সেই থেকে আমি শহরবাসী, মাঝে মাঝেই হাঁপ ধরে যায়।

সব শহরেই দুই একটা নির্জন, নিশ্চুপ কোণ পাওয়া যায়, আমার সখ ওগুলো খুঁজে বের করা। তারপর, হাঁপিয়ে উঠলে কিছুক্ষনের জন্যে ওখানে আপন মনে হারিয়ে যাওয়া। এরকম একটু পাওয়া একাকিত্ব আমার খুব প্রিয়। এমনই একটা পছন্দের লুকিয়ে পড়ার যায়গা, কাছের একটা বাতিঘর। সন্ধ্যার পর যায়গাটা নির্জন হয়ে যায়, বাতিঘরের নীচে পাথরে সাগরের ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এসে আছড়ে পড়ে। বেশ দূরে থাকে শহরের ব্যাস্ততা আর কোলাহল। বাতিঘর বিরামহীন ভাবে মাথার ওপরের লাল বাতিটা কিছুক্ষন পরপর জ্বালিয়ে চলে।

সমুদ্রে থাকা জাহাজের নাবিক হয়ত দূরবীন দিয়ে বাতিঘরের লাল আলোটা দেখে আস্বস্ত হন বন্দর এসে পড়েছে, বাতিঘরের পাথুরে কূলটা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেই ঝলমলিয়ে উঠবে গন্তব্যের বন্দর। জাহাজ গুলো একের পর এক ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, নিশুতি রাতে বসে বসে দেখতে অপার্থিব সুন্দর লাগে। বাতিঘরটা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে, নাবিকদের পথ দেখিয়ে যাওয়াই কাজ, পাথুরে উপকূলের বিপদ সংকেত দিতেই ক্রমাগত জ্বালিয়ে চলেছে লাল বাতিটা। বাতিঘরের কোন গন্তব্য নাই, শুধুই দায়িত্ব, একদিন শুরু হয়েছিল বাতিঘর এর দায়িত্ব, সেই থেকে অসংখ্য নাবিক জাহাজ নিয়ে ওর পাশ ঘেঁষে গন্তব্যে চলে গেছে। জোছনা, অমাবস্যা, ঘন কুয়াশা ঘেরা বা ঝকঝকে পূর্ণিমার রাত, বাতিঘর আলো দেখিয়েই চলে।

এমন কিছু বাতিঘর এর মত চরিত্র আমাদের আসে পাশেই থাকে, সে জন্যেই হয়তো একটু লম্বা ভূমিকা দেয়া। এরা দায়িত্ব নেয়, প্রাণ ঢেলে দায়িত্ব পালন করে, এদের কোথাও পৌঁছাবার গন্তব্য বা লক্ষ নেই, এরা তার প্রয়োজনও মনে করেনা, এদের ভেতরে কি যেন একটা পরিবর্তন হয়ে যায় । এরকমই এক বাতিঘরের কথা লিখতে বসেছি। ১৯৪৪ সাল, রেঙ্গুন এর কিয়িমিনদিয়াং এর বাড়ীতে আজ থান্থ-সেইঁ এর বিয়ে। পনেরো বা ষোল বছরের উচ্ছল মেয়েটা নূতন জীবনের স্বপ্নে বিভোর। থান্ত-সেইঁর মা সুযোগ পেলেই বুঝিয়ে চলেছেন নূতন সংসারে দায়িত্বের কথা, থান্থ-সেইঁ এর মাথায় সে কথা ঢুকছে বলে মনে হয়না, সে নিজের আনন্দে বিভোর। শুক্রবার নামাজের পর বিয়ের অনুষ্ঠান, থান্থ-সেইঁর বাবা, কনের বাবা সুলভ উৎকণ্ঠা নিয়ে ব্যস্ত, বিয়ের বাড়ীতে অনেক কিছুই ব্যবস্থা করার এখনও বাকি। মনে মনে উনি বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ, ছোট মেয়ের বিয়েটা হয়ে গেলে একটু অবসর এর চিন্তা করতে পারবেন। সেই কবে নিজের শহর সিতুউই ছেড়ে রেঙ্গুন এসেছিলেন চাকরীর খোঁজে, অনেক বছর চাকুরী করে উনি সরকারের এর মাঝারি গোছের কর্মচারী হয়েছেন। হয়ত এবার অবসর এর কথা ভাবা যাবে। অবসর নিলে নিজের জন্মস্থানে আবার ফিরে যাওয়া যাবে, মাঝে মাঝেই নিজের শহরটার জন্যে বড্ড মন টানে।

বার্মায়, বিশেষ করে রেঙ্গুনে বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে। দুই বছর আগে ১৯৪২ এ হঠাৎ করেই জাপানীরা আক্রমণ করে বসল, কেন যে এই অশান্তি শুরু করতে হবে বুঝে পাননা এই সাধারণ চাকুরে। এখন যুদ্ধটা বেশ বেড়েছে, শ্যামদের সাথে হাত মিলিয়ে জাপানীরা, বিলেতীদের কাছ থেকে বার্মা দখল করে নিয়েছে। নাফ নদী ধরে ভারত আর বার্মা সীমান্ত আলাদা হয়ে গেছে, সীমান্তে পাহারা ঘাঁটি বসিয়েছে জাপানীরা, এরপর হয়তো রেঙ্গুন, সিতুউই, মুংদাও এর মানুষ চট্টগ্রামে যাতায়াত করতে পারবেনা। রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এসব ঘটনা ওনার খুব ঝামেলা লাগে। মেয়েদের সংসার গুছানো হয়ে গেলে উনি একটু শান্তি পাবেন, নিজের শহরে ফিরে যাবেন, এসব অস্থিরতা থেকে দূরে সরে থাকবেন।

থান্থ-সেইঁর বর রফিক, চট্টগ্রাম এর পটিয়ার ছেলে, ব্যবসা করতে রেঙ্গুনে এসেছে, রেঙ্গুন থেকে সিংহলী চা, দারুচিনি, তেজপাতা, শ্যাম দেশের চন্দন কাঠের জিনিস পত্তর আর রেশমি কাপড় চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করে। মাসে দুই থেকে আড়াই সপ্তাহ মালামাল আনা নেয়ার কাজে সাম্পান বজরাতে কাটে। যুদ্ধের জন্যে এখন প্রায়ই লোকসান গুনতে হচ্ছে। ঠিক মত মালামাল জোগাড় হয়না, মাঝে মাঝেই যুদ্ধ জাহাজের আনাগোনা দেখলে খালে, নদীতে লুকিয়ে থাকতে হয়, ব্যাবসা করা দিন দিন কষ্টকর হয়ে পড়ছে। থান্থ-সেইঁর নূতন সংসার এর শুরুতেই, অভাব যেন কামড়ে ধরে। যুদ্ধের সাথে উৎকন্ঠাও বেড়ে চলে। থান্ত-সেইঁ বুঝে পায়না এমনটা চললে মানুষ খেয়ে পড়ে বাঁঁচবে কেমন করে? দেশের কর্তাদের এ নিয়ে কোন চিন্তা নেই কেন? রফিক একদিন থান্থ-সেইঁকে নিজের দেশে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলো। অভাব হয়ত কাটবেনা, ওদিকটায় জাপানী বোমার হামলা নেই, অন্তত বেঁচে থাকা যাবে।

বার্মায় বাবা-মায়েরা বিশেষতঃ রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার জন্যে সন্তানদের দূরে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। নয়নের মনি সন্তানেরা কাছ ছাড়া হবার বেদনা সহ্য করে আছেন, বাবা-মায়ের মনে শুধু আশা, বেঁচে থাকুক, হয়তো আবার দেখা হবে। দেশের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে এসব পারিবারিক বিয়োগ খুব একটা উৎকণ্ঠার বিষয় নয় এরা শুধুই একটা নম্বর মাত্র, যোগের পরিবর্তে বিয়োগ হচ্ছে এতটুকুই শুধু পার্থক্য। এদেরকে বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম শরণার্থী নাম দেয়, এরা উদ্বাস্তু, এদের জন্যে আলোচনা সভা হয়, অনেক টাকার অনুদান বাণিজ্যও হয়, এরা আর সমাজের মানুষ থাকেনা। গত শতাব্দী থেকে এদের সংখ্যা শুধু বেড়েই চলেছে। থান্ত-সেইঁর পরিবারও সবদিক বিবেচনা করে ওদের পটিয়ায় চলে যাওয়ার পক্ষেই মত দেন। সাগর পথে জাপানীদের অত্যাচার খুব বেশী, ঠিক হয় রেঙ্গুন থেকে পাহাড়ী পথে মরুক-উ, সেখান থেকে সিতুউই, অতঃপর পায়ে হেটে মুংদাও হয়ে চট্টগ্রাম সীমান্ত। টেকনাফ দিয়ে চট্টগ্রামে ঢুকে পটিয়া পৌঁছানো যাবে, সব মিলে সড়ক পথে পনের কি কুড়ি দিনের পথ। ১৯৪৫ এর এক সকালে রেঙ্গুনের পাট চুকিয়ে রফিক এর সাথে বাসে উঠে বসে মরুক-উ এর পথে, যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত দেশটাকে বিদায় জানায় থান্ত-সেইঁ।

প্রকৃতির নির্বাচন প্রক্রিয়ার ব্যাপারটা শুনে থাকবেন হয়ত, বেশ দুরূহ ব্যাপার, জ্ঞানী জনেরা এ নিয়ে অনেক তত্ত্ব দিয়েছেন, মোদ্দা কথা, প্রকৃতি তাকেই শুধু রাখবে যে অসংখ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ন হবে, বাকি সবাইকে তলিয়ে যেতে হবে জীবনের আবর্তে। থান্ত-সেইঁ নিজের অজান্তেই যেন প্রকৃতির নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরীক্ষায় ঢুকে পড়ে। পটিয়ায় থান্ত-সেইঁর নূতন জীবন অনেকটাই অন্য রকম। অন্য দেশ, ভাষা, সামাজিক রীতি, প্রায় সবই অন্য রকম, আশ্রয় শুধু রফিক। জীবন তার আপন নিয়মে চলে, যুদ্ধে দেশ পুড়ে ছারখার হলেও পেটে ক্ষিদে লাগে, প্রিয়াকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে, সন্তানের আশায় মন উন্মুখ হয়ে থাকে। রফিক আর থান্ত-সেইঁ ওদের সন্তান আসার স্বপ্ন দেখতে থাকে, তবে আপাত যন্ত্রনা পেটের ক্ষুদারও কিছু একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। বাধ্য হয়েই রফিক আবার রেঙ্গুনের পথে যাত্রা করতে চায়, মনে ইচ্ছে চট্টগ্রামে বিক্রির জন্যে পণ্য আনা। স্বামী কে বিপদ সংকুল এ পথে পাঠাতে থান্ত-সেইঁর একটুও মত নেই। রফিকের যুক্তি, বাড়ীতে ওর মা, বৌ উপোষ করলে বসে দেখে থাকা যায় না, বাবা আগেই গত হয়ে যেন উদ্ধার করেছেন।

হয়ত রফিকের চিন্তা সত্যি, তবে যৌবনে শক্তি থাকে, দূরদর্শীতা থাকেনা, তাই মনে ভয় আসেনা, এর সংযুক্ত ফলাফল একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। মানুষের চরিত্রগুলো বেশ জটিল, অভাব আর ক্ষুদা এই জটিলতাকে আরো প্রকট করে তোলে। রফিকের সংসার হবার আগে ছেলের চিন্তায় ওর মা উদ্বিগ্ন থাকতেন, অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে, এখন ছেলের সাথে খাবারের ভাগ নিতে আরো একটা মুখ যোগ হয়েছে, সহসা ওদের সন্তান পরিবারের রসদের একটা বড় অংশ টেনে নেবে, রফিকের মা মানা করতে পারেননি। রফিক টেকনাফ দিয়ে রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে পথ দেয়ার কয়েক দিন পর খবর আসে পথে আক্রান্ত হয়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য আর নেই।

রফিকের মৃত্যুর কিছুদিন পর থান্ত-সেইঁর কোল জুড়ে আসে কন্যা, থান্ত-সেইঁর কাছে ওর পরিচিত পরিবেশের কিছুই তখন আর অবশিষ্ট নেই, বাবা, মা , রফিক, কেউই নেই। বাচ্চা মেয়েটার গায়ের মিষ্টি ঘ্রানে থান্ত-সেইঁ নিজেই নাম রাখে কিয়িইন। কিয়িইন কে খাওয়ানোর মতো সংসারে তেমন কিছুই নেই, তাই নিজের শরীরের নির্যাসটুকু প্রতিবার মেয়ের মুখে তুলে দেয়, ধীরে ধীরে নিজেকে নিঃশেষ করে চলে। শুরু হয়ে যায় প্রকৃতির নির্বাচনের আরেক অধ্যায়।

ছেলে, স্বামী হারা রফিকের মায়ের মন এখন অনেক শক্ত, শোক যেন ওনার মনকে পাথর করে দিয়েছে। নিজেকে বেঁচে থাকতে হবে, এই বর্মী মেয়ে আর ওর সন্তান কে রাখলে নিজের রসদের ভাগ দিতে হবে। অভাব কিছু মানুষকে মহান করে, আর বাকিদের বিবেকহীন পশুতে পরিণত করে। রফিকের বাড়ী থেকে থান্ত-সেইঁর পাট চুকে যেতে বেশী দিন সময় লাগেনি। শ্বাশুড়ীর বাক্যবাণ আর অত্যাচারে থান্ত-সেইঁ তিন মাসের কোলের সন্তান নিয়ে পথে নামে, উদ্দ্যেশ্য রেঙ্গুন ফিরে যাওয়া। থান্ত-সেইঁ আর অনেক ষোল বা সতেরো বছরের মেয়ের মতোই এই প্রথম পৃথিবীর বুকে একা পদচারণা। কেমন করে রেঙ্গুন পৌঁছাতে হবে তার বিন্দু মাত্র ধারণাও থান্ত-সেইঁর নেই , সবার সাথে সেও হাঁটতে থাকে শরণার্থীদের কাতারে।

সারাদিন বাচ্চা কোলে হেঁটে চলে, কোথাও পানি পেলে পান করে কেউ খাওয়া দিলে খায়, তবু হেঁটে চলে, রাতে অন্য মেয়েদের সাথে ঘেঁষে বসে থাকে। লোভী পুরুষের চোখ ওর শরীরের প্রতি, তা এড়াতে ও লুকিয়ে থাকে বয়স্কাদের মাঝে। মেয়েরা সমাজের চোখে মানুষ না পণ্য, ও এখন ঠিক বুঝতে পারেনা। রাতে মশার কামড়ে কোথাও স্থির থাকা দায় , অপেক্ষা করে থাকে কবে ভোর হবে, একটু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসলে কিয়িইন কেঁদে ওঠে। দিনের পর দিন ক্লান্তি জড়িয়ে ধরে মেয়েটাকে, তবু থান্ত-সেইঁ হারতে চায় না, ওর মেয়েকে একটা জীবন দিতে চায়। প্রকৃতির নির্বাচন প্রক্রিয়ার কঠিনতম অংশে ওর জীবন কোন দিকে মোড় নেবে ও তখনও জানত না, জানলে হয়ত নিজের আর মেয়ের জীবন হনন করতো। নিয়তি দেখা যায়না সেটা খুব বড় একটা সুবিধা। দেখতে পেলে আমরা এর অনেকটুকুই মেনে নিতে পারতাম না।

থান্ত-সেইঁ যেদিন কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করে চট্টগ্রাম শহরে ঢুকলো ওর গায়ে তখন প্রচন্ড জ্বর, কত জ্বর মাপার ইচ্ছে বা সুযোগ কোনটাই নেই , বর্মী ভাষায় কথা বলতে পারে এরকম কাউকে চোখে চোখে খুঁজতে থাকে আর আরাকান সড়ক ধরে সামনে এগুতে থাকে, গরমে মাঝে মাঝেই মাথা ঘুরে উঠছে তবু পথ ওকে পেতেই হবে রেঙ্গুন পৌঁছাতেই হবে।

চক বাজারের মোড়ে, আরাকান সড়ক যেখানটায় নবাব সিরাজুদ্দৌলা সড়কের সাথে যুক্ত হয়েছে ওখানটায় এক রোহিঙ্গা মেয়ে কে বসে ভিক্ষা করতে দেখলো। ভিক্ষা করায় থান্ত-সেইঁর একেবারেই রুচিতে দেয়নি, খাটনি দিয়ে আয় করে চলাই ওর ইচ্ছে, ভিক্ষা নয়। পায়ে পায়ে মেয়েটার কাছে এগিয়ে যায় , নরম সুরে জানতে চায় ও বর্মী ভাষায় কথা বলতে পারে কিনা? মেয়েটি এক ঝলক ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে, মেয়েটি কিয়িমিনদিয়াং এ থান্ত-সেইঁদের প্রতিবেশী ছিল, নাম ফিউ সান্ডি। থান্ত-সেইঁ ওর পাশে বসে পড়ে, হঠাৎ বুক ভেঙ্গে কান্না আসে, ছোট বেলায় ফিউ সান্ডির সাথে থান্ত-সেইঁ আর ওর বোন কত দিন লুকোচুরি খেলেছে আজকে এমন পরিবেশে দেখা হবে আশা করেনি।

ফিউ সান্ডি জানায় যুদ্ধের কারনে অভাব, সেই সাথে, বৌদ্ধ - মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়, ওদের পাড়ার প্রায় সব রাখাইনের রোহিঙ্গারা এলাকা ছেড়েছে। থান্ত-সেইঁর বাবা মা কোথায় ওর জানা নেই। ফিউ সান্ডি অনেক বোঝায় রেঙ্গুন গিয়ে কাউকে আর পাওয়া যাবেনা সে কষ্ট না করাই উচিৎ , থান্ত-সেইঁ নাছোড় বান্দা সে যাবেই। ফিউ -সান্ডি এই জ্বর শরীরে থান্ত-সেইঁ কে ছাড়তে চায়না, থান্ত-সেইঁর বাচ্চাটা কে কোলে তুলে আদর করে, থান্ত-সেইঁর উচ্ছলতা আর জেদের সাথে ফিউ সান্ডি আগেই পরিচিত ছিল, এই মেয়ে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয় না। তাই অনুরোধ করে খেয়ে যাওয়ার। সকাল থেকে বারো আনা ভিক্ষে পাওয়া গেছে , চার আনা দিয়ে এক বাটি ডাল আর খাবার দোকানের মালিকের কাছে হাত পেতে বাসী কিছু রুটি দুজন ভাগ করে খায়। থান্ত-সেইঁর অনেক দিন পর যেন একটু শংকা মুক্ত ভাবে বসে খেতে পারে। ফিউ সান্ডি ছোট্ট কিয়িইন কে কোলে নিয়ে আদর করেন, চুমু দেন, খেলা করেন, থান্ত-সেইঁ দেখে থাকে, কখন চোখ ভিজে আসে ও বলতে পারেনা।

জ্বরের প্রকোপে থান্ত-সেইঁর মাথা কিছুক্ষন পর পর ঘুরে ওঠে, তবু ও উঠে পড়ে ভিক্ষার সাথে সে নিজেকে সম্পৃক্ত করবেনা। তার জীবন এই মূল্যবোধ ওকে শেখায়নি, খাটনি করে আয় করতে পারলে খুব ভাল হতো, পড়ে পাওয়া দানে তার আগ্রহ নেই। মূল্যবোধ আমাদের মনের এক প্রতিরক্ষা প্রাচীর, এর জন্যে কেউ কেউ অন্যায় করতে পারেনা আর এর অভাবে অনেকে অন্যায়ের লোভ সামলাতে পারে না। মনের এই মূল্যবোধ এর বেশ কিছুটা নিজেদের গড়া, তবে এর মূল ভীতটা হয়তো জীবনের প্রথম কয়েক বছরে, বাবা-মা, সমাজ, শিক্ষা ব্যাবস্থার দিয়ে দেয়া। সেজন্যেই পূবের সংস্কৃতি যেমন জাপান, চীন, সন্তানদের মূল্যবোধ শেখানোর জন্যে জীবনের প্রথম কয়েকটা বছর প্রবল ভাবে ব্যবহার করে। পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যাবস্থাতেও এর প্রচলন এখন দেখা যেতে শুরু করেছে। থান্ত-সেইঁর শরীরের শক্তি খুব কম তবু মনে এখনও সাহস বেঁধে রেখেছে। কিছু একটা পথ বের করতেই হবে, ফিউ স্যান্ডি ওকে নিজের কাছ থেকে আট আনা দিতে চাইলে সে নিতে পারেনি। বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে সে এগিয়ে চলে।

নিজের দেশে যদি ফিরেই যাওয়া না যায় তাহলে কি করার আছে? থান্ত-সেইঁ নিজের চেয়েও মেয়ের জীবন নিয়ে বেশী উৎকন্ঠিত। এর পরের দুইদিন সে কোন পথে, কোথায় গিয়েছে থান্থ-সেইঁর ঠিক মনে নেই। নিজের আর সন্তান এর ক্ষুদা নিবারন এর জন্যে, মাথার ওপর একটা ছায়ার জন্যে সে শুধু আয় করার একটা উপায় খুঁজেছে । অনেক পথ ঘুরে সে ঢাকা - চট্টগ্রাম সড়কের পাশে আবু তোরাব বাজারে এসে পৌঁছায়। রাস্তার পাশে সরকারী সুপেয় পানির কল থেকে আঁজলা ভরে পানি পান করে কিয়িইন কে কোলে নিয়ে বসে পড়ে কাছেই একটা গাছের ছায়ায়। জ্বর বেশ খানিকটা বেড়েছে জ্বরের প্রকোপে মাথা ঘুরানোর জন্যে আজ সে হাঁটতেই পারছেনা। নিয়তির কাছে সে তখন হয়ত মনে মনে একটা অলৌকিকতা চাইতে থাকে। নিয়তিও বিমুখ করেনা, হঠাৎ দেখতে পায় রফিক লাফিয়ে বাস থেকে নামছে। থান্থ-সেইঁ অবাক, ওর রফিক তাহলে বেঁচেই আছে? রফিকও মুখে বিপুল একটা হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে, মনে হয় বাস থেকেই ও থান্থ-সেইঁ কে দেখে কোন রকমে নেমে এসেছে। ক্লান্ত থান্থ-সেইঁ উঠে দাঁড়াতে পারে না রফিক কে দেখে ওর সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ। ছোট্ট কিয়িইন কে রফিকের হাতে তুলে দিয়ে সে একটু জিরিয়ে নিতে চায়।

আবু তোরাব বাজারের সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান, ডাক্তার আলীর সাথে পাঠকের পরিচয় না করলেই নয়। এলাকার লোকজন ওনাকে খোকা ডাক্তার নামেই আদর করে ডাকেন। ডাক্তার সাহেব কিছুদিন আগেই বদলী হয়ে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসেছেন। শরীরিক গড়নে ছোটখাট, বয়স লুকানো একটা চেহারা। এলাকায় ডাক্তার সাহেবের সমাদরের একটা বড় কারণ ওনার কর্ম স্পৃহা এবং নীতি। উনি বসে থাকার মানুষ নন, এলাকার হাটে একদিন বিক্রি করা মাংস খেয়ে, অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ল। এর পর আর যেন ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে উনি বাজার সমিতির সাথে যোগাযোগ করে, হাটে বিক্রির মাংস এবং প্রাণী পরীক্ষা করার দায়িত্ব নিলেন। সেই থেকে এলাকার মানুষ নিশ্চিন্তে মাংস কিনতে পারে। সরকারী চিকিৎসা সুবিধা নিয়ে যেন বাণিজ্য না হয় সে দিকে ওনার সজাগ দৃষ্টি। এলাকার মানুষ ওনার এই সম্পৃক্ততাকে খুব ভালোবাসার চোখে দেখে। খোকা ডাক্তারের সংসারে তিন ছেলে, স্ত্রী, আর মা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের সংসারে মাঝে মধ্যেই অসচ্ছলতা দেখা দেয়, তবু নীতির কারণে খোকা ডাক্তার তা মেনে নিয়ে জীবন চালিয়ে নেন।

প্রতিদিন ভোরবেলা খোকা ডাক্তার ওনার বাইসাইকেল নিয়ে ভাড়া বাড়ী থেকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান, দুপুর বেলা খেতে বাড়ী আসেন আবার ঘন্টা খানেক পরে ফিরে চলেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, বিকেলে একটু দেরী করে, সাধারণতঃ মাগরিব এর নামাজ পড়ে বাড়ী ফেরেন। পথে দুয়েক জনের সাথে সালাম বা শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, এমনটাই ওনার নিত্যকার দিন। সেদিনও খোকা ডাক্তার ওনার বাইসাইকেল চালিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ফিরছেন মনে মনে পোয়াতি স্ত্রী এবং আসন্ন সন্তানের কথা ভাবছিলেন। ওনার একটা মেয়ের খুব শখ, ওনার মতো বিজ্ঞান মনষ্ক মানুষ প্রকৃতির নিজস্ব গতীতে বিশ্বাসী, সে নির্বাচনেই সন্তুষ্ট থাকতে চান। খোকা ডাক্তার সে মুহূর্তেও জানতেন না প্রকৃতি ওনাকে কি দায়িত্বে সহসা নির্বাচিত করতে চলেছে । বাজার পেরিয়ে, কলতলা অতিক্রম করে যাওয়ার সময় গাছতলায় তরুণদের একটা জটলা চোখে পড়ল, তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে তিনি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, এ সময় তরুণদেরই একজন “ডাক্তার বাবু” বলে ডেকে ওঠায় সজোরে সাইকেলের ব্রেক টেনে ধরলেন। ক্যাঁক ক্যাঁক করে বিরক্তি জানিয়ে সাইকেল একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, জটলার একটা অংশ সরে গিয়ে যেন ওনাকে দেখার সুযোগ করে দিল। উনি ফিরে তাকিয়ে দেখলেন রাস্তার পাশে এক শীর্ন ষোড়শী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তড়িঘড়ি করে এসে উনি গলার কাছে নাড়ি পরীক্ষা করে বুঝলেন এখনও বেঁচে আছে , গায়ে প্রচন্ড জ্বর। তরুনদের একজনকে ওখানে থাকতে বলে ছুটলেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, দুজন সেবককে রুগী নেয়ার বিছানা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন, রাস্তার পড়ে থাকা মেয়েটিকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলো।

এর পরের কয়েকদিন যমে-মানুষে টানাটানি চললো, খোকা ডাক্তার পরীক্ষা করে বুঝলেন মেয়েটির প্রবল ম্যালেরিয়া, পুষ্টির প্রচন্ড অভাব, স্নানাহার হয়নি কয়দিন কে জানে। রোগীদের প্রতি ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মীদের উৎসর্জন বাইরে থেকে সাধারণের বোঝার উপায় নেই। এরা আমাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ, ভিন্নতা এদের মানসিকতায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলে যে সব স্বাস্থ্য কর্মীরা অপর্যাপ্ত পথ্য এবং সরঞ্জামাদীর চালান নিয়ে সাধারণ মানুষ কে অসাধারন সেবা দিয়ে যান তা সত্যই বিস্ময়ের বিষয়। আমরা সংবাদ মাধ্যমে শুধু দেখতে পাই টাকার জন্যে রোগী এবং তার পরিবার কে জিম্মি করে রাখে কিছু স্বাস্থ্য কর্মী, বৃহদাংশ যারা রোগী কে সুস্থ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় ওদের খবর পাইনা, ওরা নিরবে সেবা দান করে যায় । দ্বিতীয় দিন মেয়েটির জ্ঞান ফিরলে সে কাকে যেন খুঁজতে থাকে। বর্মী ভাষায় কিছু বোঝাতে চায়। কিছু চেষ্টায় ডাক্তার সাহেব বুঝতে পারেন মেয়েটি ওর সন্তানকে খুঁজছে, ডাক্তার সাহেব এই মেয়ের সাথে কোন সন্তান দেখেননি। খোকা ডাক্তার আশেপাশের সবাইকে এই নাম পরিচয়হীন মেয়ের ঠিকানা খুঁজতে অনুরোধ করেন।

প্রকৃতির নির্বাচনের কথা আবারও বলতে হয়, থান্ত-সেইঁ, হয়ত চরম পরীক্ষায় পাশ করে গেল। খোকা ডাক্তারের মানবতার সেবায় সে সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে তার একটা মুল্য দিতে হয়েছে, তাই সে আজ সন্তান হারা মা। প্রকৃতির পরীক্ষায় পাশ করার জন্যেই জীবন বাজি রেখে আমরা যুদ্ধ করি, অনেকেরই হয়ত পাশও হয়, এর মূল্যের কথা চিন্তা করে বহুদিন পরে অনেক দূরে গিয়ে হয়ত বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

থান্ত-সেইঁ মেয়ের জন্যে ব্যাকুল হয়ে বিলাপ করতে থাকে, ওর জীবন যে মুল্যহীন, তার নিজের সত্ত্বার আর কিছুই বাকি নেই। ওর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই, শুধুই সন্তানের জন্যে আহাজারি। কখন কি ভাবে ওর বুকের ধন কে কোন পাষণ্ড নিয়ে গেছে তার কোন হদিস করবার ক্ষমতা থান্ত-সেইঁর নেই, বিলাপই এখন তার একমাত্র সম্বল। পাঠক কখনও যদি সন্তানহারা মায়ের বিলাপ না শুনে থাকেন, তবে আপনি সত্যিই ভাগ্যবান। মর্মান্তুদ এই বিলাপ অন্তর্ভেদী, সবার মনের অন্তস্থলে নাড়া দিতে বাধ্য। যে মায়ায় একজন মা সন্তানকে পেটে ধরেন, যে ত্যাগে লালন করেন, তাতে সন্তানের সাথে এক গভীরতম সম্পর্ক জন্মায়, তার কারনেই প্রত্যেকটা মায়ের কাছে তাঁর সন্তান সবচেয়ে প্রিয়। সন্তানের অবর্তমানে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাও মায়ের জন্যে অর্থহীন। প্রকৃতি থান্ত-সেইঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তবে ওর কাছে এই জগৎ এখন মূল্যহীন।

খোকা ডাক্তার এমন সমস্যায় কখনও পড়েননি। ডাক্তার হিসেবে অনেক রোগীকে চিকিৎসা করেছেন, রোগী ভাল হয়ে নিজের জীবনে ফিরে গেছে, কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, কেউ বিধাতাকে ধন্যবাদ দেয়। এই বর্মী মেয়ের হাসপাতাল ছাড়ার কোন ইচ্ছা বা কারণ নেই, সন্তানের জন্যে, রাত দিন শুধু বিলাপ করে যায়। ১৯৪৫ এ ঐ এলাকায় কোন মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্রও গড়ে ওঠেনি। ভাষা না জানা এই মেয়েকে উনি কোথায় ঠেলে পাঠাবেন বুঝে উঠতে পারেননা। এক রকম বাধ্য হয়েই উনি স্ত্রীর সাথে সমাধানের একটা পথ খুঁজতে থাকেন। এমন মানবিক ব্যাক্তির সহধর্মিণীরও একটা মানব দরদী মন ছিল, সংসারী মানুষ অনেক সময়ই অনুধাবন করতে পারেননা সহধর্মিণী ওনাদের সাফল্যের পথে নিরবে সমর্থন দিয়ে যায়, কোন দিন কৃতিত্ব দাবী করেননা। খোকা ডাক্তারের স্ত্রী, মেয়েটিকে বাড়ীতে নিয়ে আসার অনুরোধ করেন। ডাক্তার সাহেব একটু অবাক হয়ে যান, এমন সমাধান উনি আশা করননি। ওনার নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারে আরো এক জনকে যোগ করা কতটুকু যুক্তি সংগত হবে বুঝতে পারেননা। স্ত্রীর ধারনা অবশ্য অন্য রকম, একজন মা শুধু সন্তানহারা মায়ের দুঃখ বুঝতে পারেন, তিনি খোকা ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলেন, কিছুদিনের মধ্যেই ওনাদের চতুর্থ সন্তান পৃথিবীতে আসবে, একটা বাচ্চাকে পেলে হয়ত মেয়েটির দুঃখে কিছুটা ছায়া পড়বে, নিজেদের কাছে রেখে ভাষাটাও শিখিয়ে দেয়া যাবে, তখন সে নিরাপদে তার নিজের পথে যেতে পারবে। এই কয়দিন বাচ্চার দেখ ভাল করার মাইনে বাবদ ওর হাতে কিছু টাকাও দিয়ে দেয়া যাবে। সমাধানটা ডাক্তারের বেশ মোনঃপুত হয়। পরের দিন ডাক্তার সাহেব ওনাদের যথাক্রমে আট, সাত এবং সাড়ে পাঁচ বছরের তিন ছেলে এবং মা কে সিদ্ধান্তের কথা জানান। এতে কারও আপত্তি দেখা গেলনা, ছেলেরা ভিন্ন ভাষায় কথা বলা একটি মেয়েকে ভাষা শেখানোর উৎসাহে উন্মুখ।

সন্ধ্যায় ডাক্তার সাহেব থান্ত-সেইঁকে বাড়ী নিয়ে আসলেন। থান্ত-সেইঁর মনে অনেক শংকা ছিল, তবে যে ডাক্তার ওর জীবন রক্ষা করেছে, সে হয়ত তাকে বিপদে ফেলবেনা, সে বিশ্বাসেই সে ডাক্তারের বাড়ীতে চলে আসে। ডাক্তার পত্নী, মা এবং তিন ছেলে তাকে বাড়ীতে সাদোরে গ্রহন করে নেয়। ডাক্তার পত্নীর দেয়া কাপড়ে স্নানাদি সম্পন্ন করে, বহুদিন পর ঘরের রান্না করা খাওয়া খায়। নূতন পরিবেশে সে আর বিলাপ করেনা, বুঝে নেয়ার চেষ্টা করে তার করণীয়। বুঝে নেয় মন, এভাবেই হয়ত কাটাতে হবে জীবন।

রাতে ঘুমের ঘোরে থান্ত-সেইঁর অবচেতন মন কিয়িইন কে খুঁজতে থাকে। প্রতি রাতেই সে দুঃসপ্ন দেখে, বিলাপ করে যায় নিজের অজান্তে। থান্ত-সেইঁ ঘুমায় খোকা ডাক্তার এর মায়ের ঘরে, তিনি মেয়েটাকে স্নেহ করে রাখেন, তার সন্তান শোক ঢেকে দেয়ার জন্যে বিধাতার কাছে আবদার করতে থাকেন। ডাক্তার পরিবারে কেউ মেয়েটার নাম জানেনা, বর্মী ভাষাও কেউ বলতে পারেনা, বাধ্য হয়েই পরিবার ওকে একটা নাম দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমন দায়িত্ব নিতে পারেন ডাক্তারের মা, তিনি ইসলামিক জ্ঞান ও ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তাঁর দেয়া নামই সবার পছন্দ হবে তাই প্রত্যাশা। মেয়েটির বিলাপ শুনে ডাক্তারের মায়ের মন নরম হয়ে থাকবে হয়ত, উনি নাম রাখলেন “মুয়াউভিয়াহ”, আরবী ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় বিলাপকারী। বর্মী ভাষায় থান্ত-সেইঁ মানে স্বচ্ছ হীরা, সেখান থেকে মেয়েটি এখন বিলাপকারী, ওর দ্বিতীয় জীবন শুরু হয়ে যায়। নামটি কখন কি ভাবে যেন বদলে হয়ে যায় মা-বিয়া। ডাক্তারের বাড়ীতে মাবিয়ার জীবন কেমন হবে তখনও সে জানেনা। নিয়তি আমাদের জীবনের একের পর এক অধ্যায় উন্মোচন করে, সব টুকু এক সাথে দেখা যায় না। মানুষ অতীতের আলোতে ভবিষ্যত কে দেখতে অভ্যাস্ত, তাই অনেক সময়ই অনুমান ভূল হতে দেখা যায়।

১৯৪৫ এর পহেলা নভেম্বর খোকা ডাক্তার এর ঘরে আসে ওনাদের চতুর্থ ছেলে। ছোট বচ্চাটিকে পেয়ে মাবিয়ার মমতা উপচে পড়ে, পরিবারের সবার ওপর ধীরে ধীরে মাবিয়ার ভালোবাসা জন্মাতে থাকে, মন থেকে যেন দুঃস্বপ্নে ঘেরা সময় দূরে সরে যেতে থাকে। খোকা ডাক্তার এর চতুর্থ সন্তান এর লালন পালনে সে সদা ব্যস্ত। মাবিয়া ওর জীবন রক্ষা করার সম্মানে ডাক্তার কে ভাই বানিয়ে নেয় আর ডাক্তার পত্নীকে বুবু। এক সময় খোকা ডাক্তার বদলী হয়ে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে, সবার সাথে মাবিয়াও এখন পরিবারে অংশ। ডাক্তার পত্নী ওর কাজের জন্যে বেতন দিতে চাইলে সে নেয়নি, সে জীবন থেকে জেনেছে অর্থ দিয়ে জীবনের সব সম্পর্ক মাপা যায়না।

পরবর্তি দশ বছরে খোকা ডাক্তার এর সংসারে আরো তিন সন্তান এর মায়ায় ভোরে ওঠে। সাত সন্তানে ডাক্তার দম্পতির সংসার কলকাকলিতে ভরপুর, ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিরামহীন ব্যস্ততা, তারপরও ডাক্তার ও তাঁর পত্নী বসে থাকেননি, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন যদি কোন আত্মীয় স্বজন থেকে থাকে, ওকে আবারও সংসারী হতে বলেছেন। মানুষ এর জীবনে এক অংশের বোঝা অন্য অংশে এসে জীবনটাকে ভারী করে তোলে, মাবিয়া আর ষোড়শী নেই তার বুকে সব হারানোর বিশাল এক ক্ষত, সে আবার সংসার শুরু করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

একটা মানুষকে যখন শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা হয়, তখন তার জীবনের সংজ্ঞা বদলে যায়। মাবিয়ার জীবন থেকে সন্তান, স্বামী, আত্মীয়, পরিচিত পরিবেশ সব চলে গিয়ে জীবন মোহহীন হয়ে গেছে। তার কাছে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে পাওয়া দিনটাই একটা শুভদিন, একটা প্রাপ্তি। ওর সততায় ডাক্তার পরিবারের চোখ এড়ায় না, ডাক্তার পত্নী ধীরে ধীরে ওর ওপর সংসারের দায়িত্ব ন্যস্ত করতে দ্বিধা করেননা।

ডাক্তারের শেষের তিন সন্তান, দুই মেয়ে আর সবার ছোট ছেলের কাছে, মায়ের পাশে আবদার নেয়ার মত মাবিয়াই একমাত্র মানুষ। ওদের মান অভিমান বা খেলার সাথী প্রায় সবই মাবিয়া। ডাক্তারের সন্তান দের যত্ন নেয়া, স্কুলের কাপড় ঠিক করে দেয়া, সব দায়িত্ব মাবিয়াই নিয়ে নেয়। স্কুলে কোন দিন কোন বই লাগবে জানে, স্কুলের ব্যাগে সঠিক বইগুলো দিয়ে দেয়, অথচ সে সে পড়তে জানেনা । স্কুল থেকে এসে বাচ্চারা কি খাবে সেটাও তারই চিন্তার অংশ হয়ে পড়েছে। পরিবারের সবার জন্যে নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে দিয়েই যেন সে জীবনের এক একটা দিনকে অর্থবহ করে তোলে। ডাক্তার পরিবারের একজন স্নেহ ভাজন সদস্য হয়ে থাকাতেই ওর যেন আনন্দ। ওর জীবন রক্ষা করার কৃতজ্ঞতায় সে যেন প্রতিদিন সবাইকে স্নেহ মমতায় ভরে রাখে।

কোন কোন দিন অলস দুপুরে যখন সবাই বিশ্রামে, আজকের মাবিয়ার বুকের ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে কোথায় তার বুকের ধন কিয়িইন, কোথায় তার বাবা মা, রেঙ্গুন, আজ সবই অতীতের স্মৃতি, সে আর কোনদিনই ফিরে পাবেনা ওদের। সময় আমাদের মনের গভীরতম ক্ষত গুলো ধীরে ধীরে ঢেকে দেয় তাই আমরা জীবনটা চালিয়ে নিতে পারি, তবে ক্ষত গুলো কখনোই সম্পূর্ণ ভাবে চলে যায়না।

আমাদের সাধারণ এর জীবন বলতে বোঝায় কিছু গন্তব্য, কিছু পাওয়া, কিছু তৃপ্তি, সাথে কয়েক ফোঁটা হয়ত দুঃখ। নিয়তি, ভাগ্য, প্রকৃতি যে নামেই ডাকি না কেন, কিছু মানুষ কে সব সুখ থেকে বঞ্চিত করে শুধু দুঃখ দিয়ে এমন পাথর করে তোলে, ওদের আর গন্তব্য বলতে কিছু থাকেনা শুধু বেঁচে থাকার আনন্দই এদের জীবনে পরম প্রাপ্য, এরা হয়ে যায় সম্পুর্ন নিঃস্বার্থ।

সময়ের সাথে ডাক্তার এর ছেলে মেয়েরাও সংসারী হয় ওদেরও সন্তানরা আসে, মাবিয়ার একই দায়িত্ব, সবাইকে স্নেহ ভালবাসায় ভরিয়ে রাখা। এক একটা সন্তান বড় হয়ে নিজেদের সংসার শুরু করে মাবিয়া যেন আবারও উপলব্ধি করে এরা ওর নিজের সন্তান নয় এদের কাছে ওর শুধু দায়িত্বের বন্ধন, নাড়ীর বন্ধন নেই। সময়ের সাথে ডাক্তার এবং ওনার পত্নী বয়সে ভারাক্রান্ত, সংসার এর প্রায় সব কিছুই এখন মাবিয়ার দায়িত্বে, সে এখন ডাক্তার পরিবারের অতন্দ্র প্রহরী শুধু দায়িত্ব আছে, গন্তব্য নেই। ডাক্তার পরিবারের সে যেন এক বাতিঘর।

বেশ রাত হয়েছে, তাই বাতিঘরের পাদদেশ ছেড়ে উঠে পড়ি আবার কোলাহলপূর্ন এই জীবনে আমাকে ফিরে যেতে হবে, মাবিয়ার জীবনের ছোঁয়া, আদরের ছায়া তিরিশ বছর ধরে পেয়েছি। তখনও লেখার সাহস হয়নি, তাই মনের মধ্যে কুলুপ এঁটে লুকিয়ে রেখেছিলাম। বয়সের সাথে সাথে মনের কি যেন একটা পৰিৱৰ্তন হতে শুরু করল, ওর জীবনের কাহিনী না বললে মনটা অশান্তই রয়ে যেত । মাবিয়া কে দাদীর বোন জেনে, বুবু ডেকে বড় হয়েছি, আমার জীবনের অনেক অম্ল মধুর স্মৃতি ওঁর সাথে। খোকা ডাক্তারের সংসারে সাত সন্তান, সতেরো নাতী নাতনীর জীবন মাবিয়ার নিঃস্বার্থ ভালবাসার এক অসামান্য উদাহরন, আমাদের সবার এক বাতিঘর, এর স্নিগ্ধ মায়াময় আলোর বিচ্ছুরন পরিবারের সবার জীবনকে অনেক বছর আলোকিত করে রেখেছিল। ২০০১ সালের জানুয়ারীর শেষ দিন, নিঃস্বার্থতার এই বাতিঘর পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্যে নিভে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক ভিন্ন কাহিনী..ভিন্ন অবয়বে নান্দনিক উপস্থাপনায় সুন্দর এক কহিনী কাব্য...গল্পের জয় হোক....শুভকামনা....
ভালো লাগেনি ৯ জানুয়ারী, ২০১৭
অসম্ভব সুন্দর মন্তব্যের জন্যে প্রাণ ঢালা শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৯ জানুয়ারী, ২০১৭
আহা রুবন পড়ার আগে লেখাটি দেখলাম কতটুকু। ইচ্ছে ছিল এখন অর্ধেকটুকু পড়ব। কিন্তু না লেখার আকর্ষণ শেষ না করে উঠতে দিল না। বিষয় ও বলার ধরন অন্য ধাঁচের। হৃদয়ে হাহাকার জেগে ওঠে, মনে হয় 'থান্ত-সেইঁর' পাশে গিয়ে দাঁড়াই। অসম্ভব ভাল লেগেছে। শুভ কামনা রইল।
ভালো লাগেনি ৫ জানুয়ারী, ২০১৭
খুব সুন্দর মন্তব্য, এমন পাঠক পেলে কার না মন আনন্দে ভরে যায়। আপনার লেখা গুলো পড়ি, সবসময় হয়ত মন্তব্য করা হয়না, খুব সুন্দর লেখেন আপনি তাই অন্য কেও উৎসাহিত করতে চান, খুব ভালো লাগলো।
ভালো লাগেনি ৫ জানুয়ারী, ২০১৭
শামীম খান মাবিয়ার বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া রইল । আপনার লেখা আগেও পড়েছি । সবসময় মন্তব্য ছাপানো হয়না । অসাধারণ লিখেন আপনি । যেখান থেকে যে ভাবে শুরু করেছেন , ভাবছিলাম না জানি কোথায় যেয়ে শেষ হয় । আপনার পাকা লেখনীতে আস্থা বাড়ল আরও । গল্পের কথকতা ভিন্ন স্বাদের । আমার কিন্তু দারুন লেগেছে। মাঝে মাঝে বানান ছুটেছে , এর দায় পুরোটা ফন্টের । শুভ কামনা আর ভালবাসা রইল । ভোট , ৫ এ ৫ ।
ভালো লাগেনি ৪ জানুয়ারী, ২০১৭
অসম্ভব সুন্দর এবং গঠন মূলক মন্তব্যের জন্যে প্রাণ ঢালা শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৪ জানুয়ারী, ২০১৭

২৭ জানুয়ারী - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪