মোট ভোট ১১৪ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৬.৫৯
  • ৫৪
  • ১১
  • ১৬
১.
আধসের পটল কেনার পর ফকিরচান হঠাৎ খেয়াল করলেন ঝিনুকটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। ফকিরচান কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করলেন। হাতের মুঠোয় পটলের ব্যাগটা ধরা। পটলওয়ালা সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে।

ফকিরচানের মুখটা তেতো হয়ে গেছে, এরমাঝেই তিনি একটু হাসার চেষ্টা করলেন।

- ট্যাকা দেননা কেন?

পটলওয়ালার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি শক্ত, গলার স্বর রুক্ষ।

- খাড়াও মিয়া, আমার মেয়েটা মনে হয় ডিম কিনতে গেছে, এখনই চইল্যা আসবো।

পটলওয়ালার সন্দেহ আরও গাঢ় হলো, তবে মুখে আর কিছু বললো না।

কিছুক্ষণ পর বাজারে ঢোকার মুখটায় ঝিনুকের দেখা পাওয়া গেল। একহাতে ডিমের পোটলা আরেকহাতে দুটো জিলিপি নিয়ে ধেইধেই করে নাচতে নাচতে আসছে।

ফকিরচানের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। ইচ্ছে করে মেয়েটার গালে জোরসে একটা চড় বসিয়ে দেন! কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি নিজেকে সংবরণ করলেন। ঝিনুকের বয়স বারো, দেখতে আরও বেশি মনে হয়। এ বয়সী মেয়ের গায়ে যখন-তখন হাত তোলা যায় না।

- কই গেছিলি?

- ডিম কিনতে গেছিলাম।

- বলে যাবিনা! জিলাপী কই পাইছোস?

- রঞ্জু ভাই দিছে।

‘রঞ্জু ভাই’ লোকটা কে- ফকিরচান তা জানেন না। ঘরে যুবতী মেয়ে থাকলে পাড়ার ছেলেরা এক-আধটু মনোযোগ দেবেই। ঘরে তিন তিনটা সোমত্ত মেয়ে। তিনজনই কমবেশি সুন্দরী। ফকিরচান একবার ভাবলেন মেয়েটাকে উপদেশমূলক দুই-একটা কথা বলবেন।

ঝিনুক ততোক্ষণে জিলীপি দুটো খেয়ে ফেলে হাতের তেলো চাটতে শুরু করেছে। ফকিরচানের এই মেয়েটির বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুটা কম। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে পটলওয়ালার টাকা পরিশোধ করে দিলেন।


২.
বাজার থেকে ফেরার পথে নিতাইয়ের সাথে দেখা, নিতাইয়ের মুখটা বেশ খুশিখুশি।

- কিরে ঘোষাইল্যা! যাস কই?

- তোমারেই খুঁজতেছিলাম দাদা। ভালো খবর আছে। একটা ভালো জিনিসের খবর পাইছি। বিলীতি জিনিস। স্কচ... সাড়ে চার দিলেই পাওয়া যাবে। তুমি যদি হাফ দাও- আমি তাহলে হাফ দিতে পারি।

ফকিরচানের মুখ দপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। মদের পেছনে দুই হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ্য ফকিরচানের নেই। নিতাইও ব্যাপারটা জানে।

- ঠিক আছে গুরু, তুমি তাহলে দেখো এক জোগাড় করতে পারো কি না! আর যদি কিছুই ম্যানেজ করতে না পারো তাহলেও সমস্যা নাই। আমি ব্যবস্থা করতাছি। বেস্পতিবার রাতে রেডি থাইকো। আমি তোমারে নিয়া যামু।

বোকা মেয়েটা পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। দুই বন্ধুর কথোপকথন শুনে তার চেহারায় কোন ভাবান্তর হয় না।

নিতাই একটা গানের সুর ভাজতে ভাজতে চলে যায়। ফকিরচান সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন। নিতাইয়ের হাঁটার মাঝে একটা ছন্দ আছে। কিছুক্ষণ পরপর মনের আনন্দে মাথা ঝাকাচ্ছে।

নিতাইয়ের বয়স আটচল্লিশ। বাজারে দুটো দোকান আছে, টাকাপয়সার চিন্তা নেই। চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক, অঙ্গসঞ্চালন পঁয়ত্রিশ বছরের যুবকদের মতো।

ফকিরচান নিতাইয়ের চেয়ে দুই-তিন বছরের বড় হবেন। অথচ তাকে এখনই পঁয়ষট্টি বছরের বুড়োর মতো দেখায়।

ফকিরচান খুব ভালো করেই জানেন- তিনি যদি টাকার ব্যবস্থা করতে না পারেন, তবে নিতাই কখনোই তাকে ফ্রি খাওয়াবে না। বৃহস্পতিবার সে অন্য ইয়ার-বক্সীদের নিয়ে আসর বসাবে।

অথচ একসময় তিনি দিনের পর দিন নিতাইয়ের খরচ টেনেছেন। আজকের এই বুড়ো-অথর্ব ফকিরচানই একদিন নিতাই ঘোষালকে তবলা বাজানো শিখিয়েছিলেন। এই ফকিরচানের সুপারিশের জোরেই নিতাই একদিন যাত্রাদলের জুনিয়র তবলচীর চাকরিটি পেয়েছিল।

ফকিরচান জাত এবং তাল দুটোতেই মাতাল ছিলেন। সে তুলনায় নিতাই তালের ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিল। খুব শীঘ্রই সে দলে ফকিরচানের জায়গাটি দখল করে নেয়।

তাতে অবশ্য ফকিরচানের খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তিনি নিজেও কি ওই জায়গাটি নিতাইকে ছেড়ে দেননি! খেয়ালী বেতাল ফকিরচান জীবনে কোন কাজই খুব বেশি দিন করতে পারেননি।

যাত্রাদলের হয়ে কিছুদিন তবলা বাজানোর পর ফকিরচানের মনে হলো- তিনি তবলার সবকিছু শিখে ফেলেছেন। এই ক্ষেত্রটিতে তার আর উন্নতি করার কোন সুযোগ নেই। এরপর থেকে তার আর তবলা বাজাতে ভালো লাগতো না। মনে হত তিনি যেন বসে বসে ক্রমাগতভাবে মহাসমুদ্রের ঢেউ গুনে যাচ্ছেন- যার কোন শেষ নেই।

তবলার পাটটুকু চুকে যাবার পর ফকিরচান ঝুঁকলেন বাঁশির দিকে। বাঁশি জিনিসটি দেখতে সাধাসিধে ধরনের হলেও এটি বাজানোর জন্য প্রচণ্ড রকমের শারীরিক সক্ষমতা ও দক্ষতার প্রয়োজন। অপরিমিত জীবনযাপন আর অনাচারের কারণে ফকিরচানের শরীর ততোদিনে ভেঙ্গে গেছে।

বাঁশি বাজানোর কাজেও ফকিরচান খুব বেশি সুবিধা করতে পারলেন না। যৌবনে ফকিরচান বেশ সুদর্শন ছিলেন। দুই-একবার চেষ্টা করেছিলেন যাত্রা মঞ্চে অভিনয় করতে। অনুশীলনে তিনি কোনরকমে উৎরে গেলেও মঞ্চে তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হলেন। একদঙ্গল দর্শক তার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে- এটা দেখলেই তিনি নার্ভাস হয়ে যেতেন, তার ডায়ালগ এদিক-সেদিক হয়ে যেত।

অভিনয়, তবলা, বাঁশি- একেরপর এক ব্যর্থতা সত্ত্বেও তিনি যাত্রাদলটির সাথে লেগে থাকলেন। যাত্রাদলের মালিক একসময় তাকে ম্যানেজারের কাজে লাগিয়ে দিলেন।

তবলা-বাঁশিতে ব্যর্থ হলেও ফকিরচান মনেপ্রাণে নিজেকে একজন শিল্পী ভাবতেন। যাত্রাদলের ম্যানেজারের আটটা-দশটা গৎবাঁধা চাকরি তার ভালো লাগবে কেন!

এতো ব্যর্থতা সত্ত্বেও ফকিরচান কখনো হতোদ্যম হননি। এই পৃথিবীর বুকে যতো বিখ্যাত ব্যক্তির জন্ম হয়েছে- তাদের কেউই সরাসরি বিখ্যাত হয়ে যাননি, প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের সবাইকেই কমবেশি ব্যর্থতা মেনে নিতে হয়েছে, উপহাস টিটকারি সহ্য করতে হয়েছে।

ফকিরচান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন একদিন তিনি সফল হবেনই। তবে সেই সফলতা ঠিক কোন পথে আসবে- সে ব্যাপারে তার সুনির্দিষ্ট কোন ধারণা ছিল না।

জগতে কত বিচিত্র ঘটনাই তো ঘটে, ফকিরচানেরও হয়তো সম্ভাবনা ছিল জগদ্বিখ্যাত কেউ হয়ে যাবার। নিজের শিল্পীসত্ত্বা সম্পর্কে তার যে ধারণা- সেটা হয়তোবা মিথ্যা ছিল না। তবে জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিখ্যাত হবার প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে ফকিরচানের কিছু ভ্রান্তি ছিল- বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউই তাদের প্রাথমিক ব্যর্থতার পর হাল ছেড়ে দেননি। ক্রমাগত তার চেষ্টা করে গেছেন। অবিরাম, ক্লান্তিহীন ঘর্ষণের পর নেচে উঠেছে স্ফুলিং।

আর যারা সে চেষ্টাটি না করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন- তাদের কথা আর কেউ স্মরণ রাখেনি। ধীরে ধীরে তারা ডুবে গেছে তরল আঁধারে, জুয়ার আসর কিংবা আস্তাকুঁড়েতে।
ব্যর্থ শিল্পীর চিরাচরিত ফর্মুলাটি অনুসরণ করে ফকিরচান দীর্ঘদিন ডুবে ছিলেন মদের নেশায়... জুয়ার আসরে। প্রক্রিয়ার শেষ ধাপটি অনুসরণ করে হয়তো পতিত হতেন আস্তাকুঁড়েতে। কিন্তু সেটা হল না... কিংবা বলা যায় হতে দিলো না ফকিরচানের ছেলে দুলাল।

দুলালের প্রসঙ্গে আমরা পরে আসবো, আপাতত ফকিরচানের অতীত জীবনের ব্যর্থতার পাণ্ডুলিপিটি সম্পূর্ণ করা যাক।

যাত্রাদলের ম্যানেজারের চাকরিটি ছেড়ে দেবার পর ফকিরচান ভাবলেন- নতুন কিছু করা দরকার। ততোদিনে তিনি দু’তিনটি সন্তানের জনক হয়েছেন।

ফকিরচানের স্ত্রী জুলেখা নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করে কোনরকমে সংসারটা টিকিয়ে রেখেছিলেন। দিনের পর দিন স্ত্রীর উপার্জিত অন্ন ধ্বংস করতে করতে একসময় ফকিরচান বিরক্ত হয়ে গেলেন।

জুয়ার আসরে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেকদিন হয়েছে, আকণ্ঠ ঋণে নিমজ্জিত ফকিরচানের ঘরে থাকাই দায়। দিনরাত পাওনাদারদের অবিরত আনাগোনা, তার উপর স্ত্রীর মুখ ঝামটা... গঞ্জনা।

ফকিরচান অতঃপর ঝুঁকলেন ব্যবসার দিকে। পাইকারদের থেকে বাঁশি কিনে তিনি আসন পেতে বসলেন বাজারের এককোণে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাটুরেরা দুই-একটা বাঁশি কিনলো প্রথম প্রথম। তারপর বেচা-বিক্রি একদম বন্ধ। ফকিরচান বাঁশিও ভালো বাজাতে পারেন না।

বিষয়বুদ্ধিহীন ফকিরচানের জীবনের ব্যবসায়িক অধ্যায়টিরও পরিসমাপ্তি ঘটলো।


৩.
চৌরাস্তার মুখটাতে আসতে না আসতেই ইমাম ঈদ্রিস আলির সাথে দেখা। ঈদ্রিস আলির বয়স এখনো চল্লিশ পেরোয়নি। হন্তদন্ত হয়ে তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন।

- আসসালামু আলাইকুম মিয়াভাই।

ফকিরচানের মুখটি নির্বিকার, সালামের প্রতিউত্তরে তিনি কিছু বললেন না।

- মিয়াভাই কেমন আছেন?

ফকিরচান নিরুত্তর।

- পীরগঞ্জে একটা মাহফিল আছে মিয়াভাই। খুব ব্যস্ত।

ফকিরচান যথারীতি নিরুত্তর।

- ঠিক আছে মিয়াভাই... আসি তাহলে। দু’আ কইরেন আমার জন্য।

রাস্তার ওপারে একটা বাস চলে যাচ্ছিল, ঈদ্রিস আলি বেপরোয়াভাবে তাতে ঝুলে পড়েন। ঝিনুক বাজারের ব্যাগটা হাতে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়।

ফকিরচান বাড়ির সামনের মজা পুকুরটার ঘাটে চুপচাপ বসে থাকেন। কচুরিপানা, আবর্জনায় পুকুরটা প্রায় ভরে গেছে, পিনপিন করে এক দঙ্গল মশা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সেদিকে তাকিয়ে ফকিরচান মাওলানা ঈদ্রিস আলির কথা কিছুক্ষণ ভাবেন।

ঈদ্রিস আলির ব্যাপারস্যাপার ফকিরচানের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য। ফকিরচান বড়ই অকিঞ্চিৎকর একজন মানুষ। কারও কাছেই তিনি পাত্তা পান না। তার স্ত্রী বাজার সদাইয়ের টাকাটা পর্যন্ত তার হাতে না দিয়ে ঝিনুকের হাতে দেন।

সেই ফকিরচানকে নিয়ে ঈদ্রিস আলির এতো আদিখ্যেতা কেন! দেখা হলে সবসময় ঈদ্রিস আলি এগিয়ে আসেন, কুশল জানতে চান, মিয়াভাই বলে আহ্লাদ করেন।

ঈদ্রিস আলি কখনও তাকে মসজিদে যেতে বলে না, নামাজ পড়তে বলে না। শুধু বলে- “দোয়া করবেন... প্রাণভরে দোয়া করবেন। যেদিন একদম প্রাণ খুলে দু’আ করতে পারবেন, সেদিন দেখবেন- বুকের ভেতরটা একদম শান্ত হয়ে গেছে।”

ফকিরচানের মুখটা হঠাৎ বিকৃত হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বলে উঠেন-

- দোয়া মারাইতে আসোছ... শালা বাইঞ্চোৎ!

সূর্যটা ধীরে ধীরে মাঝ গগণে উঠে আসে। পরিত্যক্ত পুকুরের নির্জন ঘাটে বসে ফকিরচান আকাশ পাতাল ভেবে চলেন।


৪.
দুলালের সাইকেলটা ক্রমাগত মটমট করছিল। বেড়িবাঁধের আগের ভাঙ্গাচোরা রাস্তাটিতে ওঠা মাত্র দুর্বল-জীর্ণ চাকা দুটো এদিক-সেদিক পিছলাতে শুরু করে। লক্করঝক্কর সাইকেলটার প্যাডেল নেই, ব্রেকও কাজ করে না অনেকদিন হল। দুলালের অবশ্য ব্রেক-প্যাডেলের প্রয়োজন হয় না। পাত্থুরে শক্ত দুটি হাতে ঠেলে ঠেলে সে বেশ কাজ চালিয়ে নেয়।

বেড়িবাঁধের নীচটায় এসে দুলাল এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। বাঁশের টুকরিতে বেঁধে রাখা থালা-বাসন-ডিনার সেটের বিশাল পর্বতসমেত পুরোনো সাইকেলটা নিয়ে বেড়িবাঁধ পার হবার পরিকল্পনাটি বিপজ্জনক হতে পারে।

দুলাল দক্ষ হাতে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাঁধা বিশাল বোঝাটা খুলে ফেলে। তারপর সাইকেলটা একপাশে শুইয়ে রেখে বোঝাটা মাথায় তুলে নেয়।
প্রচণ্ড চাপে দুলালের ঘাড়টা লটরপটর করতে থাকে। এতো বড় বোঝা বাসের ছাদ থেকে নামানোর সময়ও কম শোরগোল হয়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে মন্টু বলেছিল- “আমারে পঞ্চাশ টাকা দিয়েন দুলাল ভাই, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায় দিয়া আসমু।”

দুলাল সায় দেয়নি, পঞ্চাশ টাকা তার জন্য অনেক কিছু।

দুলাল তাড়াহুড়ো করলো না। আস্তে-ধীরে সে বাঁধ বেয়ে উঠতে থাকে। বিপত্তিটা ঘটলো নামার সময়। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় দুলালের পায়ের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেল। রবার সোলের পুরোনো স্যান্ডেলটার নাক ছিঁড়ে গেল পটাস করে। দুলাল মাথা গরম করলো না, খুব সাবধানে পায়ের ছেঁড়া স্যান্ডেলটা ঝেড়ে ফেলে, তারপর একপা পেছনে গিয়ে ব্যালেন্সটা আবার ঠিক করে নেয়।

বাড়ির সামনে এসে দেখে মজা পুকুরটার সামনে বসে ফকিরচান নিবিষ্টমনে কিছু ভাবছে। সাইকেলের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ শুনে তিনি পেছন ফিরে দেখেন। দুলাল চোখ ফিরিয়ে নেয়। সাইকেলের সামনের চাকার দুটো শিক খুলে গেছে। সেদিকে দেখতে দেখতে দুলাল অনুভব করে, ফকিরচান ঘাড় ঘুড়িয়ে এখনো এদিকেই তাকিয়ে আছে- জ্বালাধরা দৃষ্টিতে।

......

সেদিন রাতে ঝিনুকদের নিরানন্দ বাড়িটিতে এক ঝলক খুশির হাওয়া বয়ে গেল, দীর্ঘদিন পর বাড়িতে গোরুর মাংস রান্না হয়। জুলেখা নিজ হাতে দুলালকে খাবার বেড়ে দেন। দুলালের বোনগুলো কারণে অকারণে এঘর-ওঘর করতে থাকে, খিলখিল করে হেসে উঠে।

ফকিরচান বারান্দায় পাটি পেতে শুয়ে ছিলেন, একসময় তিনি ঘরে আসেন। ফকিরচানকে দেখে দুলাল তড়িঘড়ি করে কোনরকমে খাওয়া শেষ করে।

ফকিরচান একসময় খেতে বসেন, বোকা ঝিনুকটা উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে ছুটে এসে খলবল করে বলে উঠে-

- আব্বা জানেন- ভাইজান না নিজের ব্যবসা শুরু করছেন। উনি বলছেন প্রথম মাসের কামাইয়ের টাকায় উনি আমারে শিশুপার্কে নিয়ে যাবেন।

ফকিরচানের ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের ভঙ্গি। নাক দিয়ে খুহ শব্দ করে তিনি এক ঝলক জুলেখার মুখের দিকে তাকান।

জুলেখা সেদিকে না তাকিয়েও শ্লেষের উত্তাপটুকু অনুভব করেন, তার মুখের তৃপ্তির ভাবটুকু দপ করে নিভে যায়।


৫.
মধ্যরাতে পৃথিবীর নামকরা বেশ ক’টি সাম্রাজ্যের পতন হয়ে গেল। পরাজিত সম্রাটগণ যখন তাদের সেনাপতিদের সাথে নিয়ে পালানোর ফিকির করছিলো, ঠিক তখনই মনিদের ইট ভাটার চিমনীটার পেছনে পূর্ণিমার চাঁদটা ঝুপ করে খসে পড়লো। ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে চাঁদটা একসময় ফকিরচানের পায়ের ঠিক সামনে এসে থেমে যায়। ফুটবল দলের দক্ষ অধিনায়কের মতো করে ফকিরচান অতঃপর চাঁদটার ঘাড়ে একটা ঠ্যাং তুলে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।

যুদ্ধজয়ী বীরের বেশে তারপর তিনি চেয়ারম্যানের পোলের উপর উঠে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ান। পাশে দাঁড়ানো নিতাই তাতে আপত্তি করে না, ফিকফিক করে কেবল হাসতে থাকে।

- পাপ করো... জগতের যত মজা সব পাপে। পুণ্য করে কি বালটা হবে! যত পারো মজা লুটে নাও। মিথ্যা বলো, ঘুষ খাও... যেখানেই রেন্ডী পাবা... সমানে **** থাকো।

- আরে, করো কি দাদা! পোলাপাইন আছে... মুখ খারাপ করো কেন!

দু’একজন ছেলে-ছোকরা পাশে দাঁড়িয়ে মজা লুটছিল। নিতাই এবার একটু কঠোর হল।

- এই তোরা এখানে কি করস! যা বাড়ি যা...

এলাকার ছেলে-ছোকরারা নিতাইকে কিছুটা সমীহ করে, ঝাড়ি খেয়ে ওরা কিছুটা সরে দাঁড়ায়।

নিতাই ফকিরচরনকে নিচে নামিয়ে আনে। তারপর বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। অন্যসময় হলে হয়তো সে ফকিরচরনকে একা ফেলে চলে যেতো। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা ভিন্ন। মাতালরা কখনও সঙ্গীকে অরক্ষিত পরিস্থিতিতে একা ফেলে রেখে চলে যায় না।

ফকিরচরন বাধ্য ছেলের মতো গুটিগুটি পায়ে এগুতে থাকে। মাঝে মাঝে নিতাইকে আগড়ম-বাগড়ম সব প্রশ্ন করলেন। নিতাই শান্তভাবে হু-হা জবাব দিয়ে যায়।
-দাদা, ছেলেটা এতো কষ্ট করে দুইটা টাকা জমাইসে, সব এক রাতেই এভাবে উড়ায়া দিলা- কাজটা কি ঠিক হল!
নিতাই নিজেও জীবনে কম পাপ করেনি। তবুও তার মধ্যে কিছু নুন্যতম নীতিবোধ আছে। ফকিরচানের এমন সর্বস্ব উজার করে খারাপ হবার প্রবণতাটুকু সে ঠিক মেনে নিতে পারেনা।
ফকিরচানের চোখদুটো হঠাৎ জ্বলে উঠে-
- বেশি বুঝিসনা নিতাই! ওইডা আমার ছেলে না... ওইডা একটা বেজন্মা। যে কয়টা দিন বাইচা থাকমু- শুধু অভিশাপ দিয়া যামু- ও কখনো জীবনে সফল হইতে পারবোনা!

দুলালের প্রতি ফকিরচানের এমন বিদ্বেষের কারনটা নিতাইয়ের জানা। তীব্র এই বিদ্বেষের কারনটি জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে পেছনের দিকে।
ফকিরচান তখন তাগড়া জোয়ান। নিতাইও নবীন তবলচী হিসেবে বেশ নাম কুড়াচ্ছিল। যাত্রাদলটির সাথে সাথে দু’বন্ধু ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দেশের নানা অঞ্চল। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একদিন ফকিরচান আর জুলেখা মুখোমুখি হয়ে যান। জুলেখা প্রথম প্রথম খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি, কিছুটা নিরাসক্তির ভাবই ছিল বরং।

ফকিরচান তখন প্রখ্যাত লম্পট। যে নারী সহজলভ্য নয়, তার মন জয় করার মত রোমাঞ্চকর আর কিইবা হতে পারে। জুলেখাও একসময় ধরা পড়লো ফকিরচানের পাতা ফাঁদে। এর কিছুদিন পরই জুলেখা আর ফকিরচানকে গ্রামবাসী অসংলগ্ন অবস্থায় পাকড়াও করে স্কুলঘরের নির্জন কক্ষ থেকে। গ্রামের মোড়লরা ফকিরচানকে চেপে ধরলো- জুলেখাকে বিয়ে করার জন্য। ফকিরচান প্রথমে গাঁইগুঁই করলো, তারপর পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গ্রামের ছেলে-ছোকরাদের হাতে ব্যাপক মার খেলো। তার মত নামকরা লম্পটের হাতে মেয়ে তুলে দিতে সবার এতো আগ্রহ কেন- ভেবে তিনি বেশ অবাকই হচ্ছিলেন।

ফকিরচান এই প্রশ্নটির জবাব পান বিয়ের প্রায় পরপরই- যখন তিনি জানতে পারেন জুলেখা আগে থেকেই গর্ভসঞ্চার করে বসে আছে। পরবর্তীতে এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে অসংখ্যবার বাদানুবাদ, ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। কিন্তু কেউ কখনও কাউকে ছেড়ে যাননি। দু’জনের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বলেই হয়তো!
বিয়ের সাতমাস পর জুলেখা একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার অনেক আগে থেকেই জুলেখা বুঝেতে পেরেছিলেন তার সন্তানের জন্য কি মমতাহীন- শুকনো জীবন অপেক্ষা করছে। তারপরও তিনি তার সন্তানের নাম কেন দুলাল রেখেছিলেন- সেটা আজো পর্যন্ত একটা রহস্য।

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। ফকিরচান আর তার লাঞ্চনার ইতিহাসটি ভুলতে পারলেননা! অকালবৃদ্ধ-অথর্ব ফকিরচান দুলালের কামাই করা টাকায় কেনা ভাত খান ঠিকই- কিন্তু কোন স্বাদ পান না। তিনি নিজেও জীবনে কম পাপ করেননি, সে সব অধ্যায় আজ অনেক নিচে চাপা পড়ে গেছে। শুধু সুদূর অতীতে সংঘটিত কোন এক পাপের জলজ্যান্ত নিদর্শন অহর্নিশি তার সামনে ঘুরে বেড়ায়। যতোবারই তিনি দুলালের মুখোমুখি হন, ততোবারই তার নিজেকে আরও বেশি নপুংসক মনে হয়।

- বাদ দাও দাদা, পুরান কথা মনে রেখে কি লাভ। সব পরিবারেই কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। এইযে আমারেই দ্যাখোনা- বুড়ো বয়সে বিয়ে কইরা কি বিপদে পড়েছি। দুনিয়ার যত চ্যাংড়া পোলাপাইন আছে- দিনরাত আমার ঘরের চারদিকে ঘুরঘুর করে।

নিতাইয়ের বউসংক্রান্ত সমস্যাটির কথা শুনে ফকিরচানের মনটা প্রসন্ন হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা তার কানেও এসেছে। নিতাইয়ের আগের বউটা মরেছে বছর দুয়েক হল। একটা মেয়ে ছিল- বিয়ে হয়ে গেছে। লক্ষ্মীকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে বছরখানেক হল। লোকে বলাবলি করে- নিতাইয়ের বউটা নাকি একদম পুরুষখেকো। নিতাই ঘর থেকে বের হলেই নাকি প্রতিদিন নিত্যনতুন ছেলে-ছোকরাদের ঘরে ডেকে নেয়।

বউয়ের কথা মনে পড়ায় নিতাই আর দাঁড়ালো না। ফকিরচানও টলতে টলতে এগিয়ে যান ঘরের দিকে, বিড়বিড় করে বলতে থাকেন- “মজা... মজা!”


৬.
পীরগঞ্জের মাইজপাড়া গ্রামের উপর দিয়ে গতরাতে প্রচণ্ড তাণ্ডব বয়ে গেছে। বিষাক্ত চোলাই মদ খেয়ে অর্ধশত লোক আক্রান্ত, ইতোমধ্যে মারা গেছে চারজন।

ফকিরচান বিষের ধাক্কাটা টের পেলেন ভোর রাতের দিকে। নিতাই বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবার পর তিনি চুপচাপ বাড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়েন। শেষরাতের দিকে তার বমির দমক শুরু হয়।

ফকিরচান হেঁজিপেঁজি ধরনের মাতাল নন। মদ খেয়ে বমি করার মত ব্যাপার তার জীবনে কখনও হয়নি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটি ভিন্ন। বমির ধকলে তার ফুসফুস-যকৃত বের হয়ে আসার উপক্রম হল।

ছোট বাড়িটির মাত্র দু’টি কক্ষ, একটিতে ফকিরচান তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন, অন্যটিতে তার তিন মেয়ে। দুলাল ঘুমায় পাশের মসজিদের লাগোয়া বারান্দাটিতে।

অবস্থা বেগতিক দেখে ঝিনুক ছুটে গিয়ে দুলালকে ডেকে নিয়ে আসলো। ততোক্ষণে পুরো গ্রামে মাতম শুরু হয়ে গেছে।

বাড়ি এসে দুলাল প্রথম যে ব্যাপারটা খেয়াল করলো তা হল- তার বাঁশের ঝুড়িসমেত থালা-বাসন-ডিনারসেটের বোঝাটা লোপাট হয়ে গেছে। পোড় খাওয়া দৃষ্টিতে দুলাল পুরো পরিস্থিতিটা একবার বিশ্লেষণ করে নেয়।

গল্পের এ পর্যায়ে এসে দুলাল প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ধারণা দেওয়া জরুরী।

দুলালের বয়স বাইশ। অভাবের তাড়নায় ক্লাস এইটে থাকতে তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে অবশ্য তাকে কখনও হা পিত্যেশ করতে দেখা যায়নি। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে বরং একরকম স্বস্তিবোধ করেছিল। পড়াশোনায় সে কখনোই মনোযোগী ছিল না যে।

ষোল বছর বয়সে তার বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের শুরু হয় ফেরিওয়ালাদের মোট বহনের মাধ্যমে। প্রথম প্রথম সে মাছ ব্যাপারীদের মাছের ঝাঁকা বয়ে বেড়াত। খুব ভোরেই মোট নিয়ে মাছ ব্যাপারীদের পিছু পিছু রওনা হত দূরদূরান্তে। সারাদিন মোট বয়ে সে দেড়শ-দু’শো টাকার মতো আয় করতো।

দুলালের আয় করা সে টাকাই সে সময় ফকিরচান ও তার সংসারকে আস্তাকুঁড়ে পতিত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল।

সারাদিন খেটেখুটে পাওয়া টাকায় তার পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন কোনরকমে হয়ে যেত। এতো টানটান নিদারুণ দৈন্যের মাঝে থেকেও দুলাল কখনও তার সামনের দিকে তাকানোর অভ্যাসটিকে বিসর্জন দেয়নি। প্রতিদিনের উপার্জিত অর্থের একটা অংশ সে খুব সঙ্গোপনে জমানো শুরু করে।


এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরী ছিল, কারণ তার পিতা ফকিরচান প্রায়ই তার মায়ের গোপনে সঞ্চিত অর্থের লক্ষ্যে পুরো বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দিত। জুলেখা বিছানার জাজিমের নিচের গোপন প্রকোষ্ঠে, চালের ড্রাম, এমনকি মাটি খুঁড়ে গর্ত করে পলিথিনে মুড়ে টাকা জমানোর বিস্তর চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন- কিন্তু কখনও সফল হননি।

ধুরন্ধর ফকিরচান কোন এক অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাবলে প্রতিবারই সে সব গোপন সঞ্চয়ের সন্ধান পেয়ে গেছেন। খাবলা মেরে টাকা তুলে নিয়ে চোখের পলকে ছুটে গেছেন মদের আখড়ায়।

দুলাল তাই টাকা জমাতে শুরু করে তার এক বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর কাছে। টুকটুক করে জমানো টাকার অংকটি একটু বড় হতেই দুলাল সিদ্ধান্ত নেয়ছিল- এবার নিজের ব্যবসা শুরু করবে। এখন থেকে আর অন্যের মোট বহন করবে না।

কিন্তু শেষ রুক্ষা আর হলো না। দুলালের ছয় বছরে জমানো টাকা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ফকিরচানের কয়টি মুহূর্তই যথেষ্ট।

বমির দমকে ফকিরচান বাঁকা হয়ে গেছেন, লুঙ্গির গিঁট হয়ে গেছে আলগা। দুলাল খুব দ্রুত ফকিরচানকে জামা পরিয়ে দিলো, লুঙ্গির গিঁট বেঁধে দিলো- তারপর তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পড়লো।


৭.
সদর হাসপাতালের মেঝেতে পা ফেলার জায়গাটিও অবশিষ্ট নেই। শতশত রোগী এখানে সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে ফকিরচানের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ডাক্তাররা জরুরী ভিত্তিতে তার চিকিৎসা করলেন। স্টমাক ওয়াশের পর ইয়া বড় সিরিঞ্জ দিয়ে একজন নার্স এসে ফকিরচানকে ইনজেকশন দিয়ে গেল।

ইনজেকশন দেবার পর কেন যেন ফকিরচানের দু’চোখ জড়িয়ে আসতে চাইলো। আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে ফকিরচান দেখতে পান সামনের কেবিনে নিতাই বেকুবের মতো ঘাড় লটকে পড়ে আছে। নিতাইয়ের নতুন বিয়ে করা যুবতী বউটি দিগ্‌ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। দুলাল কোথা থেকে একজন ডাক্তারকে ধরে আনে। নিতাইয়ের বউটা কিছুটা শান্ত হয়, অবসন্নভাবে সে অপ্রশস্ত কেবিনটির এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। দুলালের সাথে তার শরীরটি প্রায় ঠেকে গেছে। গভীর তন্দ্রায় ডুবে যেতে যেতে ফকিরচান খেয়াল করেন- দুলালের চেহারাটি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ফকিরচান ফুরুৎ করে একপ্রস্থ হেসে নেন। শুকনো ঠোঁটদুটো জিভ দিয়ে চাটতে চাটতে বিড়বিড় করে বলেন- মজা... মজা...!
......

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর ফকিরচান অনুভব করলেন- তিনি প্রায় সুস্থ হয়ে গেছেন, মাথার ভেতর ভোঁতা একটা অনুভূতি আছে, এছাড়া বাকি শরীরে কোন সমস্যা অনুভূত হচ্ছে না।

নিতাইয়ের অবস্থা এখনও বেশ কাহিল। বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারছে না। সুস্থ বোধ করার পর ফকিরচান একবার ভেবেছিলেন বাড়ি ফিরে যাবেন। নিতাইয়ের বউ লক্ষ্মীকে দেখে তিনি মত পাল্টালেন। নিতাইয়ের কেবিনটি কাঠের তৈরি, দরজা নেই- সেখানে একটা ময়লা পর্দা কোনরকমে ঝুলে আছে।

কেবিনের ঠিক বিপরীতদিকের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ফকিরচান প্রাণভরে লক্ষ্মীকে দেখতে থাকেন। এই বয়সেও ফকিরচানের কামভাব প্রবল। জুলেখা একসময় ডাকের সুন্দরী ছিল। এখন তো আর মুখ তুলে তাকাতেও ইচ্ছে করে না। ফকিরচান তবুও মাঝে মাঝে গভীর রাতে হাত বাড়াতেন। জুলেখা সাথে সাথে ঝামটা মেরে হাত সরিয়ে দেয়।

কেবিনের বিপরীত দিকে শুয়ে থাকা ফকিরচান অনেকক্ষণ ধরে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে- ব্যাপারটা লক্ষ্মীও খেয়াল করেছে, তবে এতে তার খুব একটা ভাবান্তর হয় না। দু’হাত উপরের দিকে তুলে সে অলসভাবে আড়মোড়া ভাঙ্গে। ফকিরচানের নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসে, আজ বোধহয় তিনি দমবন্ধ হয়ে মারাই যাবেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। দুলালের কোন খবর নেই। সারাদিন ফকিরচান মেঝেতেই পড়েছিলেন। লক্ষ্মীর উপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও দৃষ্টি সরাননি। দুলাল এলো সন্ধ্যার পর। সাথে সাথে নিতাইয়ের বউটা চড়ুই পাখির মতো চিড়িক বিড়িক শুরু করলো। দুলাল নার্সের পিছুপিছু বাইরে বের হতেই লক্ষ্মীও সেইদিকে হরিণীর মতো ছুটে গেল।

এপাড়েতে শুয়ে শুয়ে ফকিরচানের হো-হো করে হাসতে ইচ্ছে করে। লক্ষ্মী একসময় ফিরে আসে, কিন্তু দুলালের কোন খবর নেই।

দুলাল ফিরে এলো গভীর রাতে। এতো রাতে হাসপাতালের গেট বন্ধ থাকার কথা। দুলাল কিভাবে ভেতরে ঢুকলো- কে জানে!

দুলাল এসে ফকিরচানের পাশে দাঁড়াতেই নিতাইয়ের কেবিনের আলো জ্বলে উঠে। সর্বনাশিনীর ভঙ্গিতে লক্ষ্মী কেবিনের মাঝখানটায় এসে দাঁড়ায়, চোখ জ্বলজ্বল করছে- মাঝে মাঝে ফুলে উঠছে নাকের পাটা।

অন্ধকারে মটকা মেরে পড়ে থাকা ফকিরচান রীতিমতো উল্লাসে ফেটে পড়েন। আজ বোঝা যাবে- বাছা তুমি কত্ত বড় যুধিষ্ঠির হয়েছো!

দুলাল কেবিনের দিকে ম্লানভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। লক্ষ্মীর বুকের উপর থেকে আঁচল খসে পড়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দুলাল সেদিকে এগুতে থাকে। উত্তেজনায় ফকিরচানের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে থাকে। এটাই কি তবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! আজকেই কি তার বিজয় সুনিশ্চিত হবে!

দুলাল একসময় কেবিনের সামনে পৌঁছে যায়, তারপর হাত বাড়িয়ে কেবিনের পর্দাটা টেনে দেয়। সাথে সাথে দূরে কোথাও অনেকগুলো ঘণ্টা একসাথে বাজতে শুরু করে। স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে এসে সফেদ পোশাকধারী একদল অশ্বারোহী সুট করে ফকিরচানের বুকের ভেতরটায় ঢুকে পড়ে।

কালো শক্ত বীজের মতো একটা কিছু তার বুকের ভেতরে বহুদিন ধরে প্রোথিত হয়ে ছিল। অশ্বারোহী দলের তাড়া খেয়ে কালো বীজটুকু নিমিষেই ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

দুলাল ফিরে এসে ফকিরচানের পায়ের কাছের চেয়ারটিতে বসে। ফকিরচান হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকেন। কিছু একটা বদলে গেছে। ফকিরচানের ডাকার ভঙ্গিটি অন্যরকম। দুলাল বিস্মিতভাবে সেদিকে এগিয়ে যায়। ফকিরচান দু’হাতে দুলালের হাতটি জড়িয়ে ধরে, তার চোখের কোন জ্বলে সিক্ত।

ফকিরচানকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, কেবল তারাই বুঝবেন- এর চেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা পৃথিবীতে খুব বেশি ঘটে না।

- ঈদ্রিস আলি আমাকে সবসময় দোয়া করতে বলে, কিন্তু আমি কখনও দোয়া করি না, কেন জানোস? কারণ এই জীবনে আমি আল্লাহ্‌র কাছে যা কিছু চাইছি তার কিছুই কখনও পাই নাই। তবে আজকে আমি আল্লাহ্‌র কাছে একটা জিনিস চাইবো, আর আমি জানি আল্লাহ্‌ আমার সেই দোয়া কবুল করবেন- তুই জীবনে অনেক সফল হবি। তোর নিষ্ঠা তোকে অনেকদূর নিয়ে যাবে। যেইদিন তুই অনেক বড় হবি, সেইদিন আমার এই কথাটা মনে করবি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed চমতকার লেখাটি পড়ে অভিভূত হলাম। অভিনন্দন।
শামীম খান গল্প কবিতায় আপনার লেখা আর দেখা যায় না । খুব জানতে ইচ্ছে করে , আপনি কেন দূরে সরে গেছেন । যেখানেই থাকেন ভাল থাকবেন । আর কলম যেন থেমে না থাকে ।
রনীল N/A UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# 'বোধন'- গল্পের সকল পাঠক, মন্তব্যকারি এবং শুভানুধ্যায়ীদের জানাচ্ছি আমার কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা বিজয়ী অভিনন্দন ! বিজয়ধারা অব্যাহত থাক !
সালেহ মাহমুদ UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# বিজয়ে অভিনন্দন রনিল, অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ প্রাণঢালা অভিনন্দন।
তানি হক ভাইকে অভিনন্দন !
আহমেদ সাবের অভিনন্দন রনীল
Lutful Bari Panna রনীল এই বিজয় এক্সপেক্টেড ছিল... অনেক অনেক অনেক অভিন্ন্দন...
sakil bijoyer jonno onek onek ovinondon

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩১ টি

সমন্বিত স্কোর

৬.৫৯

বিচারক স্কোরঃ ৪.১৫ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৪৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪