কান নিয়ে কানডো

রম্য রচনা (জুলাই ২০১৪)

তাপস চট্টোপাধ্যায়
  • ১৯
ফি বছর গদাইয়ের ফাইনাল পরীক্ষার ছুটিতে আমডাঙা থেকে আচমকা নরুন মামার আবির্ভাব হয়। সজনেখালির পটল মাসী অথবা জামতাড়ার শিউলি পিসিও বাদ যায় না। কটা দিন গদাইয়ের কচুবেড়িয়ার বাড়ীটা ফল, ফুল, শাক-সবজীতে ভরে থাকে।
গদাই অবশ্য সকলের চেয়ে নরুন মামাকেই পছন্দ কের বেশী। বছরে একটা দিনই চুটিয়ে কলকাতা দেখা হয়। যত না পা চলে, মুখ চলে তার বেশী। চিড়িয়াখানার ঝালমুড়ি, বাবুঘাটে তেলেভাজা, ধর্মতলায় চাটমশলা, স্টিমার, বাস, ঘোড়গাড়ি, ট্রাম ইদানীং মেট্ররেল এককথায় জলে, স্থলে, পাতালে-ঝোলে অন্বলে সারাদিনটা কেটে যায় ভালোই।
রোদ পড়লে মামা ভাগ্নে কান্ত হয়ে কার্জন পার্কের ঘাসে বসে একটু জিরিয়ে নেয়।
হাতে খানিকটা সময় থাকলে নরুন মামা নিত্যনতুন গল্প শোনায়। হঠাৎ সেদিন গদাই লক্ষ করে পার্কের মধ্যে একটা ঝাঁপানো গাছের তলায় একটা লোক চোখ বুঝে শুয়ে আছে আর অন্য আরেকজন ঝুঁকে বসে কাটি জাতীয় কিছু তার কানের গর্ততে ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। নরুন মামা গদাইকে আস্বস্ত করে বলে যে ওরা বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছে। ওদের কাজ সারাদিন বাঙালিদের কান পরিষ্কার করা। ইংরেজ আমল থেকে, কেউ অতটা আমল না দিলেও, এই পেশা এখন ওদের নেশা হয়ে গেছে।
কান নিয়ে এই কানডো কারখানা গদাইয়ের খুব একটা পছন্দ হয় না। কারণ শরীরের ওই একটা অঙ্গেই যত না ব্যথা লাগে তার চেয়ে বেশী পায় কান্না।
মা, বাবা, দাদা, দিদি এমন কি শিক্ষক শিক্ষিকারাও বহুবার গদাইয়ের মেদবহুল দেহে যথেচ্ছ আঘাত করেও যখন হাতে হাতে প্রতিঘাতই পায় তখন 'কান ধরে ওঠবস' অথবা 'কানমলা'তেই গদাইকে বারংবার লাঞ্ছিত হতে হয়। নরুন মামা গদাইয়ের কান নিয়ে সেই ক্ষোভটা বোঝে আর তখনই সুযোগ বুঝে একটা জাঁদরেল গল্প ফেঁদে বসে। গদাইও সহজেই ধরাশায়ী হয়ে সেই ফাঁদে পা, থুড়ি কান দেয়।
গল্পটা কানদাহারের কানাত রাজার। নাম, যশ, খ্যাতি প্রতিপত্তি সবকিছুতেই দেশ-বিদেশের অনেক রাজাই কানাত রাজার কাছে কুপোকাত হতো। অন্য অনেক রাজ্য থেকে কানদাহারের বিশেষত্ব ছিলো একটু আলাদা।
এই রাজ্যের রাজা আর তার মহামন্ত্রী ছাড়া সকলেই ছিল বদ্ধকালা। শুধু প্রজারাই নয় রাজপরিবারের সদস্যরাও কানে খাটো ছিলো। এর ফলে রাজার ছিলো অনেক লাৰভ। রাজ্যসভায় বসে মন্ত্রীর কানে কানে কানাকানি কিংবা যে কোন কানাঘুষোই করোর কর্ণগোচর হতো না। রাজবাড়ীর যা কিছু কেচ্ছা কেলেঙ্কারি যেমন প্রজাদের কানে উঠতো না, তেমনই অন্য কেউ রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের কানভাঙাতেও পারতো না।
রাজা একবার কার মুখে যেন শুনেছিলো যে দেওয়ালেরও কান আছে আর সেই ইস্তক রাজাদেশে প্রাসাদের সমস্ত দেওয়ালই একদিন ভেঙে গুঁড়িয়ে সাফ্। এক কথায় কান নিয়ে কোন কথাই কানত রাজা সহজে কানে তুলতে চাইতেন না। প্রজাপালন ছাড়াও রাজার শখ ছিলো গান বাজনার। রাগ অনুরাগের নামমাত্র পরোয়া না করেই যেখানে সেখানে বেসুরে আওয়াজে কানফাটানো গান জুড়ে দিত। সভাসদ অতিথি অভ্যাগতর দল শুনতে কিছুই পেত না, শুধুই আকার ইঙ্গিতে যেটুকু বুঝতো তাতেই 'বাহ'! বাহ্! করে চিৎকার জুড়তো।
অবশ্যই রাজ প্রাসাদের অন্দরমহলে এই বদ্ধ কালাদের নিয়ে রাজা যে ফ্যাসাদে পড়তেন না, এমন নয়। কানে খাটো সব দাস, দাসী, আর্দালি, খানসামাদের সামাল দিতে প্রায়শই নাকানি চোবানি খেতেন। যেমন তেল বললে বেল, আদা বললে গদা, পান বললে ধান, সুপারি চাইলে মশারি, মুড়ি বললে বাড়ি, পায়েস বললে দরবেশ এমনি নানান্ ভুলভ্রান্তির শেষ ছিলো না। তবুও রাজা বেশ সুখেই ছিলেন।
কিন্তু সে সুখ বেশী দিন সহ্য হল না। হঠাতই একদিন কানে কানে রাজার কানে এলো যে ভিনরাজ্যের কিছু দুষ্টু লোক এ রাজ্যের প্রজাদের কান সাফ্ করছে। আর তাতেই প্রজারা বেশ সাফ শুনতেও পাচ্ছে।
- এদের সাফায় না করলেই নয়, রাজার সাফ্ হুকুম।
রাজা বেজায় চটেছে দেখে সেনাপতি, উজির, আমলারা চটজলদি একটা সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ঠিক হল প্রজাদের খোলামেলা কান'কে খোলা রাখা আর সমুচিত হবে না। অতএব যেন তেন প্রকারেণ, 'প্রেম প্রীতি' নতুবা 'ভয় ভীতিতে' ডাইনে বাঁয়ে দুই কানের গহ্বরকে জব্বর ভাবে বন্ধ করতেই হবে। অতএব সব মান অভিমান ছেড়ে জারি হলো ফরমান।

'কোরো না কো কান সাফ্,
খাজনা হবে মাফ্।
যাদের নেইকো চালচুলো,
কানে তারা লাগাও তুলো।
রাজা দেবেন নজরানা,
কেবল যারা শোনে না।'

ব্যস এই এক ঔষধেই কাজ হল বেজায়। সকাল থেকে দলে দলে প্রজারা রাজবাড়ীতে হত্যে দিতে লাগলো শেষ হলো বস্তা বস্তা তুলো। যেমন যতটুকু পেলো দুকানের গর্তে চালান দিলো।

কানে কিছু শুনো না
খাজনা দিতে হবে না।

এমনি করে বেশ কিছুদিন পার হলেও পার পাওয়া গেল না। কান সাফাই অভিযান কোনভাবেই সাপটানো গেল না। এদিকে খাজনা মোকুব আর নিত্যনতুন নজরানার বাহানায় রাজকোষ প্রায় শূন্য হতে বসলো। অন্যদিকে সাফাই অভিযানে সাফল্য আসা দুরে থাক গোটা রাজ্যে তুলো নিয়ে বাধলো তুলকালাম কান্ড। গোটা নগরীর, এমনকি অন্দরমহলের তোষক, তাকিয়া, বালিশ সব ছিঁড়ে কুটি কুটি ছোর-কুটি করেও তুলো যোগান দিতে পারা গেল না। এদিকে মন্ত্রী সান্ত্রীরা রাজার কাছে তুলোধোনা হয়ে গলদঘর্ম। অবশেষে রাজনীতির কুটচালিতে পারদর্শী কৌটিল্য বৃদ্ধ গোলক চাঁদের ডাক পড়লো রাজসভায়।
বয়সে প্রায় শতবর্ষের দোরগোড়ায় হলেও রাজভোগের অতিশয্যে চলাফেরায় যথেষ্ট স্বাবলম্বী। কারদাহারের প্রজা হিসাবে গড়নে পিটনে লম্বা হলেও কানে যথেষ্ট খাটো। অতএব স্বয়ং রাজা অযথা বাক্যরাশী ব্যবহার না করেই ইশারায় রাজ্যের বর্তমান সঙ্কট এবং সমাধানের রাস্তা বাতলাতে বললো।
বৃদ্ধ গোলক চাঁদ হঠাৎই রাজা, মন্ত্রী, সভাসদ সকলকে গোলকধাঁদায় ফেলে বলে ওঠলো।

- শুধু শুধু কেন এই ইশারার জারিজুরি
আমি তো এখন সবকিছু শুনতে পারি।
রাজা করুন মাফ,
আমাদের সবারই কান সাফ।

বৃদ্ধ গোলক চাঁদের কথায় রাজার সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে যায়।
ততক্ষণে রাজসভা জুড়ে শুরু হয় গোলযোগ।
সকলের মুখে মুখে তখন মুখ্য কথাই ছিলো,

রাজা করুন মাফ
আমাদের সবারই কান সাফ।

অসহায় রাজার কাতর দৃষ্টিতে ব্যথিত হয়ে
অবশেষে গোলমাল থামিয়ে গোলক চাঁদের উপদেশ হল এই-

কি লাভ অহেতুক তুলোর অপচয়ে,
তুল্যমূল্যে রাজ্যশাসন,
মহারাজ, করুন নির্ভয়ে।
উক্তি, হোক কটূক্তি,
যাই আসে কর্ণগোচরে,
গ্রহণ করুন তাহা, সমভাবে সমাধারে।

বিকেল পড়ে এসেছিল। গোটা কার্জন পার্কটা বেশ ছায়া ছায়া লাগ ছিলো। গদাই এতক্ষণ নরুন মামার গল্প শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গিয়েছিলো। ক্ষুধার্তও বটে, এখন বাড়ীর কথা মনে পড়লো। মামা ভাগ্নে দুজনেই ধর্মতলায় দুটো করে গরম কচুবেড়িয়ার পথে পা বাড়াল।

(গল্পের স্থান, কাল, পাত্র এবং পরিবেশ নেহাতই লেখকের কল্পনাপ্রসূত।)
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শামীম খান সুন্দর রম্য গল্প । অনেক ভাল লেগেছে ।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি কোরো না কো কান সাফ্, খাজনা হবে মাফ্। যাদের নেইকো চালচুলো, কানে তারা লাগাও তুলো। রাজা দেবেন নজরানা, কেবল যারা শোনে না।' ০০০ অনেক ভালো লাগলো তাপসদা ০০০ আমার আঙ্গিনায় আপনার নেক কদম পড়লে ভালো লাগতো ০০০০
মালেক জোমাদ্দার দাদা বেশ ভালো লেগেছে , আমার লেখাটি পড়ার অনুরোধ থাকলো. শুভকামনা রইলো
ডা: প্রবীর আচার্য্য নয়ন উক্তি, হোক কটূক্তি,যাই আসে কর্ণগোচরে,গ্রহণ করুন তাহা, সমভাবে সমাধারে।-খুব শিক্ষনীয়... ভালো লেগেছে
মিনতি গোস্বামী ভালো লিখেছেন.আমার গল্প ও কবিতার পাতায় আসবেন.
ওয়াহিদ মামুন লাভলু কান নিয়ে চমৎকার হাস্য-রসাত্মক লেখা উপহার দিয়েছেন। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
প্রজ্ঞা মৌসুমী জাদরেল গল্পে আমিও পা থুড়ি কান দিয়ে ফেলেছি। মাঝে মাঝে প্রবাদ শুনি, ভাবতাম কিভাবে এসব আসলো? যদিও কল্পনাপ্রসূত, কান নিয়ে প্রবাদগুলোর পেছনের কারণ গল্পে চমৎকার তুলে ধরেছেন। আর মাঝে কবিতাগুলোও বেশ লেগেছে।

১৭ জুন - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ২৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী