ছিন্তাই, মিন্তাই

উপলব্ধি (এপ্রিল ২০১৬)

rashed অভ্র হাসান
আপনি কি ঢাকায় থাকেন? ভালবাসেন এই শহরকে? জানেন-ই তো এই শহরে রাতে বা খুব ভোরে বাস টাির্মনালে বাস এসে থামলে, ট্রেন ষ্টেশনে ট্রেন এসে থামলে, বিমানবন্দরে বিমান থেকে নেমে, অথবা সদরঘাটের লঞ্চ টাির্মনালে লঞ্চ এসে ভিড়লে চট করে বাসায় ফেরার কথা ভুলেও ভাবা যাবে না, কখোনোই ভাববেন না, ঘাপটি মেরে ওখানেই চুপচাপ বসে থাকেন, ভুলেও বলবেন না, এইতো কাছেই বাসা, চট করে রিক্সা নিয়ে বা হেঁটেই চলে যাবো, কাছেই তো! এমন কথা ভেবেছেন বা করেছেন তো, ব্যাস, মহাবিপদ, নিজের পায়ে নিজে কোপ মারবেন, দা বটির কোপ না, চাইনিজ কুড়ালের কোপ। কি, বিশ্বাস হয় না? আমাদের মিঠুর গল্পটা শুনুন। তারপর যদি আপনার বিশ্বাস আর উপলব্ধি হয়। জেনে রেখেন, বিপদ কিন্তু পদে পদে আছে এবং আসেও।
আমার নাম মিঠু, বয়স ৩৩, একটা প্রাইভেট কোম্পানী তে কামলা খাটি, কোন রকম দিন গুজরান করি বলতে পারেন, মাসের বিশ / বাইশের পর ধার কর্য শুরু করা লাগে। যাদের থেকে নেই তারা আমাকে দেখলে ভয়ে পালায়, আবার নতুন যাদের কাছে চাইব, তারা ঠিক ধার টার দিতে ভরসা পায় না, যা দিন কাল যাচ্ছে।
আমি আমার বোকা সোকা স্ত্রী লুনা আর আমাদের একমাত্র মেয়ে কান্তা, এই তিন মাথা থাকি মগবাজারের ডাক্তার গলির শেষ মাথায়, নিজের বাড়ি না, ভাড়া থাকি, ছয়তলায়, দুইরুমের ফ্ল্যাট, এখানে লিফট নাই, ঘুপচি গলি, অন্ধকার, ভাড়া একটু কম, পানি ধরে রাখতে হয়, তাতে কোন সমস্যা নেই, শুধু লিফট নাই আর তাতে-ই লুনা অতি বিরক্ত, রাগে গজগজ করে সে, সিড়ি ভেঙে যাওয়া আসা করতে তার দম ফুরিয়ে গেলেও, আমি মোটেও দম ছাড়ি না, দম নিতে নিতে বাজারের ব্যাগ আর বাচ্চা কোলে কোলে ওঠানাামা আমার একরকম প্র্যাকটিস হয়ে গেছে, বাচ্চা ছানাটা আমার কোলে চোড়ে ঘাড়ের কোণে মাথা গুজে নিশ্চিন্তে ঘুমায়, আমি সিড়ি ভাঙতে থাকি, পয়ত্রিশ, ছত্রিশ..চল্লিশ ! লুনা আবারও রেগে যায়, বাসা বদলের আব্দার করে, আমি ধুউর তেরি বলে সবকিছু উড়িয়ে দেই, সে আমাকে অলরেডি দুইদফা থ্রেট করেছে বাসা বদলের, আমি মোটেও গায়ে মাখাই না। যাও বাবা ছেড়ে দাও, চলছে চলুক টাইপ বুঝ দিয়ে রাখি! আমার শ্বশুর কুলের আত্মীয় স্বজন আগে টুকটাক তাও যেতো আসতো, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, কষ্ট করে ছয়তলা উঠে লাল চা আর হরলিক্স বি¯কুট খাওয়ার কোন মানেই হয় না ! আগে তাও ছাদ ছিল বসা টসা যেত, এখন সেটা বন্ধ, বাড়ীওলির নাতনি কবুতরের ফার্ম করবে, কবুতর নাকি লাখ টাকা দাম, একদিন দেখতে হবে কোন কিসিমের কবুতরের এত দাম, সব আজিব লাগে আমার।
খুব আফসোস হয় জানেন, একসময় আমার বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা শ’খানেক থাকলেও এখন তা নেমে এসেছে ৪/৫ জনের কোটায়, তার মধ্যে যারা আমার মত দরিদ্র তারা শুধু আমার সাথে খুব সখ্যতা রেখেছে, চাওয়া পাওয়ার সুতায় আটক সম্পর্ক আর কি! আমিও হ্যাঁ হু করে তাল মেলাবার চেষ্টা করে ব্যার্থ হচ্ছি, সংসার খরচের সাথে বন্ধুত্ব’র সমীকরণ মেলে না। কত কিছু চিন্তা ভাবনা করতে হয় আমাদের, কত কিছুর সাথে মানুষ আপোষ করে মেনে নেয়, লুনার জন্য আমার সত্যি সত্যি মাঝে মাঝে কান্না পায়। এর পরে প্রমোশনটা পেলেই ভালবাসা’র সাথে ভাল একটা বাসায় ওকে ওঠাব, ও মনের মত সাজাবে, আর আমি ওকে ভালবেসেই যাব, বেসেই যাব।
আমার স্কুল জীবনের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু তারেক থাকে আমেরিকাতে, সেখানে সে কি একটা কম্পিউটার সফটওয়্যার কোম্পানীতে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর অত বেশী বুঝি না, তারেক যখন খই ভাজার মত ফটফট ইংলিশ বলে টেকনোলজির আলাপ করে, আমার হার্ডডিস্ক, র‌্যাম, রম, মাদার বোর্ড সব হ্যং হয়ে যায়, খুব হতাশ লাগে তখন, যদিও আমি টুকটাক দু’চার লাইন উত্তর দেই, বেশীর ভাগ ও-ই বলে আর আমি ইয়া ইয়া বলে মাথা নাড়াই। বেচারার আমেরিকান বউ আর সংসার করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কি সব গালি টালি দিয়ে বিদায়ও নিয়েছে, এখন সে তারেকের থেকে মাসে মাসে মোটা অংকের ডলার পায় আর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, গাড়ী বড়ি ও করেছে। তারেক আমাকে দেশী বউয়ের ভুয়সি প্রশংসা পূর্বক বলেছে, আমি যেন লুনাকে মাথায় তুলে রাখি, দেশী বা বিদেশী সব বউ তো আর লুনা টাইপ ভাল হয় না, বিদেশী হলে তো কথাই নাই। দুষ্টুর দুষ্টু বদের বদ। আগামী ডিসেম্বর মাসে তারেকের দেশে ফেরার কথাটা আর আমরা দুজন ঢাকার বাইরে একটা কাজে যাবো এই ব্যপারটা লুনাকে আমি বলেছি, সে স্বভাবিক ভাবে নিয়েছিল, আমি তাকে মোটেও মিথ্যা বলি না। একদম মিথ্যা বলি না তা নয়, মাঝে মাঝে অবশ্য মিথ্যাটাকে গুছিয়ে সত্যের মত করে বলতে হয়, তাতে সাপও অক্কা পায় লাঠিও ঠিক থাকে । লুনা কিছু বলে না, হয়ত একদিন বিষ্ফোরন হবে। হয়ত একদিন ভালবাসা থাকবে না।
শুনেছি প্রবাসী বাংলাদেশী লোকজন দুনিয়ার কিপ্টা হয়, আর আমার বন্ধু এদিক থেকে টপ, সে আমাকে নিয়ে বেশ কিছু প্ল্যান করেছে যার অনেক কিছুই আমি পরিস্কার জানি না, জানি না বলতে যে একদম জানি না, তা নয়, একেকবার একেকরকম প্ল্যান হয়, কাজেই বুঝতে পারছি না কোনটা কখন ঘটবে! প্ল্যান গুলো ডিপেন্ড করে সময় ও অর্থ সাশ্রয় এর কথা মাথায় রেখে, যেহেতু ও আমাকে নিয়ে পটুয়াখালী ওর দাদাবাড়ি যাবে আর আমি ওর দেখভাল করার জন্য থাকছি, কাজেই আমার কিছুটা সময় ফ্রি থাকা বা ফ্রি রাখা দরকার ছিল ওর জন্য-ই। ও নাকি সে জন্য আমার কাছে চির কৃতক্সগ থাকবে, আরও কি কি সব বলে! বোঝেন না, ফরমালিটিস আর কি! ও আমাকে নিয়ে খেতে বসলে, আমি গপগপ এটা সেটা খাই আর ও একটা কদাকার তিতা কালো কফি নিয়ে বিরষ বসে থাকে আর অদ্ভুত অদ্ভুত ফিলসফিক্যাল ডায়লগ দেয় (অবশ্য ইংলিশ-এ)

তারেক ডিসেম্বর এ দেশে আসলো, ওর সাথে ঢাকার বাইরে যাবার সময় সম্বল বলতে আমার সাথে একটা উইন্ডোজ ফোন (অনেক কষ্টে শিষ্টে কিনেছিলাম), হাতঘড়ি, অফিসের কাগজপত্র সহ ব্যাগপ্যাক, একটা টি শার্ট, গামছা, চাবির রিং মানিব্যাগে কিছু হাতখরচের টাকা, দরকারী অদরকারী সব ভিজিটিং কার্ড একটা এটিএম কার্ড ইত্যাদি, বুঝতেই পারেন পুরুষ মানুষের সাথে এর থেকে বেশী কি আর থাকতে পারে, একদিনের ঢাকার বাইরে যাওয়া আসা। আমরা সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে যাবো, লঞ্চের টিকিট আমি করেছি. ব্যটা বলে কি, কেবিন নেবার কি দরকার, কমন সিটে চলে যাই, পয়সাও বাঁচলো, দুইজন গল্পও করলাম, মনে মনে ভাবলাম তোমার সাাথে গল্প করা মানে তো ইংলিশ মুভি! ইয়া ইয়া করা ছাড়া আর কি বলার আছে, তবু বন্ধুর মন রাখা, ঠিক আছে তা-ই সই। সারাটারাত মশার কামড় খেতে খেতে, অর্ধেক শরীর সোফায়, অর্ধেক টা মাটিতে রেখে থেকেছি, ঘুমে আমি শেষ, তাকানোই দায়, আর ওদিকে বন্ধু আমার মোবাইল ফোন, ইস্টারনেটে বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিয়ে আর টিভিতে কলকাতার এক বাংলা ছবিতে তাকায়ে থেকে আর মুহুর্মুহু সিগরেট খেয়ে রাত পার করেছে, এটাই আমার প্রথম লঞ্চ সফর, কি বিচিত্র দেশ, বিচিত্র মানুষের জীবন আর বেঁচে থাকবার প্রানান্তকর চেষ্টা লঞ্চঘাট গুলোতে এটা মনে হয় ভাল বোঝা যায়, এক মহিলা তো হঠাত করে বুক ফাটা আর্তচিৎকার, কি হয়েছে জানতে চাইলাম, শুনলাম তার সাথে এক লোক যে তার পাতানো চাচাতো ভাই! দুই দিন ধরে সঙ্গে আছে, সুযোগ বুঝে সর্বস্ব নিয়ে চম্পট, কি কি নিয়েছে সে প্রসঙ্গে না হয় না-ই বা আলাপ করলাম। যা কঠিন দিনকাল পড়েছে, মানুষ আপন ভাই বোনদেরকে-ই বিশ্বাস করে না, তার আবার চাচাতো মামাতো! সব ধান্দাফিকির, ধরিবাজি।
রওনা দিলাম বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটায়, শুক্রবার সকালে পটুয়াখালী পৌছে তারেকের এক ফুফাতো বোন আর দুলাভাইয়ের পরিবারে সারাদিন থাকলাম, এরা সব এত্ত এত্ত কথা বলে বাব্বা, কথার ওপর ট্যাক্স বসালে... ! চারজনের পরিবারে কম টাকা উঠত না । তারেকের বোনের বানানো নানান পদের খাবার খেলাম, গ্রামে গেলাম, মসজিদে নামাজ আদায় করে তারেকের দাদা দাদীর কবর জিয়ারত করে ফকির খাইয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো এমন প্ল্যান, ফকির খাওয়ানো আর গ্রামের পলিটিক্সের চক্করে পড়ে আমরা তো দিশেহারা, আমি তো এ বিষয় কিছুটা বুঝি কিন্তু তারেকের চশমার ভেতরের দুই চোখ যখন আমার দিকে কোয়েশ্চেন মার্ক করে তাকায়ে থাকে, কনফিউজড হয় আমি তখন পরি¯িহতির দ্রুত সামাল দেই। এরা এমনই বুঝলা বন্ধু, একদিকে দিবা অন্যদিকে ফাঁকা, আবার এপাশে নেবে ওপাশে দোষ ধরবে! তারেক গভীর ভাবে সমস্যার পর্যবেক্ষন করতে লাগল আর ক্ষানিক পর পর ঢাকায় তার বিচক্ষণ বাবার পরামর্শ নিতে লাগল, কেমন এফবিআই এফবিআই লাগছে, দেশের জটিল সমস্যা মনে হচ্ছে! তবে তা শেষমেষ সামাল দেয়া গেল।
শুক্রবার রাতে ঢাকা ফেরার সময়, লঞ্চে এবার সিঙ্গেল কেবিন পওয়া গেল, তাতেই দুই বন্ধু খুশি, শীতের সময়, কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামে ঘুমিয়ে ফিরব, আমার মোবাইল ক্যামেরা তে তারেকের ভিলেজ কর্মসূচি’র যে কয়টা ছবি তুলেছিলাম, তারেক ব্লূ টুথে তা নিল, আমাকে অনেকবার ধন্যবাদ দিল, সময় মত সব পরিশোধ করবে এমনটাও বলছিলো, বিদেশে যেমন করে বলে মানুষ সেরকম, কি›তু আমি তো কিছু পাবার আশায় ওকে সহযোগিতা করি নাই, আমার ভেতর সেটা নাই। রাতে শোবার আগে আগে নানান গল্প করলো সে, এত্ত এত্ত ইংলিশ বলে লোকটা, আমি তো চাইনিজদের মত ছোট সরু চোখে তাকায়ে গল্প শুনি আর বলি তারপর, তারপর, তারেক দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে থাকে, বেশীরভাগ ইংলিশ কথাতে-ই ‘ফ’ যুক্ত শব্দ, শুব্দের শুরতে ফ, শেষে ‘ফ’ , বাক্যের শুরুতে যেমন, শেষেও, উহ্ ‘ফ’ রে ! আবার বলে কি, দেখো দুই পুরুষ এক বিছানায়, অন্য কিছু না হয়, বলে কি কি সব ইঙ্গিত করে ঘাড় দুলিয়ে হাসে আর ওসব কথা বলে, আমি দিশেহারা, আমি ঘুমে পুড়ে যাই, আমার মনের নোঙর পড়ে থাকে মগবাজারের গলিতে..! কে বুঝে কার দুঃখ!
ভোর সাড়ে চারটায় লঞ্চ সদরঘাটে ভিড়ল, কুটকুটে কালা পানির চারপাশে হায়রে মানুষ আর মানুষ, কোটি কোটি মানুষের জটলা এখানে, হৈ হৈল্লা, রিক্্রা গাড়ির শব্দ, আমার কল্পনাতেই ছিল না এত মানুষ একসাথে এত ভোরে এখানে দেখতে পাব। ঢাকায় খেকে বড় হয়েছি অথচ ঢাকার হাল হকিকত অনেক কিছুই অজানা। একবার আমার আরেক বন্ধু আর আমি রিক্সায় ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে, পিস্তল সহ সিভিল পুলিশ দেখে ভীষন ঘাবড়ে গেছিলাম, ও অবশ্য সাহসী, ও আমাকে দূর থেকে দাড়িয়ে দেখিয়েছিল রমনা পার্কে সন্ধ্যা বেলায় নিশিমেয়ে’রা কি াক করে সিভিল পুলিশ কিভাবে টাকা তোলে ইত্যাদি, আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, এরকমও হয়!
তারেক ঘুমিয়ে, ঠেলে জাগাতেই বলল, এখন এত ভোরে বের না হয়ে আরেকটু ঘুমাই বন্ধু, আমার তো আর ঘুম আসে না, আমি তো অ¯িহর, কতক্ষণে বাসা যাব, কতক্ষণে কান্তাকুন্তা কে দেখতে পাব (মেয়েটাকেআদর করে কান্তাকুন্তা ডাকি, আর বউকে ডাকি লু)। তারেক কে বললাম চল বের হই, আমার ভাল লাগছে না এই দুর্গ›ধ পানিতে বসে থাকতে, হারামজাদা বিড়ি টানতে টানতে বলে কি, কে বলেছে তোমাকে বসে থাকতে, কাম এন্ড স্লিপ বিসাইড মি! এত রাতে বের হলে সব কেড়ে কুড়ে রেখে দেবে। রাগে আমার.. ! পরে ভোর পাঁচটায় আমরা রিক্সা চেপে বসলাম, সিএনজি পেলাম না, তারেকের বাসা শান্তিনগর হয়ে মগবাজার আমাকে নামাবে, রিক্সা ভাড়াই নেবে ২০০ টাকা, আর সিএনজি মনে হয় ৫০০ টাকা চাইত! সেলুকাসের রাজত্ব, যার যেমন খুশি চলে, চায়, নেয়, কিচ্ছু করার নেই। এটাই নিয়ম।
রিক্সা চলতে শুরু করেছে, রিক্সাওলা চেংড়া বয়সের, এই ঠান্ডাতেও সে হাফ হাতা শার্ট পরে ফুরফরা চালাচ্ছে, আর যত ঠান্ডা সব লাগে আমাদের। তারেক যেতে যেতে যথারীতি সেই গ্রামের গল্প, কি হল না হল, বিশেষ বিশেষ মেয়েদের নিয়ে আলাপ আর থ্যাংকস দেবার গান একনাগারে গেয়েই চলেছে, আমি তো ভেতর ভেতর তড়পাচ্ছি, বাসায় কখন যাবো, কান্তাকুন্তা কি করে, আজকে কি বাজার লাগবে, যদিও লুনা জানে, রাতে কথা হয়েছে রওনা দিচ্ছি। নাস্তা টাস্তা আছে কিছু নাকি কিনতে হবে। সাড়ে পাচটায় শািন্তনগর মোড়ের কাছে তারেকের এপার্টমেন্ট বাসায় ও কে নামায়ে, হ্যান্ডশেক পর্ব সেরে রিক্সা চাপলাম, রিক্সাওলা গল্প জুড়ল, মামারা কি বিদেশ থায়েন? কোন দেশ? ইত্যাদি।
রাস্তায় তখন দু’একজন মানুষ দেখা যায়, ঘড়িতে তখন পোনে ছ’টা মতন বাজে। শীত কম তবে মানুষ জাব্বাজোব্বা গরম কাপড় লাগায়ে অ¯িহর, শীত থাকুক না না থাকুক জ্যাকেট সইটার থাকতেই হবে। আমি রিক্সায় একা, হাতে একটা পলিথিন ব্যাগে কালরাতের রাখা কিছু খাবার আর পিঠে ব্যাগ, একটা সিগারেট ধরাবো কিনা মনে মনে ভাবছি আর রিক্সাওলা বলল বায়ে যামু মামা? দেখলাম ভিখারুননিসার পাশের গলিতে ঢুকে বের হবে কিনা জানতে চাচ্ছে, আমি ভাবলাম যাক আর কি, যত শর্টকার্টে বাসা পৌছানো যায় তত ভাল। দুই মিনিট যেতে না যেতেই একটা মেরুন রঙের গাড়ী হার্ডব্রেক করল, শব্দ পেলাম, ওমনি দুই দিক থেকে দুইজন দরজা খুলে নেমে গাড়ীর পেছনের বনেটে হাতের কি যেন একটা দিয়ে জোরে বড়ি মারল আর শব্দ করে উঠল ওইত..খাম। ভয়ে আমার তো জান শুকিয়ে নাই! শেষ আমি, দেখেই মনে হল চাইনিজ দা, এক কোপে ঘাড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে য়াবে! মরেই গেলাম রে। রিক্সাওলা তখন রিক্সা ফেলে অন্যদিকে পালিয়েছে, আমার হাতের থেকে পলিথিন ব্যাগ টা নীচে পড়ে গেল, সর্বোচ্চ ৩/ ৪ মিনিট লাগল আামার সর্বস্ব খোয়াতে!
আমাকে কিছু করতে হয় নাই, দুই ভদ্রলোক বিনয়ের সাথে একজন আমার পেছনে বন্দুক আর চাইনিজ দা, আরেকজন আমার সামনে বন্দুক আর চাইনিজ দা, কি মধুর ব্যবহার তাদের, কি অমায়িক দু’জন বন্ধু, যেন ওদের ই ইসব জিনিষ, আমার কাছে ছিল, চাইতে এসেছে। আমাকে বলে, ঘড়ি দে, মোবাইল দে, মানিব্যাগ দে, আওয়াজ করবি না খবরদার, জানে মাইরালামু, আমি বন্দুকের দিকে তাকায়ে একবার ভাবলাম নকল মনে হচ্ছে, জিজ্ঞেশ করে দেখব কিনা, ভাই জিনিসটা কি আসল? নাকি নকল?
আবার ভাবলাম থাক যা চেহারা আর মারমুখি ভঙ্গি, জানটাই নিয়ে নেয় কিনা, কে জানে! যদি বলেই বসে, নে টেস্টু কইরা দেখ আসল না নকল, ঠাস ঠাস, আমার পা জোড়া অসাড় হয়ে যায়, আমার মাথা শূন্য হতে থাকে, মুহুর্তেই আমার কান্তাকুন্তা আর লু এর কথা মনে হল, আর পাএর তলায় থরথর কাপনের টের পেলাম, যদি সত্যি সত্যি মেরে ফেলে, আর দেখা হবে না প্রিয় দুই মুখ, আর সকাল বেলা অফিস যাওয়া হবে না, আর কুদ্দুস আমাকে গরম সিঙ্গারা আর লাল চা খাওয়াবে না, আমি কি অজ্ঞান হয়ে গেছি? আয়তুল কুরসি ও তো মনে আসছে না।
সামনের জন যখন সব নিয়ে সাফা তখন পেছনের জন আমার কোমরে নলের খোঁচা দিয়ে রেখেছে, বলল, ব্যাগ দে, দিলাম,
বলল জ্যাকেট খোল, খুললাম, এমা, কাপড় চোপড় খুলে দিগম্বর করে দেবে নাকি এরা! আমি তো টেনশনে শেষ। পেছন থেকে গলায় হাতড়াতে লাগল, বলল চেন দে, আমি কেঁদেই ফেলি, ভাই চেন পরি না। আমাদের পাশ দিয়ে একটা সিএনজি দ্রুতচলে গেল, দেখেও থামলো না, কি জানি কি হয় ভেবে। চার মিনিটের অপারেশন শেষে সব নিয়ে গাড়িতে উঠে চম্পট দিল তারা দুই ভদ্রলোক। আমি বাকশূণ্য অনেক্ষন তাকায়ে থাকলাম, গাড়ীর নম্বর প্লেট টা যে দেখব, সে কথাও বেমালুম ভুলে গেলাম আর তাছাড়া আকাশ পরিস্কার হতে থাকলেও আমার চোখের পাতায় গাঢ় অন্ধকার। রিক্সাওয়ালার কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম, মামা মাইর দেয় নাই তো? না মারে নাই, তবে আদরও দেয় নাই, ভাল আছে।

রিক্সাওয়ালাকে সঙ্গে নিয়ে রমনা থানায় গেছি, সেখানে ওসি সাহেবের আরেক নাটক, আমি বাঁচি না আমার য›ত্রনায়, উনি বলেন আপনার কোম্পানী তো বেশ নাম ডাক, অমুক কে চেনেন, ভাল মানুষ ছিলেন, আমার পরিচিত! আমি অনেক কষ্টে হাসি চাপলাম, চোখেমুখে তীব্র কষ্টের ধারায় অনুনয় করে বলেই ফেললাম, স্যার আমার জিডি টা এন্ট্রি করুন প্লিজ, স্যার আমাকে কাগজ কলম দিলেন।
বাসায় ফিরে কান্তাকুন্তার আর তার মা’কে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষন বসে থাকলাম, কত কত সময় আমি ওদের কষ্ট দিয়েছি, কত কত সময় আমার মনে হয়েছে যে আমি যা নই তা-ই আমি হবার জন্য জুজুর পিছে ছুটছি, আবার কত কত সময় আমার মনে হয়েছে যে, একটা মিথ্যার আবরনে আামি নিজেকে আড়াল করে রেখেছি। হয়ত সত্য, হয়ত মিথ্যা হয়ত কিছুই না, একসপ্তাহ লাগল আমার ধাতস্ত হতে, ঘুম আসে না, খেতে পারি না, টেনশন লাগে, কি যে এক দুরব¯হা ! দু’একজন কলিগ তো হেসে বলেই ফেলল, মিয়া এইরম একটা শরীর নিয়া ভয়ে সব দিয়া দিলেন, কিছু কইতে পারলেন না, আমি হাসি, বলি, ভাইরে, বলতে তো পারতাম, যদি ঠুশ হয়ে হাসপাতালে যেতাম, তখন তো বলতেন, অত কথার কি দরকার ছিল, দিয়ে দিলেই হইত!

তারেকের মহানুভবতায় নতুন একটা ফোনসেট পেলাম ঠিকই, কিন্তু আমার একটা ছোট্ট উপলব্ধি হল, আমরা কেউ-ই হয়ত বাইরে তেমন নিরাপদ নই, কিšতু এটা তো ঠিক যে, আমরা পরিবারের কাছে, নিজের কাছে ব›ধুর কাছে প্রতিবেশীর কাছে, আত্মীয় বা কলিগের কাছে নিরাপদ, বিশ্বাসযোগ্য আর সমাদৃত। আমরা একজন আরেকজনের জন্য ক্ষতিকর নই। আর তাছাড়া, নিশ্চয়ই আমার ভেতর কোন না কোন খারাপ আর অন্যায় আছে যা আমাকে আজ অবলীলায় দুর্ঘনার সম্মুখীন করে দিল, আমি তো নিয়তিতে বিশ্বাসী নই, আবার আমি তো কখনও কারো অমঙ্গল ও করি নাই। এটা এক ধরনার জটিল উপলব্ধি, মাঝে মাঝে আবার এমনও মনে হচ্ছে, আজকের এই ছিনতাইকারীর হাত থেকে আহত না হবার অর্থ হচ্ছে, যা ভাল হয়ে যা, এখনও সময় আছে।

আচ্ছা ঠিক আছে, ধরেই নিলাম, এটা ভাল হয়ে যাবার একটা ইঙ্গিত, এর পর থেকে, ডানে বায়ে আগে পিছে অনেক চিন্তা ভাবনা করে চলব, কখনই তাড়াহুড়া করব না, অকারনে টাকা পয়সা নষ্ট করব না (যদিও নষ্ট করবার মত যথেষ্ট পরিমানে টাকা পয়সা নেই আমার!) কারো ক্ষতি করব না, কারো অমঙ্গলও চাইব না, বেশী চাহিদাও রাখব না, বেশী রাখলেই তো বেশী খরচ, বেশী চলে যাওয়া, আমি, আমার লু আর কান্তুাকুন্তা মিলেমিশে সুখ দুঃখ হাসি কান্না আনন্দ নিরানন্দ নিয়ে নিরাপদে বেঁেচ থাকব, তখন নিশ্চয়ই ছিন্তাই মিন্তাই আর হবে না, কি বলেন?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রেজওয়ানা আলী তনিমা গল্পের ভঙ্গিতে সরলতাটা খুব ভালো লাগলো, তবে বর্ননা অংশটা কমিয়ে কথোপোকথন অংশ আরও বেশী থাকলে ভালো হতো।
মোহাঃ ফখরুল আলম ভাল লেগেছে। ভোট দিতে মন চায়। আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
শামীম খান স্টাইলটা ভালো লাগলো । কলমের গতি আছে । লিখতে থাকুন । শুভকামনা রইল ।
অনেক ধন্যবাদ ..
নাস‌রিন নাহার চৌধুরী মোরাল অব দ্য স্টোরি: সাবধানের মার নেই। গল্পে ভোট দিলাম ।
ধন্যবাদ ভাই।। অনেক অনেক ধন্যবাদ ..।..
ইমরানুল হক বেলাল সুন্দর একটি গল্প। শুভকামনা রইল।
রুহুল আমীন রাজু অনেক ভালো লাগলো গল্পটি.

১৮ ফেব্রুয়ারী - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী