হয়ত তোমারই জন্য

ভালোবাসার গল্প (ফেব্রুয়ারী ২০২০)

Fahmida Bari Bipu
  • ৮৮৭
বন্ধু ফরহাদকে কথা দিয়েছিলাম গল্পটা কাউকে বলবো না।
কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা গেল না। তবে ফলাও করে সবাইকে ডেকে ডেকে বলতে যাচ্ছি না। নিজের ডায়েরির ভাঁজে গল্পটাকে লুকিয়ে রেখে গেলে তো আর ক্ষতি নেই! কে দেখতে আসছে সেটা? আর তাছাড়া কিছু গল্পকে কোথাও না কোথাও রেখে যেতেই হয়। হয়ত আগামী কোনো প্রজন্মের কাছে এটা অনেক দামী কিছুও হয়ে উঠতে পারে।

গল্পটার সূচনা হয়েছিল আমার হাত ধরেই। দেখতে দেখতে প্রায় সাতাশটা বছর হতে চললো। আমাদের তখন কতইবা বয়স! সবে আটাশ। মাত্র কিছুদিন আগে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ফরহাদ একটা প্রাইভেট ব্যাংকে ঢুকেছে। আর আমি ডিএমসি থেকে পাশ করে ইন্টার্নি করছি। নামকা ওয়াস্তে হাতে টাকা পয়সা থাকে। ইন্টার্নিশিপ থেকে যেটুকু পাই, হাত খরচই কুলায় না। সেই তুলনায় ফরহাদের অবস্থা বেশ ভালো। প্রাইভেট ব্যাংকে খাটিয়ে মারে, কিন্তু মাইনে দেয় চোস্ত। মাসের মাঝামাঝি থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত বন্ধুর দ্বারস্থ হই বেশ কয়েকবার। ফরহাদ কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘এই শেষ বলে দিলাম। এর পরে আর ধার দিতে পারবো না!’
আমি সেই সাবধানবাণী মেনে নিই, কিন্তু মনে নিই না। সেটা উড়ে যায় চৈতি বাতাসের শিমুল তুলার মতোই।

আমার ছোটবোন রুমকি’র বিয়েতে বেশ ঝামেলাতেই পড়লাম। এদিকে পকেট গড়ের মাঠ, অথচ ফুটানি মারার ইচ্ছে ষোলআনা। সময়টা নব্বইয়ের মাঝামাঝি। আমাদের সেই সময়ে তো আর স্মার্ট ফোন ছিল না! আমরা নিজেরাই স্মার্ট আউটলুক দিয়ে রমণীকুলের হৃদয়ে তোলপাড় জাগানোর আশায় থাকি। আমার বাড়ির সবার সাথেই ফরহাদের বেশ মিলমিশ। আমার দু’বোনই ‘ফরহাদ ভাই’ বলতে অজ্ঞান। ছোটখাট যেকোন প্রয়োজনেই তারা আমার আগে তাদের ফরহাদ ভাইকে স্মরণ করে। বোনের বান্ধবীরা পর্যন্ত মনে করতো, আমরা দু’ভাই দু’বোন। কার সাথে কেমন সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে, ফরহাদ ঠিক ঠিক তা বুঝে ফেলে। প্রথম দিকে ছেলের বন্ধুকে ঘরে ঢোকাতে মায়ের একটু আধটু আপত্তি যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু ফরহাদ দু’দিনের যাদুমন্ত্রেই সেই আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছে। কীভাবে যে ফরহাদ মানুষকে এত পটিয়ে ফেলতে পারতো, তা আমার মোটা মাথায় কিছুতেই ঢুকতে চাইতো না।
বিয়ের কথাবার্তা চলা থেকেই রুমকি ফরমান জারী করে দিয়েছিল, বিয়ের পুরো সময়টা যাতে ফরহাদ ভাই আমাদের বাসায় এসে থাকেন। বিষয়টা দৃষ্টিকটু। দেশটা ইউরোপ আমেরিকাও নয়। কে কী মনে করবে, এই ভয়টা সবসময়ই মনে কাজ করতো। তাছাড়া রুমকির শশুরবাড়ির লোকজনের কানে গেলে তারা কীভাবে নেবে কে জানে! বিয়ের আগেই একটা গিট্টু বেঁধে গেলে বাকী জীবনে তা আর খোলা যাবে না।
কিন্তু রুমকির অবিচল দাবী শুনে বাবা-মাও আর আপত্তি করলো না। ফরহাদকে তারাও ততদিনে বাড়ির ছেলে বলেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।

ফরহাদ ব্যস্ত চাকুরে। একে তো ব্যাংকের চাকুরিতে নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না, তার ওপরে প্রাইভেট ব্যাংক। পোষালে থাকো, নইলে মানে মানে কেটে পড়।
তবুও ফরহাদ কীভাবে কীভাবে যেন ঠিকই ম্যানেজ করে ফেললো। ম্যানেজারকে পটিয়ে পাটিয়ে সাতদিনের একটা ছুটি বাগিয়ে রুমকির বিয়ের কাজকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বিয়ের কেনাকাটার অনেকাংশের ব্যয়ভার সে বহন করলো। আমি অনেকখানি নিশ্চিন্ত হলাম। বাবা-মাকে কিছুই বুঝতে দিলাম না। ফরহাদই নিষেধ করেছিল। আমার বোনের বিয়েতে আমার বদলে ফরহাদ কেন খরচ করবে, সেই আত্মগ্লানি আমাকে একটুও স্পর্শ করলো না।
ফরহাদের এই নিঃসার্থ ভালোবাসার একটা ক্ষুদ্র মর্মার্থ ছিল। ফরহাদের বাবা-মা বেঁচে ছিলেন না। ভাই-বোন কেউ ছিল বলেও কখনো শুনিনি। কাজেই একেবারে ঝাড়া হাত পা। আমার বাসার সবাইকে আপন করে নিয়ে ও নিজেও হয়ত আনন্দে ছিল। পরিবার না থাকার কষ্টটাকে ভুলে থাকতে পারতো। এমন একটা বোধ থেকেই আমিও তাই অন্যকিছু ভাবনার অবকাশ পেতাম না। অথবা ভাবতে চাইতাম না। কেউ দিয়ে বা করে আনন্দ পেলে আমার আপত্তি কীসে?

রুমকির বিয়ে প্রায় নির্ঝঞ্চাটভাবেই চুকে গেল। ছেলের বাড়ির ছোটখাট ফাইফরমাশ থেকে শুরু করে বড়সড় ইচ্ছেপূরণ কিছুই অপূর্ণ রইলো না।
ছেলের নিজের তেমন দাবীদাওয়া কিছু ছিল না। কিন্তু তার বাবা-মা’র কথা আলাদা। এতদিন ধরে ছেলেকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করতে তাদের যে অনেক খরচাপাতি হয়েছে, সে কথা প্রায় প্রতি মুহূর্তেই তাদের মনে পড়ে যাচ্ছিলো। কথায় কথায় সেই প্রসঙ্গ উঠে আসছিল। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলেও ফরহাদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু শুনছিল। তারপর কীভাবে তাদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছিল, সেই ব্যাপারে বেশিকিছু শুনতে যাইনি। আমার বাবা রিটায়ার করে গিয়েছিলেন। ছেলেকে ডাক্তার বানিয়ে নিশ্চিন্তে বসে ছিলেন। মনে আশা ছিল, আর কিছু না হোক ঐ ডিগ্রী ধুয়েই ছেলে বাকী জীবন পানি খেয়ে নিবে। যৎসামান্য সঞ্চয়ের পুরোটাই দুই মেয়ের বিয়েতে ঢেলে দিয়েছিলেন। ঘাটতি কিছু থেকে গেলেও আর করার কিছু ছিল না। তাই রুমকির বিয়েতে তেমন বড় কোনো ঝামেলা না বাঁধাতেই আমি ভেতরে ভেতরে স্বস্তিতে ছিলাম। কারো হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর মতো অপকর্ম করতে যাবো কোন দুঃখে?
তবে ঝামেলা একটা বেঁধেছিল। আর সেটার দায়ভার কিছুটা আমারই ছিল।

বোনের বিয়েতে সবকিছু সামলে সুমলে নিজের স্টাইল বজায় রাখাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাই গোদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো খরচ বহন করা বটবৃক্ষ বন্ধুকেই পটাতে বসলাম।
‘দোস্ত...চারদিকে কত সুন্দর সুন্দর মেয়েদের মেলা বসেছে! এভাবে ফকিরের মতো থাকলে মেয়েরা পটবে কীভাবে বল?’
ফরহাদ বিজ্ঞতার ভান ধরে বলে,
‘না পটে না পটুক। আর তাছাড়া তোর যে অবস্থা! এখন মেয়ে পটিয়ে খাওয়াবি কী? আগে চাকরি বাকরি ঠিক করে নে। তারপর মেয়ে পটাতে বসিস!’
আমি বুঝলাম এভাবে হবে না। তখন অন্য রাস্তা ধরলাম।
‘আচ্ছা আমার কথা বাদ দে! আসলেই তো এই দীন হীন দশায় মেয়ে পটিয়ে কী করবো? কিন্তু তোর নিজের দিকে তাকা! আটাশ পার হয়ে উনত্রিশও যাই যাই করছে। এখনো একটা ভালো দেখে কাউকে পছন্দ করতে পারলি না! বেলা থাকতে থাকতে বিয়েশাদী ঠিক করে ফেল। নইলে চান্দির খোলা ময়দান জনসমক্ষে খুলে গেলে আর কি কেউ ফিরে তাকাবে?’
ফরহাদ আমার কথায় বিশেষ বিচলিত হলো বলে মনে হলো না। একটা হার্ডলুক দিয়ে শুধু বললো,
‘সেই ভাবনা তোর না ভাবলেও চলবে। নিজের চরকায় তেল দে!’
আমি মরিয়া হয়ে বললাম,
‘দিচ্ছি নিজের চরকায় তেল! শুধু আমার দুঃসম্পর্কের সুন্দরী চাচাতো বোনটাকে দেখে নেহায়েত তোর কথাটা মাথায় এসেছিল... তাই আগ বাড়িয়ে তোর লেকচার শুনতে এলাম!’

নিয়ম হচ্ছে, এই কথা বলে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। সটান কেটে পড়তে হবে। কিছু সময় পরে আবার সুযোগমত বড়শিতে অন্য খাবার গাঁথতে হবে। এর মধ্যে মাছের চিন্তা আর না করলেও চলবে।
কিন্তু কথায় বলে...কাঁচা বয়সের দোলা! সেই দোলায় মন দুলবে না... তা কি কখনো হয়? আমার মাছ টুপ করে বড়শিতে গেঁথে গেল। আমাকে অন্যদিকে ঘুরতে দেখেই ফরহাদ পেছন থেকে ডাক দিলো।
‘এই রাজু শোন! কার কথা বলছিস?’
আমি ভাব নিলাম। অন্যদিকে ঘুরে থেকেই উত্তর দিলাম,
‘সেই খবরে তোর কী? তুই তো সাধু সন্ন্যাসী! মেয়েদের খবর জেনে তোর কোনো লাভ আছে?’
ফরহাদের গলায় অধৈর্যের সুর। চাপা স্বরে বললো,
‘ইয়ার্কি না মেরে দেখা না কার কথা বলছিস!’

সেই থেকে শুরু। মাথায় একজনের চিন্তা ঘুরছিল। তাকেই সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলাম। আমার বাবার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। দেখতে শুনতে চটকদার সুন্দরীই বলা চলে। চাচার বাড়ী রাজশাহী। মাঝে সাঝে ফ্যামিলি নিয়ে ঢাকায় এসে কিছুদিন করে থাকেন। আমাদের বাসায় বেশ কয়েকবার এসে উঠেছেন। আগে থেকেই চাচীর মতিগতি ভালো ঠেকছিল না আমার। আমার দিকে কেমন যেন অন্যরকম চোখে তাকান। ডাক্তারি পাশ করে হয়ত পাত্র হিসেবে নিজের দাম চড়িয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমি তো জানি, আসল কাহিনী! ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট!
তাছাড়া ছোটবেলা থেকে যাকে দেখে এসেছি, তাকে কেন যেন অন্যচোখে দেখাটা আয়ত্ত করে উঠতে পারিনি। নিজের বোনের সাথে তার তফাতটা খুব একটা বেশি বলে মনে হয়নি কখনো।
কিন্তু ফরহাদের মতো ভালো একটা ছেলের সাথে ঝুলিয়ে দিতে পারলে বোনটার আমার ভালোরকম গতি হয়ে যায়। সেই চিন্তা থেকেই একটা অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলাম। ঢিল বোঝা যাচ্ছে আসল বাড়ির আঙ্গিনাতে গিয়েই পড়েছে। এখন বাড়ির মালিক দুয়ারটা খুলে দিলেই কেল্লা ফতে!

আমার চাচাতো বোনের নাম রুমানা। ঠিক যেন লজ্জাবতী লতা। সামান্য একটু ঘায়েই মুর্ছা যায় এমন অবস্থা। ফরহাদকে ফাঁকতাল বুঝে নিয়ে দেখাসাক্ষাৎ করিয়ে আনলাম। আলাপ পরিচয়ের পর্বটা আমার সামনেই সমাধা হলো। রুমানা মোমের মতো গলে গলে পড়তে লাগলো। ওদিকে ফরহাদের চেহারাতেও ঘোর ঘনাতে দেখলাম। ঘনাবে না? কাজিনটা কার সেটাও তো দেখার বিষয়!
তবু ফরহাদকে নিয়ে কিছুটা চিন্তায় ছিলাম। মানুষ পটাতে পটাতে একদেখাতেই মানুষের নাড়ি নক্ষত্র বুঝে বসা মানুষ। এমন মানুষকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে কাবু করা সহজ কম্মো নয়। কিন্তু এত সহজেই সেই কম্মোকে কিমা বানাতে পেরে আমি একেবারে সুখের সাগরে হামাগুড়ি দিতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম... ‘বাছাধন এইবার ফাঁদে পা দিয়েছো! আগামী বেশ কয়েকটা বছর তোমার পকেট রইলো আমার জিম্মায়!’

রুমানা আর ফরহাদের ভাব ভালোবাসা জমে যেতে সময় লাগলো না।
রুমানা রাজশাহী চলে যাওয়ার পরে দুজন দুজনকে পত্রাঘাত করে যেতে লাগলো। ফরহাদ মারফত খবর সবই আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছাতো। দুই লাভবার্ডকে মিলিয়ে দিয়ে আমি দূরে বসে মজা দেখতাম। তবে আমার উদ্দেশ্য সত্যিই শতভাগ সফল হয়েছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ফরহাদ নিজে থেকেই আমার প্রয়োজনের দিকে ইদানিং বেশিমাত্রায় খেয়াল রাখে।
দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। খাই দাই আর বন্ধুর টাকায় ফুটানি করি। এদিকে একটা একটা করে তিন তিনটা বছর পার হয়ে গেল। ইন্টার্নিশীপের স্ট্রাগল শেষ করে বিসিএস দিয়ে অবশেষে চাকরিতে ঢুকে পড়লাম। নিশ্চিন্ত জীবনে কেমন একটা যতিচিহ্ন পড়ে গেল। মা কানের কাছে দিনরাত ঘ্যান ঘ্যান করে,
‘এবারে বিয়েটা করে আমাকে উদ্ধার কর!’
চাকরির বাঁধাধরা নিয়মে পড়ে আমার তখন হাঁসফাঁস অবস্থা। আমিও উদ্ধার পাবার জন্য আকুলিবিকুলি করি। কিন্তু সেকথা তো আর মুখ ফুটে বলা যায় না!
ওদিকে ফরহাদও তখন নিজের সানাই বাজিয়ে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। মাথার চান্দি ফাঁকা হতে আর বেশিদিন লাগবে না। রুমানাও গতমাসে ইউনিভার্সিটির শেষ ধাপ পার করে ফেলেছে। যেকোন দিন তার বাসা থেকে তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে। কাজেই বসে থাকার আর সময় নেই।

একদিন ইনিয়ে বিনিয়ে ফরহাদ মনের কথা পেড়ে ফেললো।
‘বন্ধু, এবারে তো আসল কাজটা করে দিতে হয়!’
আমি নাদানের ভাব ধরে বললাম,
‘বেশ তো কাজই করছিস এদ্দিন ধরে। আসল কাজ আর কী বাকি আছে তোর?’
‘রুমানা এখনো বাসাতে কিছু জানাতে পারেনি। তুই যদি একটু সবকিছু ঠিকঠাক করে দিতি...ইয়ে মানে...খরচাপাতি যা লাগে...সেসব নিয়ে একদম ভাববি না!’
আমি মনে মনে রুমানাকে গালমন্দ করলাম। এতদিনেও নিজের মা টাকে দলে ভেড়াতে পারেনি। তিনি যদি অন্য নৌকায় তরী ভিড়িয়ে বসে থাকেন...তাহলে কী হবে?

আমার পোড়ামনের ভাবনাই কাল হলো। রুমানার মা অর্থাৎ আমার চাচী শেষমেষ নিজের মেয়ের জন্য ডাক্তার পাত্রেরই শরণাপন্ন হলেন। আর সেই ডাক্তার পাত্র হলাম আমি স্বয়ং। মুখ শুকিয়ে চুন হলো। নিজের হাতে যে চারাগাছ বুনে দিয়েছি, এখন কী না সেই চারাগাছই উপড়ে ফেলবো! এত বড় পাষণ্ড আমি হই কীভাবে?
চাচীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করলাম। তার মুখের দিকে চেয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। থমথমে মুখে বললেন,
‘ওহ...তাহলে বড় কাজ তো নিজেই শেষ করে বসে আছে! বাবা-মা’র আর দরকারটা কীসে?’

এরপর কিছুদিন আর এই ঝামেলায় ঢুকলাম না। গা বাঁচিয়েই চলতে লাগলাম। ঝড়ঝাপ্টা কিছুদিন ঐদিকেই বয়ে যাক।
ফরহাদেরও খোঁজ নিই না। যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে এটা সেটা বলে কাটিয়ে যেতে থাকি। ঘটকালির প্রাথমিক কাজ শেষ করে দিয়েছি। এখন বাকিটুকু নিজেরা ঠিক করে নিক!
অবশেষে ভালো খবরই শুনলাম। চাচী ফরহাদ আর রুমানার সম্পর্ক মেনে নিয়েছেন। বিয়ের সানাই বাজতে আর কোনো বাধা নেই। ঘটা করে ফরহাদই এসে জানিয়ে গেল সেই খবর। এবারে যেন আর সুড়ুৎ করে পালাতে না পারি, সেজন্য আমার বাসায় এসে ঘাপ্টি মেরে বসে ছিল। চোখেমুখে ঝলমলে খুশি ছড়াতে ছড়াতে বললো,
‘তুই ঠিক করে দিলি। অথচ তোকেই খবরটা দিতে পারছিলাম না। রুমানার বাসা থেকে সম্মতি জানিয়েছে!’
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। খুশি হওয়ার মতোই খবর বটে! চাচী অবশেষে ডাক্তার পাত্রের আশা জলাঞ্জলী দিতে পেরেছেন!

নিজের বিয়ের কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফরহাদ। রুমানা লম্বা লম্বা চিঠিতে নিজের পছন্দ অপছন্দ জানায়। ফরহাদ হবু বউয়ের ফরমাশ মিটাতে দিনরাত পরিশ্রম করে। বেচারার জন্য মায়াই লাগে আমার। যে কাজ নিজের মা-বাবা ভাই-বোন মিলে করবে সেটা কী না নিজেকেই করতে হচ্ছে! তবু ওর চোখমুখের খুশির ঝলকটা ভালো লাগে। মনে মনে বলি... ‘বন্ধু চিরকাল এমনই থাকিস!’
এর মাঝেই একদিন বিনামেঘে বজ্রপাত হলো।
আচমকা বিনা নোটিশে চাচী চলে এলেন ঢাকায়, আমাদের বাসায়। আমাকে সোজাসুজি তলব করে বললেন,
‘ফরহাদের বাবা-মাকে তো আমি চিনি! ওর দাদাবাড়ি পাবনায়। আমার বাপের বাড়িও পাবনায়। ভালোভাবে ঘাঁটতেই সব সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলো। ভাগ্যিস খবরটা নিয়েছিলাম। কত বড় একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছিলো!’

শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনায় সব আদ্যোপান্ত শুনলাম। সেই ইতিহাস শুনলাম যা আমি নিজেও জানতাম না। হয়ত আমার জানার কোনো প্রয়োজনও ছিল না।
ফরহাদের পরিবারে এক অদ্ভুত অসুখ ছিল। শেষ বয়সে এই পরিবারের ছেলেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। ফরহাদের দাদার বাবা তার পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বহু চেষ্টাতেও আর ফিরে আসেননি। ফরহাদের দাদা আর বাবারও একই পরিণতি। কোনো এক অজানা কারণে এই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ঘরের মায়ায় আটকে থাকতে পারে না। ঘর কেটে বেরিয়ে যায়।
চাচী বিস্ফোরিত মুখে বললেন,
‘সব জেনেশুনে তুই আমার মেয়ের এই সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলি রাজু! কেন? আমি কি নিজের মেয়েকে তোর ঘাড়ে ঝুলাতে উঠে পড়ে লেগেছিলাম?’

ফরহাদ সেদিনই সব জানতে পারলো। আমিই জানালাম।
প্রত্যুত্তর আশা করিনি... পাইনিও। জানতাম ওর কিছুই বলার নেই। চাচীকে আমি চিনতাম। যখন কারো পেছনে লাগে, তার জ্ঞাতিগুষ্টির খবর বের করে ছাড়ে। কোনো অপ্রিয় সত্যকে সামনে আনতে তার সত্যিই জুড়ি মেলা ভার। রুমানার মতো শান্তশিষ্ট মেয়ের মা তিনি, এটা মানতে আমার নিজেরও মাঝে মাঝে কষ্ট হতো। কেমন এক অজানা রাগ জন্মালো ফরহাদের প্রতি। আমাকে এসব আগে জানালে ওর কী ক্ষতি হতো!
সবাইকে অন্ধকারে রেখেই ফরহাদ চলে গেল। চাকরি ছেড়ে দিয়ে...শহর ছেড়ে দিয়ে। মনে মনে ভাবলাম, রুমানাকে বিয়ে করে হয়ত পারিবারিক ঘোর অমনিশাকে ভাঙতে চেয়েছিল আমার বন্ধু। কিন্তু বিধাতার বুঝি তা ইচ্ছে ছিল না। হয়ত এভাবেই সবাই মিলে ওর ঘর বাঁধার ইচ্ছেটা চিরতরে ঘুঁচিয়ে দিয়ে গেল।

ফরহাদকে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। শুধু আমি কেন, আমরা কেউই ওকে মনে রাখিনি। আমাদের বাসায় নিত্য আসা যাওয়া করা সেই মানুষটাকে আমরা কত তাড়াতাড়ি পুরনো ডায়েরীর মতোই আলমারির ভাঁজে লুকিয়ে ফেলে দিলাম! মাঝে মাঝে পাতা উল্টানোর ছলে একটু আধটু মনে পড়তো। কিন্তু সেভাবে আর ঘন আঁচড় পড়তো কই? বর্তমান নিয়ে মেতে থাকা এই জীবনে আমরা অতীতকে খুব সহজেই ভুলে যাই।
ফরহাদ সেদিনের পর কারো সাথে আর কোনো যোগাযোগ করেনি। আমার সাথে করেনি। রুমানার সাথে করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
এর কয়েকমাস পরেই বাসার ড্রইংরুমের টেবিলে সোনালী লাল কালিতে লেখা একটা বিয়ের কার্ড পেলাম। রুমানা ওয়েডস... নাহ্‌! ফরহাদ না! অন্য কোনো নাম। অপরিচিত কেউ। আমার অপরিচিত। রুমানারও নিশ্চয়ই। অথচ এখন এই অপরিচিত মানুষটাই রুমানার সমস্ত সত্ত্বার অংশীদার হয়ে যাবে। আমার কোনোরকম ঈর্ষার জ্বালা অনুভূত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তবুও... বন্ধু ফরহাদের হয়ে সেই সূক্ষ্ণ জ্বালায় আমিও কিছুক্ষণের জন্য পুড়লাম।

এরপরে অনেকগুলো বছর হেসেখেলে পার হয়ে গেল।
দিনে দিনে ব্যস্ত পেশাজীবী হয়ে উঠলাম। হাসপাতাল থেকে ফিরে রাতে ক্লিনিকে গিয়ে বসি। আস্তে আস্তে কোমর স্ফীত হয়ে গেল। মাথার ওপরের ঘন শালবন সত্যি সত্যি অবশেষে শীতের কবলে পড়ে গেল। এতদিনে বুঝি তাদের পাতাঝরার দিন ঘনিয়ে এসেছে!
ছেলেমেয়ে দুটোকে নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠাই। বউ সোশ্যাল ওয়ার্ক করে বেড়ায়। ফেসবুক, পার্লার এসব তো আছেই! বাচ্চাদের পেছনেও দৌড়ঝাঁপ কম হয় না। দিনেমানে কথা বলারই সময় পাই না আমরা। মাঝে মাঝে শুধু টাকা পয়সায় টান পড়লে আমাদের দীর্ঘ বাক্য বিনিময় হয়।
চাচা চাচীর অনেক বয়স হয়েছে। তবু এখনো মাঝে মাঝে ঢাকায় এলে আমাদের বাসায় এসে ঘুরে যান। দিন দুয়েক থাকেন। রুমানার ছেলেটা কেমন ডানপিটে হয়েছে সেই গল্প শোনান। কখনো ভুলেও কোনো দীর্ঘবিস্মৃত নাম উচ্চারিত হয় না। অনুচ্চারিত সেই নাম অনাদরেই লুকিয়ে থাকে।
তবে রুমানার সংসার নিয়ে আলগোছে কিছুটা দুশ্চিন্তার কথাও শুনিয়ে গেলেন একবার এসে। রুমানার শশুরের যে ফ্ল্যাটটা ওর জামাইয়ের নামে আছে সেটা নাকি ব্যাংক লোন নিয়ে করা হয়েছিল। রুমানার শশুরের মৃত্যুর পর সেই ব্যাংক লোনের ইন্টারেস্ট আর দেওয়া হয়নি। এখন সেটা বাড়তে বাড়তে প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। রুমানার ব্যবসায়ী স্বামীর ব্যবসাও মন্দা যাচ্ছে। যেকোন দিন ব্যাংক থেকে চিঠি চলে আসতে পারে। কথাগুলো বলতে বলতে দুঃশ্চিন্তার ঘন ছায়া খেলা করতে লাগলো চাচা-চাচীর মুখ জুড়ে। শুনে খারাপ লেগেছিল। কিন্তু ভুলে যাওয়ার অভ্যাসে এটাকেও স্বচ্ছন্দে ভুলে গেছি একসময়।

রোজকার অভ্যস্ততায় ক্যালেণ্ডারের পাতাগুলো উল্টে চলি জীবনের চলমান ছন্দে। আরো কয়েকটি বছর গেল। একদিন নিজের চেম্বারে বসে রোগীর অপেক্ষা করছি। পর্দা সরিয়ে কিছুক্ষণ পরে যাকে ঢুকতে দেখলাম, তাকে দেখে হৃৎস্পন্দন আটকে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ফরহাদ! প্রায় একই রকমই আছে। দৃশ্যমান তেমন পরিবর্তন নেই। আমাকে দেখে একগাল হেসে বললো,
‘কী রে...মাথার ময়দান কার খালি হলো আগে? এ কী অবস্থা হয়েছে বন্ধু! খুব বড় ডাক্তার হয়েছিস তাহলে!’
আমার কথা জড়িয়ে যেতে লাগলো। এলোমেলো স্বরে বললাম,
‘এদ্দিন পরে এলি! কই ছিলি এতদিন! একটাও খবর দিসনি!’
‘তুইও তো চেষ্টা করিসনি! আমি তো আশেপাশেই ছিলাম। শুধু নিজ থেকে এসে দেখা দিইনি এই যা!’
আমার মাথানীচু হলো। এই অভিযোগ তো মিথ্যে নয়! কীসের অজানা অভিমানে আমিও তো বন্ধুকে ভুলেই গিয়েছিলাম!
ফরহাদ আমার অপ্রস্তত ভাবকে পাত্তা না দিয়ে বললো,
‘একটা কাজে এসেছি। আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। পারবি না?’

এরও প্রায় বছর খানেক পরে ফরহাদ আরেকবার বিদায় নিল আমার কাছ থেকে। আগেরবার না বলেই চলে গিয়েছিল। এবারে ঘটা করে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে বলে গেল,
‘এবারে সত্যি সত্যিই নিরুদ্দেশ হলাম রে। আর খোঁজ খবর পাবি বলে মনে হচ্ছে না। রক্তের নেশাটা এবারে যেন আমাকেও ডাকছে। এতদিন কিছু একটা দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম বোঝা যাচ্ছে! হাহ হা হা...’
সেই আমার শেষ দেখা ফরহাদের সাথে। এরপর আর সত্যি সত্যিই ওর কোনো দেখা পাইনি। কোথায় আছে...কী করছে...কিছুই বলে যায়নি। ওর চোখেমুখে একটা প্রচ্ছন্ন অনুনয় দেখেছিলাম। সেই অনুনয়ের দায়েই আমি এবারেও খোঁজ নেওয়া থেকে বিরত ছিলাম।

রুমানার মা’র সাথে মাঝে একবার কথা হলো। চাচী ফোন করেছিলেন। গলার সুরে উচ্ছ্বাস। আমাকে শুনিয়েও কেন যেন খুব আনন্দ পাচ্ছিলেন।
‘বুঝলি রে রাজু... আমি হীরা চিনতে ভুল করিনি। রুমানার জন্য সত্যিকারের হীরা খুঁজে এনেছিলাম। ওর জামাইয়ের কথা বলছি রে! এত এলেমদার ছেলে... ওত বড় ব্যাংকের ঝুট ঝামেলা কীভাবে কীভাবে সব মিটিয়ে ফেললো! কোথায় থেকে এক বিদেশে থাকা লোকের কাছে নামমাত্র কাগজপত্রে ফ্ল্যাটটাকে বিক্রি করে দিল। ব্যাংকের সব ঝামেলা ঐ প্রবাসীই মিটিয়েছে। খালি যে মিটিয়েছে তাই না। যাওয়ার আগে জামাইয়ের কাছে কাকুতি মিনতি করে সেই ফ্ল্যাটই আবার বিক্রি করে গেছে...তাও আবার নাম কা ওয়াস্তা দামে! আর নাকি দেশে থাকবে না। এত ঝামেলা দেখে ঘাবড়ায়ে গেছে। কোনো খরিদ্দার না পেয়ে যার কাছ থেকে কিনেছে তাকেই বিক্রি করে গেছে। জামাই বাবাজি এমন সুযোগ ছাড়বে কেন? লোন টোন সব চুকে গেছে। কত টাকা না জানি গচ্চা গেছে সেই প্রবাসী লোকটার! এমন গাধাও মানুষ হয় বল?’

চাচীর কথা শুনে হেসেছি। আসলেই এমন গাধাও মানুষ হয়? নিজের সারাজীবনের সমস্ত সঞ্চয়...মেধা এভাবে কারো ঘর বাঁচানোর পেছনে কেউ খাটায়?
যার নিজের ঘরের কোনো টান নেই...হয়ত তার পক্ষেই এমনটা সম্ভব!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Neerob ভালো গল্প। ভোট রইল।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ভালোবাসার জন্য কেউ মরুভূমি পাড়ি দেয়। কেউ সাগর সেঁচে মুক্তো তোলে। কেউ প্রগাঢ় মমতায় কারো হাত ধরে রাখে...আজীবন। কিছুতেই ছুটতে দেয় না সেই হাত। গল্পটি ভালোবাসার সেই মমতাময় সংসর্গকে ঘিরেই লেখা হয়েছে।

০১ ডিসেম্বর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৬৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪