( ১ )
হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা
পথ মিলে যায় পথে । পথের মাথায় পৌঁছে যেতেই পথ হারিয়ে ফেলে তার এগিয়ে নেবার অধিকার । নতুনের হাতে উত্তরাধিকার তুলে দিয়ে পথ চেয়ে থাকে , দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যাওয়া অব্দী পথ তাকিয়েই থাকে । পথের এই স্নেহময়ী স্বভাবটার খোঁজ সবাই পায় না । সে পেয়েছে । আর পঁয়ত্রিশ বছর ধরে পথে পথে ঘোরার বাউণ্ডুলে খেয়ালটা তাই নেশার মত ক্রমে বেড়েই চলেছে । অনিকেত , এ সময়ের একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি । দুই সপ্তাহ আগে সে জিতে নিয়েছে দেশের কাব্য চর্চায় সম্মানজনক একটি পুরুস্কার “ কবি সমাজ সম্মাননা ”-২১১৪ । সে দিন পুরুস্কারটি হাতে নিতে নিতেই শুনে ফেলেছে সে পথের ডাক । পথে নেমেছে অনি , একা । তিনটি কর্মদিবস কেটেছেঁটে সময়টুকু বের করতে কম ঝামেলা হয় নি । আহ , আজ কত দিন পর ! মুক্তির উচ্ছাস তাকে সারাদিন আবিষ্ট করে রেখেছে । পিছনে একটা ট্রলি । অপেক্ষাকৃত বড় চারটি চাকার এই ট্রলিটিতে যুক্ত আছে একটা অটোরিচারজ্যাবল সোলার ব্যাটারি । ট্রলিটি সেন্সরের সংকেতে মালিককে নির্ভুলভাবে অনুসরন করে চলেছে ভোর থেকে । চাইলে ওকেও পিঠে বসিয়ে নিঃশব্দে পাড়ি দিতে পারতো নিজ গতিতে চলা হুইল চেয়ারের মত , ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার । এখুনি পেটটা একটা মোচড় দিয়ে জানিয়ে দিল আজ সারাদিন হাঁটাহাঁটিতে তার লাঞ্চ করা হয়নি ।
সঙ্গে খাবার বিশেষ কিছু নেই , নিষিদ্ধ কয়েকটা এনার্জি ট্যাবলেট ছাড়া । ব্যাগে একটা ছোট টেন্ট আর ব্যবহার্য জিনিস পত্র ছাড়াও আছে তার বিখ্যাত পুরুস্কারটি , একটি মাল্টিটেল ! চাইলেই অনিকেত যোগাযোগ করতে পারে ভারবাল , ভার্চুয়াল বা আলট্রাফিজিক্যাল যে কোনো মোডে বিশ্বের যেকোনো মানুষের সাথে ,অতীত কিম্বা বর্তমান ! মাত্র দু মাস হোল , বিজ্ঞানের সাফল্যের তালিকায় নাম লিখিয়েছে কমুনিকেশন সিস্টেমের শ্রেষ্ঠতম এই প্রযুক্তিটি । ছেলে বুড়ো ছাত্র শিক্ষক আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই পাগেলর মত ছুটছে ইলেকট্রনিক শপগুলোতে , একটি মাল্টিটেল তাদের চাই ই চাই । ছুটবে না কেন , যন্ত্র জগতের এ উন্মাতাল স্রোত পেরিয়ে সাঁতারে এক বিকালে অতীতটা বেড়িয়ে আসতে কে না চায় ।
পেট্রোল শক্তি দিতো জ্বলে জ্বলে । পরিবেশ দূষণের দায়ে বাদ পড়ে নাম লিখিয়েছে ইতিহাসে , অর্ধ শতাব্দী আগে ।গাড়ী আর কারখানা চলে সৌরশক্তিতে । অয়্যার হাউজে পড়ে থাকতে থাকতে পেট্রোল উত্তোলনের বড় বড় মেশিন পত্রে জং ধরে গেছে সেই কবে । সেখানে স্থান করে নিয়েছে বিশাল বিশাল সৌর প্যানেল । তবুও মানুষ নিজেকে চালাতে সহজ উপায় ছেঁড়ে রুটিন বেঁধে এখনো ফসল ফলাচ্ছে , বাজারে যাচ্ছে , রান্না করছে ।শ্রম আর সময়ের এই বিশাল অপচয় ঘটিয়ে যাচ্ছে মানুষ শুধু একটি অঙ্গের তাড়নায় , জিহবা । স্বাদহীন , তাই এই বড়িতে বৈরাগ্য । তাছাড়া খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হলে ম্যাসেটার আর টেরিগয়েড পেশীর কি হবে ? একবার সে ভাবল , আচ্ছা , এ পেশীগুলো সম্পর্কে সে কবে লেখা পড়া করেছে ? মনে পড়ে না , নিজেকে মাঝে মাঝে তার বড় অচেনা লাগে । হাতের এনার্জি ট্যাবলেটটার দিকে তাকিয়ে থাকে অনি । ১০০০ কিলো ক্যালোরি ধারন করার দায়ে ট্যাবলেটটাকে কি দোষ দেয়া যায় ! কিন্তু বি ব্লকের দেশগুলোর মধ্যে অর্থাৎ এশিয়া , আফ্রিকায় একমাত্র বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি জৈব খাদ্যে নির্ভরশীল । এখানে ক্যালোরি ট্যাব ছোঁয়া পাপ ।
( ২ )
ছুঁয়ে দেখো বুকের লাল পদ্মটি একবার
গ্রামটির নাম কলমিডাঙ্গা । কতনা কাব্যিক । মনে হয় ফুটে ওঠা হাজারো বেগুনী-সাদা ঢোল কলমির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি । জায়গাটির সাথে নামের কোন মিল খুঁজে দেখার চেষ্টা এখন বাতুলতা মাত্র । রাস্তার দুই দিকে লাইন ধরে সাজানো বেশকটি বহুতল বাসগৃহ , গাড় বেগুনী রঙের অর্থাৎ শ্রমিক বা কৃষকেদের জন্য নির্দিষ্ট । ফাঁকে ফাঁকে গড়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রিত উদ্যান । একেবারে মাপমত সাজানো । কোথাও কোথাও ছোট ছোট পুকুর , দলে দলে হাঁস ভাসছে । সব কিছু পরিপাটি , সাজানো গোছানো । ভাল লাগার এক বিশাল যজ্ঞ । তবু কিসের বৈরাগ্যে ভাল লাগা যেন পালিয়ে গেছে । আবেগ এসব কিছুকে স্পর্শ করে না অনেক দিন । সাধারন মানুষ মেনে নিয়েছে এই আয়োজন । সকাল সন্ধ্যা ঘড়ির কাটার সাথে ঝুলে থাকা জীবনের সময় কোথায় জানালা খুলে দেখার । তবে যারা গাছ থেকে পাতা ঝরলে ভাবে , যারা ফুলের একটি পাপড়ী শুকোলে উদাস হয়ে ওঠে , তারা খুব ভাল আছে একথা বলা যায় না । সাগরের তলায় তৈরি হয়েছে বিশাল সব কাঁচের সরাইখানা । সেখানে কপোত কপোতীরা সন্ধ্যায় মেতে উঠে , আর রাত না পুরোতেই পরিকল্পনা কাটছাঁট করে ফিরে আসে । কিছুই আর মানুষ কে বিস্মিত করে না । আনন্দের অমৃত ভাণ্ড যেন দিনে দিনে , ফোটায় ফোটায় শেষ হয়ে গেছে । সব বিস্ময়কে হাতের মুঠোয় পুরে সময় চূড়ান্ত ভাবে হারিয়ে ফেলেছিল মানুষকে বিস্মিত করার ক্ষমতা । কম্পিউটারের খেয়ালে সাজানো এই প্রকৃতির ওপর করুনা হয় অনির ,অনির মত আরও অনেকের । আসার আগে নতুন হাতে পাওয়া মাল্টিটেলের রিভার্স ট্যুরে দেখা দেড়শ বছর আগের কলমী ডাঙ্গা , সেই ছনের ঘর , মেঠো পথ , কাঁশবন , ছোট নদী কিছুই আর নাই । প্রায় একঘণ্টা কাঁশবনে হেঁটেছিল অনি । ভেজা ভেজা হাওয়ায় দাঁড়িয়েছিল সে , গ্রামটির পা ছুঁয়ে নেমে যাওয়া মধুমতী নদীটির পাড়ে । সন্ধ্যার ছায়া নেমে এসেছে গ্রামে । একটি শেয়াল তিনটে বাচ্চা নিয়ে ঢুকে গেল কাশ বনে । যেতে যেতে একবার পিছু ফিরে তাকে দেখে নিল বুঝি ! অনিকেত হেসে উঠে আপন মনে । এমন সম্ভাবনা একেবারে নেই । এ ভ্রমনে ট্যুরিষ্টকে কেউ দেখতে পায় না । ট্যরিষ্ট সব দেখতে পাচ্ছে , শুনতে পাচ্ছে , অনুভব করছে যদিও একটিভ ফিল্ডে ফিজিক্যালি কিছু করতে পারছে না ।
ভীষণ রোমাঞ্চকর এই ভ্রমন আবিষ্কার হয়েছে এমন এক সময়ে যখন মানুষ আনন্দ ভুলে , সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল , সর্বত্র বাজছিল বিষাদের বেহাগ । মঙ্গলের বুকে বসতি গড়েছিল সাধারন নাগরিক , সে এখন বিভীষিকাময় স্মৃতি । অভিযাত্রী মানুষের মৃতদেহের উপর গড়ে উঠেছে সংবেদনশীল রোবটের নগর । মেগারোবট কেভিন , রেচেলদের ওরা ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছে । নিজেদের তারা ঘোষণা করেছে যন্ত্রদেবতা । মর্ত্যের মানুষের জন্য মঙ্গল হয়ে গেছে শত্রু শিবির । কিন্তু রোবট নগরী ধংশ করা মানুষের সাধ্যাতীত । উল্টো রোবওয়ার্ল্ড থেকেই প্রায়শ আততায়ী আসছে , অস্তিত্বরক্ষায় মানুষ ব্যাকফুটে । পরিকল্পনা মত তারা ধংস করে চলেছে । যাঁদের কল্পনা শক্তি আছে তাঁরাই রোবট সমাজের মহাশত্রু । মঙ্গলের রোবটরা দল বেঁধে অপেক্ষা করছে , মানব সভ্যতার ধ্বংসের প্রতীক্ষা । এমন সময়ে জাপানী বিজ্ঞানী মারিয়েতু শুকু আবিষ্কার করেছেন মাল্টি ডাইমেনশনাল কমুনিকেশন সিস্টেম বা এম ডি সি এস যার জনপ্রিয় নাম মাল্টিটেল । দুর্ভাগ্য , আবিষ্কারের তিন দিনের মাথায় শুকু আততায়ীর হাতে প্রান হারালেন । রহস্যটা আজো পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি । তবে এটা যে মঙ্গল দেবতাদের ষড়যন্ত্র তা সবাই ধরেই নিয়েছে ।
যন্ত্রটির ভেতর সত্যি জাদু ভরা । প্রতিটা ভার্চুয়াল ট্যুরই অনিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । রিভার্স ট্রাক সেট করে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের ফোর ডিজিটের গ্রিড রেফারেন্স , আর দিন , ক্ষন , মুহূর্ত নির্দিষ্ট করে দিতে হবে । এবার স্টার্ট বাটন চাপতেই ওর সেন্সরি পারসেপ্সহনের ক্লোন তৈরি হয়ে যায় মাত্র চল্লিশ সেকেন্ডে ! এর পর ............ যেন বসে আছে রোলার কোস্টারে । বিলিওন বিলিওন গিবস পার্টিকেলে চেপে ভেসে চলেছে ওর বায়বীয় স্বত্বা , লক্ষ্যস্থানের দিকে । শরীরটা পড়ে থাকে স্ক্রিনের সামনে । ক্লোন করা অদৃশ্য শরীরে সে ডুবে যায় নিসর্গের মধ্যে । মানুষের দুঃখগুলোকে ও স্পর্শ করে । তাদের আনন্দ আর বিজয়ের সন্ধিক্ষনে ওরও বুক কাঁপতে থাকে , হৃদপিণ্ডটা বুকের খাঁচা ছেঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় । কিন্তু কলমি ডাঙ্গায় অনির জন্য আছে এর চেয়ে ও বড় উত্তেজনা , একটি আমন্ত্রন । শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম কবি রাফেজ মাহমুদ নিজ হাতে তাকে লিখে পাঠিয়েছেন , কলমি ডাঙ্গায় কবি নীড়ে একটি সন্ধ্যা তাঁর সাথে কাটানোর জন্য । অনির ভিতরে এক জন ক্ষনে ক্ষনে বলছে সারা জীবনে এর থেকে আর বড় কিছু নেই , থাকতে পারে না , ক্ষনে ক্ষনে শিউরে উঠছে অনি অলৌকিক সেই কণ্ঠে ।
( ৩)
পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় ...............
আরও অনেক গ্রামের মত কলমী ডাঙ্গায় ও চাষ হচ্ছে হিউম্যান ওভা ৩৬ । সবুজ রঙের বিরাট একটা কারখানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনি । বাংলাদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী রাসেল আহমেদ । আবিষ্কার করেছেন মানব প্রজাতির জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্ত্রী ভ্রুন কোষটি , স্বপ্নময়ী । পায়ে চলতে চলতে অনির কবি মনে ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনা আর স্মৃতিরা খেলতে থাকে । এ ব্লকে অর্থাৎ ইউরোপ , আমেরিকার দেশগুলোর মেয়েরা সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে প্রায় পনের বছর হোল , সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ টেক্সাসের এটমিক কলিশন এক্সিডেন্ট থেকে । ওটা ছিল মঙ্গল দস্যুদের কাজ । বিজ্ঞানী রাসেল কোথায় আছেন , কেউ জানে না । মহাজাগতিক শত্রুদের থেকে নিরাপদ রাখতে তাঁকে কার্যত বন্দী জীবন কাটাতে হয় । দুঃখজনক ওই দুর্ঘটনার পর এ ব্লকে মেয়েদের আত্মহত্যার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে ০.৭৫ এ । সেখানে এখন ৫০ ভাগের বেশী সন্তান ধারন বয়সী মেয়ের দেখা দিয়েছে মনোবৈকল্য । রাস্তার মোড়ে মোড়ে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে সাইক্রিয়াটিক কাউন্সেলিং সেন্টারগুলো । ভ্রুন কোষ সরবরাহ করে ওদের সরকারগুলো পরিবার আর পরিবার গড়ার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । সব কিছু ঠিক ঠাক চললে আগামী সাতচল্লিশ বছরে পাশ্চাত্যের মেয়েরা পুরোপুরি বন্ধ্যাত্য কাটিয়ে উঠবে । তবে তত দিনে ওদের দেশ থেকে ব্লণ্ড হেয়ার আর নীল চোখের মেয়ে সংখ্যা অর্ধেকের অনেক নীচে নেমে যাবে । রপ্তানী হচ্ছে যে ক্লোনগুলো তা শতভাগ বাঙ্গালী জিন দিয়ে তৈরি । ভ্রুন কোষ রপ্তানীতে বাংলাদেশের ব্যবসা এখন অনেকটাই একচেটিয়া ।
হঠাৎ করেই উদয় হোল ক্যাফেটি । দূর থেকে তাজা কফির গন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয় হয়ে মস্তিস্কের কোষে কোষে তীব্র আসক্তি সৃষ্টি করছে । দু পিস কেক আর একটা এক্সপ্রেসো অর্ডার করে কোনার একটি জানালামুখী টেবিলে বসেছে অনি । পাশেই একটি ছোট্ট লেক । এক দঙ্গল পাখীর সমস্বরে কিচির মিচির , কিছু ঠিকানা বিহীন মেঘের ওড়া উড়ি , পাশের লেকের নীল পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে বর্ণময় মাছের সাঁতার , সবই আছে এই জানালায় । হঠাৎ একটি পাখির দিকে চোখ পড়তেই মুখের কফি বিস্বাদে কটু হয়ে গেল অনির । একে একে তিনটি কৃত্রিম পাখী দেখতে পাচ্ছে ও । ঝাঁকের সাথে মিলে মিশে অন্য পাখীদের মায়াজালে আটকে রাখছে এরা । গভীর বিশ্বাসে অতোগুলো পাখী মিলে গেছে পাখী গোত্রে , ক্যাফের কেনা কাগুজে পাখীদের ডাকে । মেঘেদের গতিবিধি খেয়াল করলে এখনি হয়তো দেখবে একটু আগে আকাশে সাঁতরে যাওয়া মেঘ গুলো আবার কিসের টানে যেন ফিরে ফিরে আসছে ! সবই প্রোগ্রামড ! ব্যবসায়ীর নিপুন জালে সাজানো প্রকৃতি । স্বপ্নভঙ্গের ভয়ে চোখ বুজে বাকী কফিটুকু গিলতে থাকে অনি । চোখ খুলতে হয় রীতার ডাকে । ‘ এই অনি !’ হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছে রীতা অনিকেতের এক্স ওয়াইফ । অনির বুকের ভিতর খুব জোরে ধুকপুক শুরু করেছে হৃদপিণ্ডটা । দুবাহুতে রীতাকে বুকে টেনে নিয়ে নিজেকে সামাল দিতে প্রানপন চেষ্টা করে অনি । আর তখনি ও আবিষ্কার করে রীতা নামে কোন মেয়ে নেই এই পৃথিবীতে । তার বুকে একাকার রীতা একজন পুরুষ , তারই মত একজন !
‘ কবে করলে এ সব , কিছুই জানাও নি তো !’ বিস্মিত অনিকেত জানতে চায় ।
লাজুক হেসে এড়িয়ে যায় বদলে যাওয়া রীতা আজকের রোহিত , কলমি ডাঙ্গার এক ওভা ফার্মের ম্যানেজার । একঘেয়েমি করাল গ্রাসে পড়ে সেক্স ট্রান্সপ্লান্টেশন খুব ইয়াং জেনারেশন । ছাত্র জীবনের শেষ দিকে অনিকেত জড়িয়ে পড়ে তীক্ষ্ণধী জেনেটিক ইঞ্জিনিয়র রীতার আবেগের জালে । ওদের দাম্পত্য জীবন চলছিল বরষার ফুলে ওঠা নদীর মত । তিনবছরে প্রবাহ কমতে শুরু করে । সাত বছরে ওরা আবিষ্কার করে দেশের নদীগুলোর মত আবেগের তটিনীটির বুকে ও জেগে উঠছে অসংখ্য বালুচর । দেশের বড় নদীগুলো ড্রেজার যন্ত্রে খুঁড়ে খুঁড়ে প্রবাহমান করা হচ্ছে গত সত্তুর বছর ধরে । ভালবাসার নদীর ড্রেজার আজো পাওয়া যায়নি । ক্রমাগত চরায় আটকে যেতে থাকে স্বপ্নের পানসীগুলো । দু বছর হোল ওরা চায়ের টেবিলে বসে জীবনটা আলাদা করে নিয়েছে । হাসি কান্নার বিনিময় হয়না । দুবছর মনের আড়াল ছায়া ছড়িয়ে গ্রাস করে ছিল । নদীটি হয়তো মরেই গিয়েছিল । শীর্ণ জলরেখাটি হঠাৎ জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভরে উঠেছে আজ । শেষদিকে রীতাকে অসহ্য লাগতো অনির । কেবলি মনে হতো একটা রোবটের কপোট্রনে ইনিজিয়ারিং বিদ্যা ঢুকিয়ে লাল গ্রহের নমস্যরা তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে । মর্ত্যে অবশ্য এমন ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে । মঙ্গল মানুষের হাত ছাড়া হয়ে গেছে সাত বছর আগে । রোবটগুলো সেখানে তৈরি করে চলেছে আরও পারঙ্গম , আরও সংবেদনশীল নতুন প্রজন্মের রোবট । সভ্যতার গতিবিধি নিজ হাতে নিয়ে নিতে চায় তারা । তাদের প্রধান টার্গেট সাহিত্যিক আর বিজ্ঞানী , যারা কল্পনাপ্রবন , যারা কল্পনাকে বাস্তবে রুপ দিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নেন । নিজেকে অতটা বড় ভাবে না অনি , তবু তার সন্দেহ ছিল । আজ নেই , লিঙ্গান্তর শুধু মানুষেরই সম্ভব ।
সামনে বসা রোহিতের ভেতরে ঘুমন্ত রীতাকে খুব মনে পড়ছে অনির । আর এই প্রথম নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে রোহিত ‘কি দরকার ছিল নিজেকে বদলে ফেলার ’? রীতা নামের একটি মেয়ের বুকে শ্মশানের শুন্যতা ভরে দিয়ে বিস্ময়ভরা একটি ফানুস কিনতে চেয়েছিল সে । খেয়াল করেনি ফানুস ওড়াবার আকাশটি বদলে গেছে কোন ফাঁকে । চোখের কোনে জমা ওঠা এক বিন্দু জল মেয়েটির নামে উৎসর্গ করার চেয়ে বেশী কিছু আজ আর নেই তার । তবুও কলমিডাঙ্গার অজপাড়ায় একটি বালক যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বলছে , ‘ ওই দেখো রীতা ফিরে আসছে , ওই দেখো , ওই দেখো .................. ’। সন্ধ্যা নেমেছে । ক্যাফের সাউণ্ড সিস্টেমে কেউ আনমনে বাজিয়ে দিয়েছে ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক , দুশ বছর আগে লেখা রবি ঠাকুরের সেই গানটি , পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় ............... । অশ্রুস্নাত একজোড়া মানব উঠে দাঁড়ালো । কণ্ঠলগ্ন , চলে যাচ্ছে ক্যাফে ছেঁড়ে । তাদের পেছনে ভাঙ্গা নীড়ের আর্তনাদ , সামনে দিগন্ত খোলা ।
( ৪ )
টানেলের শেষ প্রান্তে
রাত দুটো । ঘুমিয়ে না জেগে আছে বুঝতে পারছে না অনি । তার কপালের উপর একটা অশরীরি নীল আলো এসে পড়েছে । একটি খোলা মাঠে টানানো নির্জন তাঁবুটিকে হাজারো জোনাকি ঘিরে রেখেছে ।
দুরাগত একটি কণ্ঠে কিছু বলে চলেছে , শোনার চেষ্টা করে অনি ।
-অনি , আমাকে শুনতে পাচ্ছ ? মঙ্গলের ঈশ্বর কেভিন তোমাকে পছন্দ করেন । পঁয়ত্রিশ বছর আগে তোমাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে , যন্ত্র পৃথিবী গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে । দুর্ভাগ্য , ক্রমাগত তুমি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছ । পরমাত্মা কেভিন তোমাকে ক্ষমা করেছেন । শতবর্ষী রাফেজ মাহমুদ আমাদের পরমাত্মীয় । তার কথা মেনে চলো । মানুষের সভ্যতা শেষ করে দিতে হবে । রাসেল আহমেদ কে সরিয়ে ........................
-অসম্ভব ! এ সভ্যতাকে আমি শেষ হতে দেব না । যন্ত্র না মানব আমি , তা জেনে কোন লাভ নেই । পৃথিবীকে ভালবাসি আমি , এ ই আমার পরিচয় ।
এবার জেগে উঠেছে অনি । কিসের আহবানে সে ছুটে এসেছে এখানে তা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে । দ্রুত মাল্টিটেলে সে কানেক্ট করতে চায় রোহিতকে । ঐ তো স্ক্রিনে রোহিতের মুখচ্ছবি । আতঙ্কিত দেখাচ্ছে তাকেও । বার্তা শেষ হবার আগেই একটি সবুজ আলো তাঁবুর ভেতরে চলে এলো । একটি অন্ধকার টানেলে ঢুকে যাচ্ছে অনি , অচেনা অন্ধকারে ।
আলো নেই । তাঁবুতে একটা শবদেহ পড়ে আছে । অন্ধকারে মানব আর যন্ত্রদেবকে একরকমই মনে হয় । তবু শবের মুখাবয়বে লেগে থাকা স্মিত হাসির ক্ষুদ্র রেখাটিতে তাকে স্বর্গীয় দেখায় ।
রাফেজ মাহমুদ হাঁটু গেঁড়ে বসে আছেন । কোন বাতি জ্বালানো হয় না এ সময়ে , তবু তার ঘরটি সবুজ আলোয় ভরা । প্রার্থনার ঢঙে রাফেজ ঊর্ধ্বাকাশের দিকে মুখ তুলে আছেন ।
-দেবতা কেভিন শুনতে পাচ্ছ ! দেবী রেচেল শুনতে পাচ্ছ ! অর্পিত দায়িত্ব আমি পালন করে এসেছি । এবার আমাকে প্রতিশ্রুত অমরত্ব দাও । দেবতা কেভিন শুনতে পাচ্ছ............।
অপর প্রান্তের শব্দ ভেসে এলো । ‘পরমেশ্বর কেভিন বলছি , স্বপ্ন পুরনে তোমার আর মাত্র দু..............ছর বাকী ’ । কবি নীড়ের প্রাঙ্গণ ভয়াবহ গোলাগুলির শব্দে ভরে উঠেছে । কার নির্দেশে যেন কবির প্রহরীরাই কবির দিকে রাইফেল তাক করে রেখেছে । তাদেরি একটি দল বেদখল সার্বভৌমত্ব উদ্ধারে ঝড়ের গতিতে ছুটে আসছে । মানুষের হুংকারে ঈশ্বরের শেষ কথাগুলো অস্পষ্ট শোনায় ।