স্বাধীনতার আনন্দে

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১৩)

মিজানুর রহমান রানা
  • ১১
  • ১১
এই জায়গাটা একদম ভয়ের ...। পিচের পথ জেলা শহর থেকে বেরিয়ে মাইল খানেক উত্তরে এসে বায়ে বাঁক ফিরে বাগানে ঢুকে হাজার দুয়েক গজ একে বেঁকে এগিয়ে নদীতে নেমেছে, তারপর ওপারে উঠে গ্রামের ভিতর দিয়ে রাজধানীর দিকে বোয়ে গেছে ...
জায়গাটা কুখ্যাত! পথের এপাশে ওপাশে প্রায় মাইল তিনেক বাগান। প্রখর সূর্যের দিনেও এখানে অন্ধকার ঝিম ধরে থাকে। অশরীরি আতংকের সাথে পথের উপর ঘাপটি মেরে থাকে দাড়াস কালকেউটে। হঠাৎ হঠাৎ পথের এ পাশ থেকে ওপাশে পার হয় দেখতে ভয়ংকর সরীসৃপ আর শেয়াল, বন বিড়াল, বাঘডাসা তো সাধারণ!

বছরে এখানে দু’একটা লাশ পড়ে, প্রায়ই ছিনতাই ডাকাতি হয়, সন্ধ্যার পর পারত কেহ এ পথে আসে না। যদিও ওপারের মানুষের শহরে যাবার এই একটাই সড়ক। অবশ্য নদীপথেও যাওয়া যায়। কিন্তু সে অনেক ঘুরে, সময় প্রচুর লাগে। সেক্ষেত্রে যারা শহরে যায় তাদের চেষ্টা থাকে সন্ধ্যার আগে নদী পার হওয়া। আর সন্ধ্যার পরে আসলে আসে দলবেঁধে।

ঘাটে নৌকা আছে। কেস্টমাঝির বাঁ চোখের যায়গায় একটা প্যাচপেচে বিভৎস গর্ত। ইতিহাস গবেষকরা হয়তো বের করতে সক্ষম হতেও পারে যে ঠিক কত আগে ঐ গর্তে চোখ ছিল।

সন্ধ্যার সাথে তিনজন মানুষ উদিত হয়, যেখান থেকে পথ বায়ে মোড় ফিরে বাগানে ঢুকেছে সেই মোড়!
তিনজনের একজোন খুব লম্বা, আর স্বাস্থ্যঅলা। অন্য দু’জন গাট্টাগোট্টা মাঝারি। লম্বাজনের পরনে মোটা পশমী কাল কাপড়ের কাবলি ড্রেস। অন্য দু’জনের প্যান্ট সোয়েটার। তিনজনেরই মাথা-মুখ মাফলারে পেঁচানো।
লম্বাজন মাফলার সরিয়ে নিজের কান আর মুখ বের করে। তারপর চাপাস্বরে মোবাইল ফোনে কথা বলে। দ্রুত কথা শেষ কোরে সাথের দু’জনকে হাতের ইশারায় তাড়া দেয়, তারপর তিনজন দ্রুত পথের বা পাশের মাথা সমান উঁচু ঘন ঝোপের আড়ালে নিজেদের নিয়ে যায়। আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে সতর্ক অপেক্ষা করে।

শহরের দিক থেকে এক যুবক হেটে আসে।
পূর্ব নির্ধারিত অভিসন্ধি ঝোঁপের আড়ালের তিনজনকে টান টান প্রস্তুত কোরে তোলে। যুবকের উচ্চতা পাঁচফুট ছয় সাড়ে ছয় ইঞ্চি হোতে পারে। চওড়া কাঁধ আর বুক। মেদহীন এবং কঠোর শ্রমে শান দেয়া শরীর। ভাসা চোখে রাজ্যের মায়া। টানা নাক। কিছুটা চাপা চোয়াল। পাতলা ঠোঁট, ক্লিন শেভড, ঘন কাল চুল। ডানে সিঁথি। প্রশস্ত কপালের উপর একগোছা চুল নেমে এসে হাটার হালে নেচে নেচে তার ত্রিমাত্রিক সুন্দর মুখে একটি স্বতন্ত্র বাড়তি মাত্রা!
উজ্জ্বল শ্যাম যুবকের পরনে মোটা গ্রে কালার ঢোলা-ঢালা গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট, গায়ে মেরুন জ্যাকেট। পায়ে নরম চামড়ার ক্রেপ সোল সু। তার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হোতে পারে।
যুবক হন হন হাঁটে। তাকে তাড়াচ্ছে গত তিনদিন ধরে বয়ে আসা এবং হঠাৎ বেড়ে যাওয়া তার মায়ের অসুখ। এখন থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে সে একটা ফোন কল পেয়েছে এক আবেদীনের কাছ থেকে। আবেদীন নিজের নাম জানিয়ে বোলেছে সে মরিয়মের খালাতো ভাই। মরিয়ম যুবকের প্রতিবেশী এবং পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ট। আবেদীন ফোনে বলেছে সে যেনো এক্ষুণি বাড়ি চলে আসে। কারণ তার মায়ের অসুখ অনেক বেড়ে গেছে ...

নদী পার হোয়ে আরও প্রায় এক মাইল যুবকের বাড়ি।
মায়ের অসুখ, বিপদজনক পথের নিরাপত্তাহীন নিঃসঙ্গতা মিলিত হোয়ে যুবকের হাঁটার গতি বাড়ায়!
বছরের প্রায় সব কয়দিন যুবক সকালে এ পথে শহরে যায় আর রাত নয়টায় সিনেমা দেখে ফেরা লোকদের সাথে ফেরে। জেলা শহরে তার ভাড়া করা একটা রুম আছে। সেখানে সে কাজ করে। এই রুমটাকে সে অফিস বা দোকান না বলে বলে ‘ঘর’।
তাকে একজন সাব কন্ট্রাকটর বলা যেতে পারে। প্রধানত সে ভেতর বাড়ির সাজসজ্জা, দেয়াল নকশা, কাঠ বা পাথরের নকশা খোদাই, ধাতু ঢালাই, পোট্রেট, পাথর, সিমেন্ট বা মোমের ভাস্কর্য, টাইলস্, টেরাকোটা সহ রঙ ও পেইন্টিংয়ের যাবতীয় কাজ করে। এ ক্ষেত্রে তাকে একজন শিল্পি বলা যাবে। এ সব কাজে তার সমান দক্ষ আপাতত এ অঞ্চলে কেহ নাই।
সম্প্রতি যুবক শহরে নতুন তৈরি হওয়া প্রথম শ্রেণীর আবাসিক হোটেলের সামনের চত্তরে একটি লাইফসাইজ সিমেন্টের জিরাফ বানানোর কন্ট্রাক্ট নিয়েছে। আজ রড দিয়ে জিরাফের স্টাকচার তৈরি শেষ হোয়েছে। আগামী দিন ঢালাই দেয়ার পরিকল্পনা এবং মায়ের বেড়ে যাওয়া অসুখ বিষয়ে ভাবতে ভাবতে সে বাঁক ঘুরে বাগানের পথে ঢোকে। সথে সাথেই প্রবল শীত তার কাপড়-চামড়া-মাংসের ভিতর দিয়ে ঢুকে হাড় পেচিয়ে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে। একই সাথে তীব্র অন্ধকার তাকে দৃশ্য থেকে মুছে ফেলে। যদিও আকাশে ইতিমধ্যে ওঠা পূর্ণ চাঁদের আলোয় উদ্ভাস চরাচর। কিন্তু এখানে?
সূর্য যেখানে ঢোকার পথ পায় না, সেখানে অনুগ্রহে পাওয়া সামান্য নতজানু আলো নিয়ে চাঁদ কি-ই বা কোরতে পারে?
যুবক জ্যাকেটের কলার উল্টে কান ঢাকার একটি প্রয়াস চালায়। কিন্তু জ্যাকেটের কলার ছোট হওয়াতে তার প্রয়াসটি ব্যর্থ হয়। তার মনে পড়ে, টেনশন আর তাড়াহুড়োয় টেবিলে রাখা কান ঢাকা উলের টুপিটা আনতে মনে নেই।
সে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের কোরে বোতাম চাপে। ঘনীভূত কুয়াশাভরা অন্ধকার সামান্য ফাঁক কোরে গোল ঘোলা আলোর একটা বলয় তৈরি হয়। সে হাঁটতে থাকে মুখস্ত পথে ...

যুবক বনের ভিতর এগিয়ে যাবার সাথেই, ঝোঁপের আড়ালের তিনজন তাকে অনুসরণ করে নীরবে। যুবক বুঝতে পরে না কিছুই। তাকে অনুসরণ করা তিনজনের মাঝের লম্বাজন মোবাইল ফোন তার থাবার আড়ালে লুকিয়ে একটা নির্দিষ্ট নম্বরে কল দিয়ে কেটে দেয় ...

যুবক দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বনের মাঝামাঝি চলে আসে। অনিবার্য অশুভ নিয়তির মত তার পিছনে তিনজন। হঠাৎ যুবককে চমকে দেয় তার সামনে ঝলসে ওঠা চারটা শক্তিশালী টর্চের তীব্র আলো! মুহূর্তে পেছনের তিনজন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু’জন খুব দ্রুত পেছন থেকে তার দু’হাত বেঁধে ফ্যালে একই সময়ে সামনে থেকে একজোন মুখে টেপ সেঁটে দিয়ে গামছা দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলে। অন্য দু’জন তার পা সহ সারা শরীর মোটা দড়ি পেঁচিয়ে বাঁধে। সাথে সাথেই চারজন তাকে কাঁধে তোলে। সামনে থেকে টর্চ জ্বেলে পথ দেখায় একজোন। দলটা এগিয়ে যায় বনের ভিতর দিয়ে ডালপাতা সরিয়ে। বনের শেষ দক্ষিণে নদীরপাড়ে এসে দলটা থামে। সেখানে আগে প্রস্তুত একখানা সমুদ্রচরা মাঝারী ট্রলারে যুবককে তোলা হয়। তারপর তাকে ট্রলারের পাটাতনে চিৎ শুইয়ে রাখা হয়। সাথে সাথেই ট্রলার স্টার্ট হয় আর চলা শুরু করে দক্ষিণের সমুদ্র মোহনার দিকে।

যুবক বিশ্বাস কোরতেই পারে না যে, তার জীবনে এরকম ঘটতে পারে। তার ধারণা হয় এটা একটা দুঃস্বপ্ন, কিছুপরে ঘুম ভাংতেই দেখা যাবে নিজের খাটে শুয়ে আছি।
সে পাস ফিরতে চেষ্টা করে। সাথে সাথেই সারা শরীরে প্যাঁচানো দড়ি শক্ত হোয়ে চেপে বসে উসকে তোলে টাটকা তীব্র যন্ত্রণা।
যন্ত্রণা তাকে ফিরিয়ে আনে সনাক্তহীন নানান অলীক জগত থেকে নির্দিষ্ট বাস্তবতায়। কারণ যন্ত্রণা সব সময় জাগতিক।
হঠাৎ সে কয়েকটি প্রশ্ন তোয়ের কোরতে পারে!
কারা?
কেন?
আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
আমি এখন কোথায়?
প্রশ্নগুলোর উত্তর তন্ন তন্ন খুঁজে সে নাজেহাল করে নিজেকে। কিন্তু কোনো সূত্রই সে পায় না, যে সূত্র থেকে সে হরণ হবার কারণ জানতে পারবে!
হঠাৎ তার মাকে মনে পড়ে! মা তাকে প্রায়ই বলে, বিপদে অস্থিরতা এবং দুশ্চিন্তা কোনোভাবেই বিপদ থেকে উদ্ধার কোরতে তো পারেই না বরং বিপদ আরও বাড়িয়ে তোলে। বিপদে আল্লাহকে স্মরণ কোরবে আর ঠাণ্ডা মাথায় বিপদ থেকে বের হবার পথ খুঁজবে।
কিন্তু সে কোনোভাবেই খুঁজে বের কোরতে পারে না পরিত্রাণের পথ ও পদ্ধতি। অতপর সে ক্লান্ত হোয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কোরতে থাকে এই মহাবিপদ থেকে তাকে উদ্ধারের জন্য।
হঠাৎ ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধো হয়। কয়েকটি কণ্ঠ এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলতে থাকে। কিছুটা সংকেত এবং সংখ্যা ধরনের সে ভাষা। একই সাথে নাট-বল্টু খোলা এবং লাগানোর খুট খাট চলতে থাকে। কতক্ষণ এ রকম চলে তা যুবকের স্মরণ থাকে না। সে এক ধ্যানে রাজ্যের পীর-পয়গম্বরের কাছে উদ্ধার পাবার আবেদন জানাতেই থাকে।
বহুক্ষণ চালিয়ে যাবার পর ইঞ্জিন মেরামতের চেষ্টা সফল হয়। ট্রলার স্টার্ট হয় এবং চলতে থাকে, প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর ট্রলার একটা ঘাটে ভেড়ে। চারজন যুবককে কাঁধে তুলে নিয়ে ট্রলার থেকে নামে, জোড়া কুকুরের বিভৎস হুংকার কাছিয়ে আসে। যুবকের পেছন থেকে ওঠা ‘তাইৎ’ ধরনের একটি কড়া ধমক দুই কুত্তাকে চুপ করায়। হঠাৎ দরোজা খোলার শব্দ হয়। আর যুবককে নামিয়ে রাখা হয় একটা শক্ত বিছানার উপর!
টিনের চাল কাঠের বেড়ার যে ঘরে যুবককে রাখা হলো সে জায়গাটা লম্বায় মাইল ছয়েক আর চওড়ায় মাইল দুই আড়াই সমুদ্র উপকুলের একটা দ্বীপ।
অমাবশ্যা এবং পূর্ণিমায় জোয়ারের চাপ বাড়িয়ে দ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা সমুদ্র দখল করে। আবার ভাটায় সে দখল ছেড়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সমুদ্র যে কোনো সময় এই দ্বীপ খেয়ে ফেলবে।
কয়েক বছর আগে এই দ্বীপের আয়োতন ছিলো আজকের আয়োতনের ছয়-সাতগুণ। আর ঘর-বাড়ি দোকান, স্কুল গাছ-গাছালী দিয়ে সাজানো ছিলো।

এক ঝক ঝক সূর্যের সকাল। হঠাৎ পশ্চিম থেকে উঠে আসা গাঢ় সুরমা রঙ মেঘের কনভয় দখল করে আকাশ। সাথে সাথেই আলো মরে যায়, মেঘ তার থম থম ছায়ায় ঢেকে ফেলে সারা অঞ্চল। এ সময় সমুদ্র আস্তে আস্তে ফুঁসতে থাকে আর ঝাঁক ঝাঁক বাতাসের ঘূর্ণি ছুড়তে থাকে দ্বীপের উদ্দেশ্যে। একই সাথে মাঝে মাঝে কিড়-মিড় হুঙ্কার দিয়ে মেঘ ঝরাতে থাকে বৃষ্টির গুড়া। এভাবে চলতে থাকে বিকাল পর্যন্ত, তারপর হঠাৎ বাতাসের সাথে জড়াজড়ি হোয়ে প্রবল ঘূর্ণি তুলে সমুদ্র নাচতে নাচতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্বীপের উপর। মুহূর্তে কোনো এক অজ্ঞাত আক্রোশে দুমড়ে মুচড়ে ছিড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দ্বীপের ঘর-বাড়ি গাছ-মানুষ-পশু-পাখি যা ছিলো। সেদিন সমুদ্র গিলে হজম কোরে ফ্যালে দ্বীপের সাতভাগের ছয়ভাগ। আর খুন করে সাতানব্বই ভাগ বসতকারীকে। যার বেশিরভাগ লাশও সে গুম করে। যারা বেঁচে যায় সেই তিনভাগ মানুষ চিরকালের জন্য এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়। শুধু একজন যায়নি। সেদিন মান্দার কবিরাজের একমাত্র মেয়ে আর বউকে খেয়ে ফেলে সমুদ্র। কিন্তু সমুদ্র মান্দার কবিরাজকে হজম কোরতে পারেনি। গেলার তিনদিন পর সে সমুদ্রের পেট ফেড়ে বেরিয়ে আসে এবং এখানেই বসত কোরতে থাকে যা এখনও অব্যাহত। এ দ্বীপে এখন মান্দার কবিরাজই একমাত্র মানুষ বাসিন্দা।

সারা দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য উভয়চর ঝোঁপজঙ্গল আর গাছ। এই সব গাছ আর ঝোঁপে বাড়ি বানিয়েছে রাজ্যের সমুদ্রচরা পাখি।
ইতিমধ্যে দ্বীপের একমাত্র বাস্তুকারের নামে দ্বীপের নাম অর্জিত হোয়েছে ‘মান্দারের চর’।

মান্দারের চর সম্পর্কে অনেক কাহিনী চালু। কোনো কোনো গভীর রাতে মাছধরা বোটের লোকেরা দেখেছে চরের বুক থেকে লাফিয়ে ওঠা আগুনের দমকা নাচ। সাথে বিভৎস চিৎকার। শোনা যায়, বিশেষ বিশেষ রাতে ওই চরে পিশাচ ডাকিনীরা মেলা বসায়। তখোন দ্বীপের ভূতপূর্ব বাসিন্দাদের আত্মারা এসে সম্মিলিত বিলাপ করে, দুনিয়ার হারানো জীবনের শোকে!
মান্দার সম্পর্কেও আছে অনেক কাহিনী।

পুরনো পেতল রঙ মান্দার, লম্বা, সটান শরীরে সাজানো মজবুত পেশির নান্দনিক সমারোহ। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়ষট্টি বা আরও বেশি-কম যে কোনোটা হোতে পারে, দেখে বোঝা যাবে না সে একটা পাকা বয়স চোর। তার ভারী কাঁধ, চেতানো বুক, মজবুত ঘাড়ের উপর বসানো মাথায় পাকানো জট। মরিচা রঙ জট সুযোগ পেলেই তার ঘাড়ের দু’পাশ দিয়ে নেমে পিঠ আর বুকের উপর ছড়িয়ে থাকে। বাইরে বেরোনোর আগে সে তার জট একখণ্ড লাল কাপড়ে পেঁচিয়ে চুঁড়ো খোপা করে। পুরু ঠোঁট, ছড়ানো নাক। বলিরেখায় ভরা কপাল। লম্বাটে মুখের পাতলা ছাগোল দাড়িতে দোল খায় মরিচাকৃতি তিনটা জট। সে পরে র‌্যাব রঙ লুঙ্গি আর ফতুয়া। তার চলাচল শব্দহীন এবং স্বচ্ছন্দ। লাল শিরার জালে আটকে পড়া তার ঝিম চোখে, তুলনামূলক পলক পড়ে অনেক কম। বলে তাকে কেহ কেহ জলদস্যু, অনেকে আবার বিশ্বাস করে মান্দার আসলে মরে গেছে সেদিনের ঝড়ে। ও হলো মান্দারের প্রেতআত্মা। দিনে নিজেকে মানুষ বানিয়ে রাখে, রাতে স্বরূপে চরে। তখোন ওর জট শাপ হোয়ে ভিড় পাকিয়ে থাকে মাথায়।
কিন্তু যে যা-ই বলুক মান্দারের জুড়ি বটি ঝাড়ফুক-জাব-মালিশ, কবজ আর গাছড়ার চিকিৎসা খুবই ধনন্তরী। যে কারণে বহু দূর থেকেও তার কাছে রুগী আসে বিভিন্ন ধরনের ব্যাধী-বালাই আর সমুদ্র ডাকিনীর আছর মুক্তির জন্য।
দ্বীপের মাঝামাঝি ছোটখাট টিলা আকৃতির সবচে উঁচু জায়গায় টিনের চাল কাঠের বেড়ার তিন কামরার মান্দারের বাড়ি। মাঝের কামরার বা পাশের পার্টিশন ঘেঁষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তিন কাঠের তাক। যার তাকে তাকে সাজানো রাজ্যের গাছ-গাছড়া, গুল্মো-বাকল-শেকড়-হাড় আর বড় বড় কাঁচের বোয়েমে বর্ণিল আরক। রুমের মাঝামাঝি পেছনের বেড়া ঘেঁষে এক ফুট উঁচু চার ফুট বাই চার ফুট আয়তকার বেদি। উজ্জ্বল লাল মখমলে মোড়া বেদির উপর দাঁড়িয়ে দেখতে ভয়ঙ্কর কুৎসিত তিন অপদেবতা। তিন মূর্তির মাঝের জন পুরুষ এবং অন্য দুই মূর্তির তুলনায় বড়। তার ডান হাতে প্রলয় সিংগা। তার অল্প হা মুখের থেকে বেরিয়ে পড়েছে বিশাল চকচকা দুই ধারালো দাঁত। দূরের কোনো দৃশ্য বা চিন্তা তার ভুরুর কোঁচকানো খাঁজে। যা তার চোখে ফুটিয়ে তুলেছে অস্থিরতা। অন্য দু’জন নারী, তাদের স্তন বিশাল এবং সুডৌল, কিন্তু তাদের মুখ বিভৎস কংকালের। তিন মূর্তির গলায় পেঁচানো নরমুণ্ডের মালা আর সাপ। তাদের ভঙ্গি তাড়াহুড়ো করে যাত্রা শুরুর। তাদের পায়ের কাছে তিনটা মড়ার খুলি। এই কামরা মান্দারের অষুধ তাবিজ তৈরি আর সাধনার ঘর। ডানপাশের রুম অতিথি দর্শণার্থীদের। বা পাশে তার শোবার ঘর।
দক্ষিণমুখী ঘরের সামনে লম্বা বারান্দা যার কিছু অংশ চাটাই দিয়ে ঘেরা, ভেতরে পাশাপাশি দুইটা চুলা। এখানে সে রান্না করে নিজের খাবার এবং ভেষজ।
বারান্দার সামনে বড় খোলা উঠোন, যার পুবপাশে চারপাশ খোলা লম্বা এক টিনের ছাবড়া, বছর পাঁচেক আগে মান্দার এখানে একজোড়া ছাগোলের বাচ্চা আর দুইজোড়া মোরগ-মুরগী ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন ছাগোলের সংখ্যা বিশের উপরে, আর মুরগী প্রচুর। মান্দার এসবের খোঁজ নেয় না। ছাগোল মুরগীরাও তাকে পাত্তা না দিয়ে স্বাধীনভাবে চরে বেড়ায় আর বংশ বাড়ায়। তবে বৃষ্টি বাতাস শুরু হলে ছাগোল মুরগীরা এসে আশ্রয় নেয় এই ছাবড়ার তলে।
মান্দারের সাথে থাকে দারু আর মারু নামের বাজখাই কণ্ঠের দুই কুকুর। যারা সারাদিন সাগর থেকে উঠে আসা কাঁকড়াদের সাথে ছোটাছুটি করে আর কিছুক্ষণ পর পর আকাশের দিকে যৌথ হাঁক ছাড়ে এবং অপরিচিত কেহ দ্বীপে পা রাখামাত্র অশান্তিপ্রিয় মার্কিন সৈন্যদের মত দাঁতমুখ খিঁচে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দেয়।
মান্দারের ঘরের পেছনে প্রায় চার বিঘে মত আয়তকার একটা সৃদৃশ্য বাগান। যার ঠিক মাঝে নানান প্রজাতির মাছে ভরা ছোট্ট এক পুকুর। এই বাগানের সব গাছই আয়ূর্বেদ গুণবিশিষ্ট। এখান থেকেই সে তার দাওয়াই তোয়েরের কাঁচামাল পায়।
অনেকেই মান্দারকে আবার বিয়ে কোরতে বলেছে, সে রাজী হয়নি, সে বলে, ‘পাত্তর খালি থাকলি না হয় পানি ঢালা যাতো, কিন্তুক ভরা কলসে পানি ঢালতি গিলি তো উপচায় পড়ে যাবে। আমার বউ সারা সুমায় আমার অন্তরে বসে সারিন্দে বাজায়, নুতোন কাউরে টানে আনলি তারে আমি কুহানে বসাবো? জায়গা খালি নেই, এ জনমে আর হবে না।’

প্রতি সকালে মান্দার রাতে গুছিয়ে রাখা লতা-গুল্ম-বাকল এক বড় মাটির পাত্রে জ্বালায় পানি দিয়ে। যার থেকে তোয়ের হয় জাম রঙ ঘন জোলাপ। বলকারক এই জোলাপ তার সব রুগীর জন্য অবশ্যই সেব্য।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সে রান্না করে তার নিজের খাবার। তারপর গোসল করে খোলা সাগরে। গোসল শেষে বাড়ি ফিরে খেতে বসে জোড় আসনে। খাবার আগে সে প্রার্থনা করে, ‘হে প্রভু! আমি পাপি-তাপি দাগা খাওয়া মানুষ। তবুও তুমি আমারে জীবন, ছুস্থ শরীর আর খাবার দিছো, তোমার মহিমা অসীম। আমারে তুমি মাফ করে দিও।’ তার সামনে উঠোনে বসে মাটির পাত্রে খায় দুই কুত্তা। খাওয়া শেষ হলে সে বাসন কোষণ ধুয়ে গুছিয়ে রাখে। তারপর জুড়ি বটি হাড় কবজ, বিভিন্ন ভেষজ আর আরকে ভরা শিশিতে ভরা কাপড়ের ঝোলা নিয়ে সে তার দুই দাড়ের সাম্পানে ওঠে। আর এ পারের উপকুলে এসে নামে। তারপর সারাদিন এ বাড়ি ও বাড়ি রুগী দেখে, ফেরে সন্ধ্যায়। আসার সময় সে সাথে করে আনে বড় দুই জেরিক্যান খাবার পানি। তারপর বাড়ি ফিরে ধীরস্থির রান্না করে আর মোটা হেড়ে গলায় গায় উপকুলের আবহমান বিরহের গান ...
মান্দারের মাঝের কামরায় মাত্র দু’জনের প্রবেশাধিকার আছে। একজন সে নিজে, অন্যজন তার প্রধান সাগরেদ হরমুজ। আমরা কিছু আগে হরমুজকে দেখেছি যুবককে অপহরণ করে আনা দলের নেতৃত্ব দিতে। মান্দারের সাথে পরিচয়ের আগে হরমুজ সমুদ্রে ডাকাতি কোরতো।
সে ছিলো এই এলাকার সবচে’ কুখ্যাত জলদস্যূ কালাবগির ডানহাত। একদিন ডাকাতির মাল ভাগাভাগি নিয়ে কালাবগির সাথে তার তর্কাতর্কি হয়। তর্কাতর্কির মাঝেই হরমুজ অনুভব করে সর্দারের মুখে মুখে কথা বলা তার ভুল হচ্ছে। মুহূর্তে সে তার ভুল স্বীকার করে এবং কালাবগির কাছে বেয়াদবির জন্য ক্ষমা চায়। তবুও হরমুজ জানে খমা চাইলে এ কালাবগি কাউকে ক্ষমা করে না। সে আপাতত খমা করার অভিনয় কোরবে। কিন্তু বিষয়টা সে ঠিকই মনে রাখবে এবং ছুতা আর সুযোগ তৈরি কোরবে তাকে কোঠিন শাস্তি দেয়ার- হতে পারে খুনও করে ফেলতে পারে। এমন অনেক খুনে হরমুজ নিজে অংশগ্রহণ কোরেছে। এক্ষেত্রে সে নিজে খুন হবার আগে তার সম্ভাব্য ঘাতককে খুন করার অথবা নিরাপদ দূরত্বে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ফিকির খুঁজতে থাকে। কিন্তু সে কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারার আগেই এক রাতে কালাবগি তার হাত-পা ভেঙ্গে মান্দারের চরে ফেলে দিয়ে যায় ...।

খুব ভোরে দুই কুকুরের বেদম চিৎকার মান্দারকে টেনে নিয়ে আসে দলা হোয়ে পড়ে থাকা হরমুজের কাছে। মান্দার হরমুজের কুখ্যাতি সহ তাকে আগে থেকেই চিনতো। তাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে সে খুব একটা অবাক হয় না, কারণ এরকম বহুজনকে সে এভাবে মরে পড়ে থাকতে দেখেছে। কিন্তু সে অবাক হয় হরমুজের বুক ওঠানামা কোরতে দেখে। তার মুমূর্ষু অবস্থা চিকিৎসক মান্দারের ভেতরে এক মানবিক দায়িত্ব জাগিয়ে তোলে। আর সে ভুলে যায় হরমুজের ব্যক্তিগত পরিচয়। মুহূর্তে তাকে এক অসহায় অসুস্থ মানুষের জীবন রক্ষার অনুপম উদ্দীপনা তৎপর কোরে তোলে। সে ভাঙ্গা দলা-মোচড়া রক্তাক্ত হরমুজকে তুলে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। তার পর তার গাছড়ার নির্যাস আর ধনন্তরি জাব মালিশের নিবিড় চিকিৎসা শুরু করে।
মান্দারের আন্তরিক সেবা আর চিকিৎসায় মাস দুয়েকের মধ্যে হরমুজ মোটামুটি সুস্থ হোয়ে ওঠে।
সেই থেকে তার জীবন রক্ষাকারী পরম হিতৈষি মান্দারের কাছে সে প্রায় বছর খানেক থেকে যায়। এই সময়ের মাঝে মান্দার আর হরমুজের মধ্যে গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্যতা। হরমুজ সাধন লাইনে মান্দারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। আর জলদস্যুগিরি ছেড়ে দিয়ে সমুদ্র বন্দরের সিন্ডিকেটের সাথে ঝামেলামুক্ত কালোবাজারী শুরু করে। যা এখনও সে চালিয়ে যাচ্ছে ...।
শনিবার হরমুজ দুনিয়ার অন্য কোনো কাজ করে না। এ দিন সে মান্দারের বাড়ি আসে। বিশেষ সাধন ক্লাসে অংশগ্রহণ করে। মাঝে মাঝে পর পর কয়েকদিন সে চরে থাকে। অন্য সময় থাকে দক্ষিণের বন্দরের ওইদিকে, সেখানে সে চার কাঠা জমির ওপর তার পাকা দেয়াল টিনশেডের বাড়ি করেছে। সম্প্রতি সে তার গুরু মান্দারের মুখে এক বিশাল শক্তি অর্জনের পথ ও পদ্ধতির কথা জেনেছে। যে কারণে সে খুব তৎপর হোয়ে উঠেছে এই শক্তি অর্জনের চেষ্টায়!

আজ মান্দারের মাঝের কামরা বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হোয়েছে। এ ঘরের সব তাক, মালপত্র পাশের ঘরে নিয়ে রাখা হোয়েছে। ঝুল-ধুলা ঝাড়ামোছা করে মেঝে কাঁচা মাটি দিয়ে ভালো করে লেপা হোয়েছে।
তিন দেবতার পায়ের তলের পুরানো মখমল পাল্টে নতুন মখমলের বিছানা পাতা হোয়েছে। তাদের তিনজনের সামনে রাখা হোয়েছে তিনটা ঝকঝকে কাশার গামলা। সামনে বসানো হোয়েছে বলির আড়কাঠ। আর তাদের পায়ের কাছে শুয়ে দেখতে বোকা ধরনের এক ধারে চকচকা মাজা বেঁকা খড়গ। তিনটা ধুপদানী উগরাচ্ছে ধোয়া। স্বাভাবিক শান্ত স্বভাবের মান্দার এখন খুব বিরক্ত এবং অস্থির।
যুবককে অপহরণকারী দলের সর্দার হরমুজ আনন্দে চন মন কোরতে কোরতে মাঝের কামরায় ঢোকে আর মান্দারকে বলে ‘পাশের কামরায় রাখছি, যা খুজতি ছিলাম তিনমাস ধরে। আসল জাউরা, আমি নিজে জানি। ওর মা’র বিয়ের আগে ওর জন্ম হোইছে। ওর হাড় আর মাথার খুলি দিয়ে হবে অসাধ্য সাধন। ওস্তাদ চুপ কোরে আছেন ক্যা?’
মান্দার বলে শান্ত ‘ওরে ওর বাড়ির ঘাটে নামায় দিয়ায়। আগামী বছর মাঘিপুন্নিমায় আর এট্টা জাউরা নিয়ে আসিস। এ্যাহোন আর হোবিনে। দেহিস নাই, চান্দ মাঝ আছমান পার হোয়ে গেছে। সগল কামের লগ্ন আছে। লগ্ন ছাড়া হয় না কিছুই। শোন, মাঘি পুন্নিমার ঠিক মধ্যিরাতে চান্দ যহোন ঠিক মাথার উপর, দুনিয়ার সব ছায়া যহোন চান্দে খায়ে ফ্যালবে। আবার ছায়ার জন্ম হওয়ার আগেই পচো-পাচি আর নিষিন্দে পিচেশের সামনে জারো বলি দিতি হবে। আর সেই জারোর রক্ত দিয়ে পাচোপাচি নিষিন্দেরে নাওয়াাতি হবে। খানিক রক্ত ওগে গালে দিতি হোবি। সাথে একাশি পট্টি খোবিশ মন্তর জপ কোরতি হোবি। তারপর ওই জারোর দেহ পুবদিকে মাথা আর পশ্চিম দিকে পা দিয়ে নির্জন জায়গায় পুতে রাখতি হোবি। তারপর তিন আমাবশ্যা পর যে আমাবশ্যা আসপে সেই আমাবশ্যার মধ্যিরাতে ওই জাউরার পুতে থুয়া মাথা আর তে ট্যাংরার হাড় উঠায়ে পাচো পাচি নিষিন্দের সামনে থুয়ে একুশ পট্টি আদি মোন্তর পোড়তি হোবি আর মাতম কোরতি হোবি। তহোন পাচোপাচি নিষিন্দে ভর কোরবি জারোর হাড় আর মাথায়। তহোন জারোর মাথা নোড়বি, কথা কোবি। তহোন তারে যা কবা তাই কোরে দিবো চক্ষের পলক ফ্যালার আগে। তয় জান্তরে মারতি পারলিও সে কিন্তু মরারে জ্যান্ত কোরতি পারবি না। অবশ্যি এর মধ্যি আরও কাম আছে, আমার ওস্তাদ গদনসার মরার আগে আমারে সে সব শিখেয় গেছে। এ্যাতো সহজ না? তুমরাতো রাস্তারতে এট্টা জারো ধরে আনেই মোনে অরো আসমানে উড়ে ব্যাড়াবা?
ওস্তাদ কোয়ে গেছে এ কাজে ভুল হোলি রক্ষা নেই। জারো আমাগেই খেয়ে ফ্যালবে। এ্যাহোন যা ছুয়ালডারে ওর বাড়ির ঘাটে নামায় থুয়ায়। সকালের আগেই কামডা কর। সে বুঝতি পারিছে নাই তারে কুহানে আনিছিস?’
‘চোখ-মুখ বাইন্দে আনছি। তারে কিছুই বুঝতে দেই নাই। কি করবো ওস্তাদ, ওরে পাইছি গত পরশু। খোঁজ-খবর নিয়ে ঠিক মোতো ফান্দ পাতে ধরে আনতি এট্টু সুমায় লাগিছে। তারপর আবার পথে টলার গ্যাঞ্জাম বাঁধলো!’
‘যা- যা কলাম তাই কর।’
‘ওস্তাদ ঝামেলা দিয়ে কাম কি? পরে কিসিরতে কি হয়? তারচে ওরে দরিয়ায় ফ্যালাই দেই?’
‘আমরা তো খুনি রাজাকার না, যে খালি খালি মানুষ মারবো। জারো হোলিও সে তো মানুষ, মালিক তারেও পয়দা কোরিছে। ওতো নিজের ইচ্ছেয় জারো হোইনি, যা ওরে নামায় দিয়ায় ঘাটে। ও বাচে থাকলি পরের বছর কাজে লাগতিও তো পারে?’
‘তা ঠিক কথা।’
হরমুজ সব সময় মান্দারের নির্দেশ মেনে চলে। অবশ্য মান্দার তার রুগীদের চিকিৎসা বিষয় ছাড়া কাউকে কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ দেয় না। সে বলে ‘যার য্যামোন বুদ্ধি তার ত্যামোন শুদ্ধি’।
হরমুজ ঘর থেকে বেরুনোর সময় মান্দার তাকে আবার বলে,
‘হরমুজ ওরে ঘাটে নামায় দিয়ে বান্ধন খুলে দিস, যা।’
হরমুজ ফিরে আসে তার সাথীদের কাছে। আর যুবককে কাঁধে নিয়ে ট্রলারে ওঠে ...।

ভোরের আগেই হরমুজের ট্রলার এসে কেস্টমাঝির ঘাটে ভেড়ে। হরমুজের দল তড়িঘড়ি যুবককে ট্রলার থেকে নামিয়ে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে দ্রুত ট্রলারে উঠে চলে যায় ...।

গ্রামের নাম মহির বাড়ি। অবস্থান? সাব ডিভিশন শহর থেকে চারমাইল উত্তরে। গ্রামের উত্তর সীমান্ত হোয়ে প্রবাহিত কুড়িফুল নদী। এখানের বাস্তকারদের মাঝে জেলে আছে কয়েক ঘর। তারা মাছ ধরে কুড়ি ফুল নদীতে। নাপিত বাড়ি আছে, তারা তাদের কাজ করে। কুমোর পাড়ায় তৈরি হয় হাড়িপাতিল কলস আর তৈজশ। কাঠমিস্ত্রি আছে, তারা তৈরি করে লাঙ্গল, গরুরগাড়ি, ঘরবাড়ি আসবাব। কামার পাড়ায় তৈরি হয় লাঙ্গলের ফলা, দা-বটি, কাঁচি, হাতুর, বাটাল, গজাল, খুন্তা, নিড়ানি ইত্যাদি। তাঁতি পাড়ায় তৈরি হয় শাড়ি লুঙ্গি গামছা। ময়রা পাড়ায় ছানা, মিষ্টি, দৈ।
গ্রামের চারপাশে ফসলি জমি। সেখানে ফলে ধান, পাট বিভিন্ন জাতের ডাল, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, তিল, তিষি, শর্ষে, শাক-সবজি, তরি-তরকারি।
গ্রামে কয়েকটা মুদি মনোহারি দোকান আছে। আছে দরজি বাড়ি। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। একজোন হোমিও এবং একজোন এলোপ্যাথি ডাক্তার আছে, আর আছে এক কবিরাজ। একজন কথক কবি আছে, আর অভিনেতা গায়ক দল আছে একটা। তারা মাঝে মাঝে আসর বসায় হাটখোলার মাঠে বা কারও বাড়িতে। তারা রাখালের ত্যাগ, বীরত্বগাথা আর দুঃখ-কষ্টের উপাখ্যান অভিনয় কোরে গায় আবমান লয় সমৃদ্ধ কোরাসে। সুরের স্রোতে ভেসে যায় চরাচর শ্রোতা আর গায়কের হৃদয় ...।

এ গ্রাম থেকে বেরিয়ে একটা মাটির পথ ফসলি জমির ভিতর দিয়ে এগিয়ে পরম আহ্লাদে ছুয়েছে পাশের গ্রাম। সে গ্রামেও এ গ্রামের মতো আছে বিভিন্ন পেশার মানুষ। তার পাশে আর এক গ্রাম। এভাবে গ্রামের পর গ্রাম বিছানো। যার প্রত্যেক গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ নিজেদের কর্ম এবং মতাদর্শে।

এই গ্রামের যে জেলে বা তাঁতি বা কামার-শিক্ষক-ডাক্তার-কাঠমিস্ত্রি-মুুিদ দোকানদার-কবিরাজ-কুমোর-ময়রা প্রত্যেকেই চাষের সাথে যুক্ত। যার নিজের চাষের জমি নেই সে অন্যের জমি ভাগে চাষ করে। এ বিবেচনায় এ গ্রামের সবাই কৃষক।

মহির বাড়ি গ্রামের শফিয়ার মোল্লা কৃষক। তার যে চাষের জমি আছে তাতে যে পরিমাণ ফসল হয় তা দিয়ে তার সংসার মোটামুটি চলে যায়। স্ত্রী আর মেয়ে পরিবানুকে নিয়ে তার শান্তির স্বপ্নময় সংসার। তাদের স্বামী-স্ত্রীর একমাত্র ধ্যান মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় বানাবে। তার জন্য যদি জমি বাড়ি সব বিক্রি কোরতে হয়, তো কোরবে।
পরিবানু গ্রামের ইশকুলে ক্লাস এইটে পড়ে।
পরিবানুর রঙ চাপাফুল, লম্বা টানা নাক চোখ, ঘনকালো ফোপানো চুলের মাঝে ডিমাকৃতি অনিন্দসুন্দর মুখ। পাতলা ঠোঁট আর চোখে সারা সময় খেলা করে প্রাণপ্রাচুর্য ভরা সরল হাসি। তার শরীরে বয়সন্ধির কামরাঙ্গা ফুলের কড়ি বের হচ্ছে। ইতিমধ্যে পরিবানুর জন্য কয়েক জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। শফি সে সব প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামের সবচে’ ধনি ইদু চৌধুরিদের বাড়ির মেয়েদের সাথে পাল্লা দিয়ে শফিয়ার মেয়েকে সাজায়। বাবা মায়ের ইচ্ছা মেয়ের মাঝেও পুরোপুরি প্রতিফলিত। সে খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে আর ভাবে ইশকুল শেষ কোরে আমি কলেজে যাবো ...।

হঠাৎ যুদ্ধ এসে বন্ধো কোরে দেয় পরিবানুর ইশকুল। আগুন জ্বলে ওঠে চারপাশে লুট হোতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। বহু পরিবার ভিটামাটি ছেড়ে পালাতে থাকে। নদীতে ভেসে বেড়ায় ফুলে ঢোল মানুষের লাশ। শোনা যায় পাকিস্তানি আর্মিরা রাজধানী সহ অন্যান্য শহরে হাজার লক্ষ মানুষ খুন কোরেছে। এখন তারা এগিয়ে আসছে গ্রামে গ্রামে। তাদের সামনে পড়লে আর রক্ষা নাই।
সাব ডিভিশন শহরে স্থানীয় ছাত্র-জনতা অস্ত্রাগার লুট কোরে একটা বাহিনী গড়ে তুলেছে। যে বাহিনী শহরটাকে রক্ষা কোরছে লুটপাট থেকে। আর তারা পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত কোরছে নিজেদের!

প্রতিদিন হাওয়া বয়ে আনে অজস্র খবর। পাকিস্তানি আর্মিদের সম্পর্কে হাওয়া বলে, বলতেই থাকে বার বার। তারা যাকে পায় তাকেই মেরে ফ্যালে। লুট করে সর্বস্ব। ধর্ষণ করে নারীদের। শিশুদের হত্যা করে। তারপর বাড়িঘর বন্দর বাজার সব পুড়িয়ে ছাই কোরে ফেলে। তারা যে কোনোদিন আসবে এই অঞ্চলে, আর মেরে ফেলবে সবাইকে। জ্বালিয়ে দেবে গ্রামের পর গ্রাম। এই খবরের পাশাপাশি হাওয়া প্রচার করে আর একটা খবর। ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পাক আর্মিদের তুলোধুনা করে জাহান্নামে পাঠাচ্ছে। শীঘ্রই পাকিস্তানিদের পরাজয় হবে আর আমাদের দেশ হবে স্বাধীন। এবং দেশ স্বাধীন হোলে আর কারও কোনো অসুবিধা থাকবে না। গ্রামের বারিক মাস্টার স্বপ্ন দ্যাখে দেশ স্বাধীন হোলে তার ইশকুল স্বাধীন হবে। সে তখোন প্রাণভরে ছাত্রদের পড়াবে আর ঠিকমতো বেতন পাবে। জীবনে তখোন আসবে সচ্ছলতা আর শান্তি। বুড়ো মতলেব ভাবে হা হোলি স্বাধীনতা আসলি নিচ্চয় আমার হাপানির চিকিস্সে হোবি’। কৃষক শফিয়ার ভাবে ‘দেশ স্বাধীন হোলি মোনের সুহি ফসল ফলাবো আর আমার পরিবানু ইশকুলি যাবে।’ তাতি মাজেদের ভাবনায় স্বাধীনতা আসলে সে নিশ্চিন্তে তাতে কাপড় বুনবে আর হাটে হাটে সেই কাপড় বিক্রি করে শান্তিতে জীবন কাটাবে। এভাবে এক একজনের কাছে আলাদা আলাদা পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা দৃশ্যমান হোয়ে ওঠে।
মহিরবাড়ি গ্রামের কয়েকজন যুবক মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য একদিন গ্রাম ছাড়ে। অন্যদিকে সৈয়দবাড়ির ফজলু মীর আর রাজধানী থেকে আসা তার শালা হরমুজ এলাকায় প্রচার শুরু করে। পাকিস্তানের শত্র“ মনে এসলামের শত্র“, দেশের শত্র“, জনগণের শত্র“, এসলামের শত্র“দের বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু হোয়ে গেছে। আমরা এসলামী জেহাদের পক্ষে, কাফির নাছারাদের বিপক্ষে, যারা পাকিস্তানের বিপক্ষে যাবে, দুনিয়া এবং আখিরাতে তাদের জন্য কোঠিন আযাব।’
হরমুজ আর ফজলু মীরের দলে যোগ দেয় এই অঞ্চলের সব ডাকাত, চোর, খুনি। তারা আশপাশের গ্রামে বিশেষত হিন্দুদের বাড়ি লুট করে ইসলামের নামে। তাদের কাজের বিরোধিতা করায় গ্রামের একজোনকে তারা প্রকাশ্যে জবাই করে। এখান থেকেই সাধারণ মানুষের আতঙ্ক কয়েকমাত্রা বেড়ে যায়।
কখোন কি হয়? কখোন কি হয়? ভাবনায় ভরা চরম উৎকণ্ঠা জর্জর এক একটা দিন পার হতে থাকে ...।
হঠাৎ বিকট শব্দে সকাল কাঁপিয়ে খুব নিচু দিয়ে পশ্চিম থেকে উড়ে আসে তিনখানা বিমান। আতংক লোকজনকে ধাওয়া কোরে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় দিক-বিদিক। পুরা এলাকার উপর দিয়ে তিনপাক ঘুরে বিমানগুলো ফিরে যায় যেদিক থেকে আসছিলো সেদিকে। এর প্রায় সাত-আট মিনিটের মাথায় ফিরে আসে ছয়খানা বিমানের একটা বহর। এক চক্কর দিয়েই সাব ডিভিশন শহরের উপর বিমানগুলো শুরু করে বোমা বর্ষণ। সাথে ভারি ম্যাশিনগানের গুলি বৃষ্টি।
অভিজ্ঞতাহীন ভয়ে লোকজন ছোটাছুটি চিৎকার কান্নাকাটি কোরতে থাকে। শহরের দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা হালকা ম্যাশিনগান আর রাইফেল দিয়ে বিমান আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের চেষ্টা কোনো কাজে আসে না। প্রায় পনেরো মিনিট ব্যাপী টানা বোমা আর গুলি বর্ষণ কোরে বিমান বহর ফিরে যায়। আর তখোনই জেলা শহরের দিক থেকে তিনখানা ট্যাংকের সাপোর্ট এগিয়ে আসে পাকিস্তানি আর্মি বোঝাই গাড়ি বহর।
এ ধরনের আক্রমণ বিবেচনায় রেখে দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা আগেই শহরে ঢোকার মুখে রাস্তা কেটে ট্যাংক প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোরে রেখেছিলো। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই কার্যকরি হয়। পাকিস্তানি আর্মিদের ট্যাঙ্ক, গাড়ি শহরের মুখে আটকে যায়। আর্মিরা গাড়ি থেকে নেমে শহরে ঢোকার চেষ্টা কোরতেই দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা হালকা ম্যাশিনগান রাইফেল আর হাতবোমার সমন্বয়ে একটা কার্যকরি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একই সাথে তারা শহরবাসীদের দূর গ্রামে চলে যেতে সাহায্য করে। শহরবাসীরা নিরাপদ দূর গ্রামে চলে যাবার পর দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা সন্ধ্যার পর শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পশ্চাদপসারণ করে ...।
পাকিস্তানিরা শহরে ঢুকে এক পাগোল আর দুই খোড়া ফকিরকে পায় এবং তাদের গুলি করে খুন করে। তারপর তারা লুটপাট করে, এখানে ওখানে আগুন লাগিয়ে দেয়। শহরের চারপাশে বাংকার খুড়ে পাহারা কবসায় আর ঘাটি করে ওয়াপদা রেস্ট হাউজে।
পাকিস্তানিদের সাথে যোগ দেয় জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী দলের লোকজন। উর্দুভাষী বিহারীরা সহ উনশত সাতচল্লিশ খৃস্টাব্দে পাকিস্তানের জন্মের সময় যে সব বাঙালি মুসলমান ভারত থেকে এপার বাংলায় এসেছিলো তাদের আটানব্বই ভাগ। আর এলাকায় সব চোর-ডাকাত অপরাধীরা। এইসব দেশিয় তাবেদার ডাকাতদের সমন্বয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা একটা সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে। যে বাহিনীর নাম ‘রাজাকার বাহিনী’।
এই রাজাকার বাহিনী সারা অঞ্চলে খুন-ধর্ষণ-লুট করতে থাকে। এমনই এক অস্থির আতংক ভরা দিনে মহির বাড়ি গ্রামের কুড়িফুল নদীর ঘাটে স্রোতের টানে ভেসে একখানা ডিঙ্গি নৌকা এসে ভেড়ে। এই নৌকার চরাটের উপর বেকে চুরে দলা হোয়ে পড়ে আছে প্রায় মাঝবয়সী এক মানুষ। নৌকা খানা কখন কোন্ দিক থেকে এখানে এসেছে তা কেহ জানে না।
খুব ভোরে নদীর পাড় দিয়ে শফিয়ার যাচ্ছিল। তার চোখে পড়ে ঘাটে একখানা নৌকা, ভেতরে পড়ে আছে একজন মানুষ! সে দ্রুত নদীর ঢালু পাড় বেয়ে নেমে নৌকার কাছে আসে। তার প্রথম ধারণা হয় নৌকায় পড়ে থাকা মানুষটা মৃত। সে লোকটাকে খুটিয়ে দ্যাখে পরিচয়ের সূত্র পাওয়ার জন্য। হঠাৎ তার নজরে আসে লোকটার বুক খুব ধীর বেতালে ওঠানামা কোরছে। মানুষটার মুমূর্ষু করুণ মুখ শফিয়ারের ভেতরে প্রবল মায়া আর দায়িত্ব জাগিয়ে তোলে। এই মায়া তাকে ভুলিয়ে দেয় সে যে কাজে যাচ্ছিল।
সে দ্রুত নৌকায় ওঠে। কুঁকড়ে থাকা লোকটাকে সোজা চিত করে। নদী থেকে আজলা ভর্তি পানি তুলে তার মাথায় দেয়। শুকনো ফাটাফুটি ঠোঁট ফাক করে ফোটা ফোটা পানি দেয়। নির্জীব লোকটা ধীরে ধীরে পানি পান করে। যে পানি তার ভেতর থেকে বের কোরে আনে ক্ষীণ কাতর গোঙ্গানী। আরও কিছু পরে তার ঠোঁট আর চোখের পাতা কাপে তির তির। হঠাৎ তার চোখের পাতা খোলে। চরম নিরাশা আর ক্লান্তি ভরা দৃষ্টি শফিয়ারের মুখের উপর দিয়ে পিছলে বন্দো হোয়ে যায়। সেই মুহূর্তে শফিয়ার একটা পরামর্শ অর্জন করে নিজের কাছ থেকে। সে দৌড়ে বাড়ি যায় এবং দ্রুত বাড়ি থেকে ফিরে আসে। তার সাথে আসে পরিবানু। তার হাতে এক গ্লাস হালকা গরম দুধ। দ্রুত তারা কাজে নেমে পড়ে।
বাপ মেয়ে মিলে নেতিয়ে পড়ে থাকা মানুষটার মুখে ফোটা ফোটা গরম দুধ দিতে থাকে। তারা বেশ কিছুক্ষণ এরকম করে। এর মাঝে গ্রামের আরও চারজন বাপ-মেয়ের সাথে মানবসেবায় যোগ দেয়। তারা সবাই মিলে প্রায় মৃত অজ্ঞান মানুষটাকে ধরাধরি করে শফিয়ারের বাড়ি নিয়ে আসে।
খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চাদ্দিক। আর গ্রামের সবাইকে টেনে আনে শফিয়ারের বাড়ি। সবাই নির্জীব মানুষটাকে দ্যাখে। আর ডানে-বায়ে মাথা নাড়ে কেহই তাকে চিনতে পারে না। মুখ দিয়ে সমবেদনার চুক চ ুক শব্দ করে।
শফি গ্রামের রেজা ডাক্তারকে ডেকে আনে। ডাক্তার রুগীকে পরীক্ষা কোরে বলে ‘খুব দুর্বল। শরীরে মারের চিহ্ন আছে। ঠিকমতো খাওয়া বিশ্রাম ওকে ঠিক কোরে দিবে।’ সে রুগীকে দুইটা ইনজেকশন পুশ করে, সাথে দেয় দাগকাটা শিশিতে তরল রঙিন সিরাপ।
দুপুরের আগে আগে অচেতন মানুষটা চোখ খোলে, ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে, তারপর হাত-পা নাড়ে। আরও কিছু পরে পাশ ফিরে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করে। শফিয়ার তাকে ধরে। পিঠের তলে বালিশ দিয়ে বেড়ার সাথে হেলান বসিয়ে দেয়।
লোকটা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ নিজের হাত দ্যাখে। ধীরে ধীরে মাথা তুলে শফিয়ারের দিকে তাকায়। শফি বলে ‘খাবা কিছু, দুধ দেই’?
লোকটা উত্তর দেয় না। তার মাথা বুকের কাছে ঝুলে পড়ে। তারপর মুহূর্তে সে শুয়ে চোখ বন্ধো করে ...।

শেষ বিকালে সবার সব ধারণা উড়িয়ে দিয়ে লোকটা উঠে বসে। শফিয়ার চেষ্টা করে তাকে আধা গ্লাস গরম দুধ আর অষুধ খাওয়ায়। তারপর সে শুয়ে গভীর ঘুমে ডুবে যায় ...।

পর সকালে মানুষটা অনেকটা সুস্থ হোয়ে উঠে বসে। শফিয়ার তার বউ আর পরিবানুর নাছোড় চেষ্টায় প্রায় আধা থালা ভাত খায়। তারপর সে তার কাহিনী বলে।
তার নাম আকবর গাজী। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ছিলো তার বাড়ি। ছিলো সাজানো সংসার, স্ত্রী কন্যা, কিন্তু আজ তা’ শুধুই স্মৃতি!
কয়েকদিন আগে এক সকালে তার গ্রামে পাকিস্তানি আর্মি আর রাজাকারের পাল হামলা চালায়। কেহ কিছু বুঝে উঠার আগেই গানবোট থেকে নেমে তারা পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। তারপর শুরু করে খুন-লুট-ধর্ষণ। তারা লুটের পর ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আকবর বাড়ির লাউ গাছে মাচা বানাচ্ছিল। ঘরে ছিলো তার বউ আর চৌদ্দ বছরের মেয়ে ফাতিমা। হঠাৎ একদল রাজাকার তার বাড়ি ঢুকে তাকে হাতপা বেঁধে বেদম পিটাতে পিটাতে ছুড়ে ফেলে উঠোনের একপাশে। আর কয়েকজন রাজাকার ঘরে ঢুকে ফাতিমাকে টানা-হেঁচড়া কোরতে থাকলে তার মা মেয়েকে রক্ষার জন্য রাজাকারদের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি কোরতে থাকে। তার এই কান্না রাজাকারদের বিরক্তি উসকে তোলে। তখোন তাদের প্রতিবেশী রাজাকার লুৎফুর মওলানা ক্ষেপে ফাতিমার মায়ের মাথায় রাইফেলের ব্যারেল ঠেকিয়ে গুলি করে। সাথে সাথে সে মরে ছিটকে পড়ে। মুহূর্তে শোক আর আতঙ্ক ফাতিমাকে স্থবির কোরে ফ্যালে। কিন্তু রাজাকাররা তাকে স্থবির থাকতে দেয় না, তারা হল্লা কোরে তার উপর বলাৎকার চালিয়ে যায় যতক্ষণ না তারা নিজেরা ক্লান্ত হয়। জ্ঞান হারিয়ে রক্তাক্ত ফাতেমা পড়ে থাকে তার মায়ের মৃতদেহের পাশে।
তারপর রাজাকাররা আকবরের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর লুৎফর মওলানা আকবরের কাছে এসে বলে মোছোলমানের ঘরে পয়দা হোয়ে মালাউনি কাম কোরিস? খানকির ছুয়াল তোরে জানে মারবো না, তোরে মারলি তো তুই বাচে গিলি, বাচে থাকপি আর মোনে অরবি, প্রচার অরবি জোনে জোনে এই গজবের কথা। তোরে দেহে আর কোন মুসোলমানের ছুয়াল মালাউনি কাম কোরতি সাহস পাবে না।’ তারা আরও কিছু সময় আকবরকে পেটায়, পাড়ায় তারপর চলে যায় সফলতার তৃপ্তিতে হাসতে হাসতে।
সন্ধ্যার অল্প আগে আকবরের জ্ঞান ফেরে। সে দেখে যেখানে তার অবশ্যই থাকার কথা সে জায়গাটা এখন ফাঁকা। সে অনেক চেষ্টায় হাত পায়ের বাঁধন খোলে। ভিটের পাশে যায়, ভিটের ভেতর থেকে বেরিয়ে একটা হালকা উত্তাপ তাকে ধাক্কা দেয়। না নেই, বউ-সন্তান-সংসার কিছু নেই। ভিটের উপর চোপ-ছাপ ছাই! সে নীরবে কাঁদতে থাকে ...
কতক্ষণ সে বসে বসে কাঁদে তা তার খেয়াল থাকে না।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। তার কষ্টমগ্নতার কাছে বৃষ্টি পাত্তা পায় না। সে বসে থাকে। বৃষ্টি পোড়েই চলে। অঝোর অফুরন্ত। বৃষ্টির সাথে তার কোনো সম্পর্ক তৈরি হোতে পারে না। সে কে ঁদেই চলে- ফাতিমা ফাতিমা নাম জপতে জপতে...।
মাঝ রাতের দিকে ভেতর থেকে ক্রম প্রসারিত একটা শীত তরঙ্গ তাকে দখল করে। কিছুক্ষণেই তীব্র মাথা যন্ত্রণা সহ প্রবল জ্বর তার ভেতরের সব রাসায়নিক শৃঙ্খলা এলোমেলো কোরে দেয়। যে কারণে তার স্মৃতি নির্ভর ব্যবস্থাপনা অকার্যকর হোয়ে যায়। আর সুখ-দুঃখ-ভয়-সাহস নিরপেক্ষ স্বভাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। অতপর স্বভাব তাকে সোজা দাঁড় করায় ঠেলে নিয়ে আসে নদীর ঘাটে। সেখানে বেঁধে রাখা নৌকায় তাকে তোলে। তারপর নৌকা ভাসিয়ে দেয়। আর তখোনই তার ভেতর থেকে ওঠা জ্বরের একটি তীব্র ঝাঁকুনি তার স্বতস্ফূর্ত হার্ডঅয়্যার এবং সফট্ওয়ারের সব সিস্টেম হ্যাং কোরে দ্যায়। এবং সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় নৌকার চরাটের উপর। তারপর আর কিছুই সে জানে না। কোন্ পথে, কীভাবে সে মহির বাড়ি গ্রামের শফিয়ার মোল্লার বারান্দায় এসেছে, কিছু সে জানে না!

শফিয়ারের পরিবার আকবরের জন্য তীব্র সহানুভূতি অনুভব করে। পরিবানুর ফাতিমার জন্য খুব কষ্ট হয়। শফিয়ার আকবরকে সান্ত্বনা দেয় আর তীব্র শ্রেণী এবং জাতীয় ঘৃণায় জ্বলে ওঠে এই জঘণ্য যুদ্ধ আর যারা তৈরি কোরেছে এই যুদ্ধ তাদের উপর।
বিশ্রাম সেবা আর সান্ত্বনা আকবরকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তোলে। পরিবানু ভাবে এই মানুষটা ফাতেমার বাবা না হোয়ে হোতে তো পারতো আমার বাবা। অথবা সে হোতে পারতো ফাতিমা!
সে চরম আন্তরিকতায় আকবরের সেবা করে।
আকবর ভাবে ‘নদী তুই আমারে কুথায় নিয়ে আসিছিস! এরা কারা। দরদী নদী- তুই আমারে আমার আপনজোন গে কাছে নিয়ে আসিছিস! পরিবানুই তো আমার ফাতিমা।’ এই চিন্তা তাকে সোজা দাঁড় কোরিয়ে দেয়।

যুদ্ধ বাজার ব্যবস্থা ধ্বংস কোরে ফেলে। আয়-ইনকামের সব সোজা রাস্তা বন্ধো কোরে দেয়। জীবনের জন্য জরুরি প্রতিটা জিনিসের দাম দাউ দাউ ফুঁসে লাফিয়ে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। সবচে বড় কথা অনেক অতীব দরকারী পণ্য বাজারে পাওয়াই যায় না। চাল, আটা, কেরোসিন দু®প্রাপ্য হোয়ে ওঠে।
পাকিস্তানি মিলিটারি আর রাজাকাররা প্রতিদিন লুট করে, খুন করে, ধর্ষণ করে আর জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম বন্দর-বাজার-মসজিদ-মন্দির-হাসপাতাল।
প্রতিদিন হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসা অজস্র ভয় ধরানো সংবাদে জীবন হোয়ে ওঠে অস্থির ...।
শফিয়ার একটা খবর পায় সৈয়দ বাড়ির ফজলু মীর আর তার শালা হরমুজ রাজাকার হোয়ে গেছে। তাদের সাথে আছে হারুন ডাকাত, আর তার দল। সেই সাথে ভাড়াটে খুনি বিল্লাল মুন্সির দল। তারা ইশকুলের মাঠে মিটিং কোরেছে। সেখানে এই অঞ্চলের শান্তি কোমিটির চেয়ারম্যান ইছুপ মওলানা ঘোষণা কোরেছে, এই গ্রামের যে সব দেশদ্রোহি মালাউনদের দেশ ভারতে গেছে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে, তারা আর যারা পবিত্র ভূমি পাকিস্তানের বিরোধিতা করে তারা সব কাফির, এসলামের শত্র“। আমরা এসলামের শত্র“দের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু কোরেছি। আমরা জেহাদি সৈনিক, বীর মুজাহিদ। আমরা আমাদের পবিত্র ভূমি থেকে কাফিরদের উৎখাত কোরবো।’
রেজাউল মাস্টার তার বাড়িতে রেডিওতে বিবিসির সংবাদ শোনে। সেখানে যুদ্ধের খবর শুনতে জমা হয় গ্রামের কয়েকজন। এই অপরাধে হরমুজের দল রেজাউল মাস্টারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে ইশকুলের মাঠে প্রকাশ্যে জবাই কোরে লাশ ফেলে রাখে। গ্রামের আরও কয়েকজনকে তারা গাছে ঝুলিয়ে পেটায়। তারা অস্ত্র হাতে দাপিয়ে বেড়ায সর্বত্র। যখোন তখোন এর ওর বাড়ি হানা দেয়, ছাগোল-গরু ধরে এনে জবাই কোরে খায় ...।
অনিশ্চয়তা আর অস্থির আতঙ্কভরা আরও এক সপ্তাহ পার হয় মহির বাড়ির গ্রামের উপর দিয়ে।
তারপর এক সকালে রাজাকার আর পাক আর্মিদের একটা দল মহির বাড়ি গ্রামে আসে। তাদের অভ্যর্থনা জানায় হরমুজের দল। আর কিছুক্ষণেই গ্রামের উপর নেমে আসে বিভীষিকা। একসাথে গর্জে ওঠে অনেক রাইফেল, শুরু হোয়ে যায় খুন, ধর্ষণ, লুট। আকাশে লাফিয়ে ওঠে আগুন। ধোয়ায় ঢেকে যায় সবকিছু। তার মাঝে জীবন বাঁচানোর জন্যে যে যেদিক পারে ছুটতে থাকে। হাহাকার, চিৎকার, হুংকার আর গুলির শব্দে কাঁপতে থাকে সারা গ্রাম।
কি একটা জিনিস কিনতে দোকানে আসছিলো শফিয়ার, সেখানেই আরও চারজনের সাথে রাজাকাররা তাকে খুন করে। এর কিছু পরে রাজাকার আর আর্মিদের একটা দল হানা দেয় শফিয়ারের বাড়ি। তারা বারান্দায় বসে থাকা আকবরকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটায়। সে উঠোনে ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে। আর্মিরা ধারণা করে সে মরে গেছে। তারা ঘরে ঢুকে পরিবানু আর তার মাকে মেঝেয় ফেলে বলাৎকার করে কয়েকপ্রস্থ। তারপর তারা রক্তাক্ত ফাটাছেড়া মুমূর্ষু পরিবানুকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকলে নিজের দূরবস্থার কথা ভুলে তার মা মেয়েকে ছেড়ে দেয়ার জন্য এক রাজাকারের পা পেঁচিয়ে ধরে হাউমাউ কাঁদতে থাকে। সেই রাজাকার ঝাড়া দিয়ে তার পা ছাড়ানোর চেষ্টা কোরে না পেরে পরিবানুর মায়ের বুকে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করে। সেখানেই কয়েকবার হাত পা ছুড়ে সে মরে পড়ে থাকে।
পাক আর্মি আর রাজাকারের দল দুপুরের পর পর্যন্ত বেদম উল্লাস আর উদ্দীপনায় খুন, ধর্ষণ, লুট করে। তারপর গ্রামের প্রাইমারি ইশকুলে ঘাটি করে। আর সেখানেই আরও কয়েকজন মেয়ের সাথে পরিবানুকে ধরে নিয়ে যায়।

সন্ধ্যার আগে আকবরের জ্ঞান ফেরে।
মাথাসহ শরীরের অসাড়তা প্রথমত তাকে বুঝতে দেয় না নিজের অবস্থা এবং অবস্থান। সে নিজেকে নড়াতে চেষ্টা করে। সাথে সাথেই তার বা কাঁধের নিচে থেকে এক তীব্র ধারালো যন্ত্রণা লাফিয়ে উঠে প্রবল ঘূর্ণি তুলে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। আর সহসাই যন্ত্রণা তাকে সবকিছু মনে করিয়ে দেয়।
ভয় আর উৎকণ্ঠা ধাক্কা দিয়ে দাঁড় করায়। সে তার সব আগ্রহ জড় করে কানে। তার কান থেকে বেরিয়ে সূক্ষè এবং শক্তিশালী ব্যাপক অনুসন্ধানী শ্রবণতরঙ্গ চারপাশ তন্ন তন্ন খুঁজেও কোনো শব্দের অস্তিত্ব ধরতে পারে না।
এবার সে দ্যাখে চারপাশ খুটিয়ে, ঘরের দরোজা হাহাকার হা, বারান্দায় পরিবানুর আদরের বিড়ালটা বসে বিষাদভরা গোমড়া মুখে। ঘরের ভেতর থেকে একটা রক্তের ধারা চৌকাঠের তল দিয়ে বেরিয়ে এসে বারান্দায় একটা ফোটা শাপলা ফুল হোয়ে উঠতে উঠতে থমকে আছে।
এক ভয়ংকর আশংকা আকবরকে একটা কড়া ঝাঁকি দিয়ে চাঙ্গা কোরে তোলে। সে হিচড়াতে হিচড়াতে নিজেকে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। মেঝেয় পড়ে চিৎ পরিবানুর মা, উলঙ্গ, রক্তাক্ত তার বা স্তনের ওপর একটা কালচে ছিদ্র। তার পিঠের তল থেকে একটা রক্তের ধারা চৌকাঠের তল দিয়ে বেরিয়ে গেছে খোলা দুনিয়ায়!
‘হায়- একি’ চিৎকার কোরে আকবর মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরে পাশের বাড়ির হাশেম। সে তাকে ঘর থেকে বের কোরে আনে। তারপর সে তার বউ এবং ছেলেকে ডাকে। তারা দ্রুত পরিবানুর মাকে কাপড় পেঁচিয়ে ঘরে থেকে বের কোরে আনে, গোসল করায়, শাড়ি দিয়ে কাফন তৈরি কোরে পরায়। বাড়ির পেছনের বাগানে কবর খোড়ে। কিছু দোয়া কালাম পড়ে তারপর তাকে কবরে শোয়ায় ...।
হাশেম আর তার বউ আকবরকে তাদের বাড়ি নিয়ে আসে। আকবর হাশেমের কাছেই শোনে রাজাকাররা শফিয়ারকে খুন কোরেছে আর তার লাশ নিয়ে ভাসিয়ে দিছে নদীতে। আর রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে পরিবানুকে!
হাশেম আকবরকে অভয় দিয়ে বলে, ‘এ বাড়িতে কোনো ভয় নেই। কারণ এই এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ইছুপ মওলানা আমার মামা শ্বশুর। আগামী সকালে পরিবানুকে ছাড়ায় নিয়ে আসপো।’
আকবর তার কথা শোনে কি-না বোঝা যায় না। সে বলে না কিছুই। নিজেকে ফেলে রাখে হাশেমের বারান্দার মাদুরের উপর। হাশেম আর তার বউ তাকে কয়েক বার ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা কোরে ব্যর্থ হয়। সে গুটিয়ে থাকে নিজের ভেতর। সে নিজের সম্পর্কে কোনো ধারণা কোরতে পারে না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ইন্দ্রিয় আর চেতনাগত সব অনুভূতি শূন্য অবস্থায় সে বিরাজ কোরতে থাকে।
ভয় আর শোকে ভরা রাতটা তার নিজস্ব নিয়মে সন্তর্পণে পার হয় মহির বাড়ি গ্রামের উপর দিয়ে। আলো ফুটতেই হাশেম তার বউকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয় ইছুপ মওলানার উদ্দেশ্যে। যার মাধ্যমে তারা পরিবানুকে ফিরে পাবার আশা করে।
আকবর হাশেমের বারান্দায় পড়ে থাকে। তার কান চোখ খোলা, কিন্তু সে দ্যাখে না বা শোনে না কিছুই। হাশেম বাড়ি থেকে বেরুনোর আগে তাকে বলে, ‘আপনি থায়েন, আমরা যাচ্ছি পরিবানুরে সাথে নিয়ে আসপো।
দুপুর নাগাদ হাশেম আর তার বউ পরিবানুকে সাথে নিয়ে ফিরে আসে। চেনাই যাচ্ছে না পরিবানুকে। সেই হাসি, প্রাণপ্রাচুর্যভরা মুখ। ভয়ে-কষ্টে শুকিয়ে এতোটুকু। উজ্জ্বল ফর্সা রং হোয়েছে ছাই। মুখে শরীরে জানোয়ারদের আঁচড় কামড় রক্তাক্ত কালচে হোয়ে ফুটে আছে। তার শরীরের সব রক্ত আর প্রত্যয় শুষে নিয়েছে রক্তচোষারা। তার চোখ-মুখ উজ্জ্বলতা আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জানোয়ারদের খপ্পর থেকে নিস্তারের আশায় চুপসে তার শরীরের মধ্যে ঢুকে যাবার চেষ্টায় মগ্ন। তাদের চেষ্টা অনেকটাই সফল। যে কারণে ভাসা ভাসা বর্হিমুখী চোখ-মুখ অনেক অংশে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
আকবর বসে ছিলো বারান্দায়। পরিবানু তার সামনে আসতেই সে ভুলে যায় তার সব যন্ত্রণা। এক অসীম ভালোবাসা আর দায়িত্ব তাকে তৎপর কোরে তোলে। সে লেগে পড়ে পরিবানুর সেবা আর সান্ত্বনায় ...। হাশেম আর তার বউ পরিবানু আর আকবরকে রেখে দেয় তাদের আশ্রয়ে।

সময় সবকিছু পাল্টে দেয়। তার আছে সবকিছু পাল্টাবার দৃশ্যহীন প্রকৌশল। সে ধীরে ধীরে তার নিয়মে পরিবানুকে সুস্থ কোরে তোলে। অবশ্য হাশেম তার বউ ছেলে আর আকবরের প্রাণ উজাড় ভালোবাসা আর সেবা ছাড়া সময় একা এতো তাড়াতাড়ি তাকে সারিয়ে তুলতে পারতো না।

অন্য বছরের তুলনায় এ বছর বৃষ্টিপাত অনেক বেশি।

সূর্যকে দেখা যায় না। সে ছাই রং মেঘের চাদরে সারাক্ষণ ঢেকে রাখে নিজেকে। রাত দিন রাত বৃষ্টি পড়েই চলে। কখনও গুড়ি গুড়ি কখনও অঝোর। কিন্তু থামে না কখনও। বৃষ্টির পানির সাথে যোগ দেয় সীমান্তের ওপার থেকে গড়িয়ে আসা পাহাড়ি ঢল। এই দু’জল এক হোয়ে সারা অঞ্চলে বন্যা বইয়ে দেয়। অবশ্য এই জল হোয়ে ওঠে বাঙালিদের পরম বান্ধব প্রাণপ্রহরী, যা পাকিস্তানি আর্মিদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে এক কোঠিন প্রতিরোধ, যে প্রতিরোধ পার হোয়ে জলপ্রতিবন্ধি পাকিস্তানি আর্মিরা সহসাই পারে না গ্রামে গ্রামে হানা দিতে। যে কারণে বেঁচে যায় বহু জীবন ও সম্পদ!
যতদূর চোখ যায় জল আর জল। নদী-খাল-বিল পুকুরের আলাদা সনাক্ত সীমা থাকে না। এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যেতেও নৌকা ভেলা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। এই বিস্তীর্ণজলের শরীরে জুড়ে অজস্র মাছ আর শাপলা-শালুক। যা খেয়ে বাঁচে মানুষের জীবন।
আকবর আর হাশেম বাড়ির আশপাশে কৈ জাল, ঘুনি-বানে পাতে, তাতে ধরা পোড়ে প্রচুর মাছ...।
মাস দেড়েকের মাঝে পরিবানু শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হোয়ে ওঠে। কিন্তু তার সেই চটপটে হাসিখুশি মেজাজ আর নেই। সারা সময় সে চুপচাপ, বিষাদময়। আগে তার আশপাশের যে কোনো কাজ বা কথায় সে নিজ থেকে অংশ নিত। কিন্তু এখন অনেক সময় কাছ থেকে ডেকেও তার সাড়া পাওয়া যায় না। তাকে ঝিম পাড়িয়ে পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে রাখে এক কোঠিন বিষণœতা, সে মাঝরাতে বা দিনের কোনো কোনো সময়ে আকুল কাঁদতে থাকে। তার এ সব মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের সময় হাশেমের বউ তাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা আর অভয় দিয়ে যায় তার সমস্ত আকাক্সক্ষা আর স্নেহ উজাড় করে।
পরিবানুকে হাশেমের পরিবারের সবাই আর আকবর সারা সময় চোখের পাহারায় রাখে। আর সারা সময় কোনো ছোটখাট কাজ না হয় গল্প-স্বল্প দিয়ে তাকে দখল কোরে রাখে। যাতে তার ভয়াবহ স্মৃতি কোনোভাবেই তার ভেতরে ঢুকতে না পারে। যদি কখনও কোনো ফাঁকফোক দিয়ে তার বিভীষিকাভরা স্মৃতি তার ভেতরে ঢুকে তার আচরণ কাণ্ডের শৃঙ্খলা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। তবে সাথে সাথে তারা এমন কিছু করে যাতে তার হতচ্ছাড়া স্মৃতি তাকে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।

হাওয়া শত শত মুখে শত শত কথা প্রতিনিয়ত বলে যায় ...।
এই হয়তো একমুখে হাওয়া বললো ‘মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের হটিয়ে দিচ্ছে’। পরমুহূর্তে হাওয়া তার আর একমুখে বলে ‘পাকিস্তানিদের পক্ষে জাহাজ ভর্তি মার্কিন আর চায়না সৈন্য আসছে। তারা আমাদের খুন কোরবে। আবার তার কিছু পরেই হাওয়া তার আর এক মুখে বলে আমেরিকানরা জাহাজ নিয়ে পালিয়ে গেছে। কারণ তাদের রুখতে ভারত মহাসাগরে রাশান আর ইন্ডিয়ান জাহাজ প্রস্তুত। এই প্রস্তুতির খবরটাই তাদের ভাগিয়ে দিয়েছে ...।
প্রতিদিন মহির বাড়ি গ্রামসহ তার আশপাশের গ্রামের দু’চারজন মানুষকে রাজাকাররা খুন করে। একই সাথে প্রতিদিন এসব এলাকা থেকে বহু মানুষ ঘর ছাড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ...।
আকাশ পরিবর্তনের খবর পাঠায় মানুষের ঘরে ঘরে। সে বৃষ্টি কমাতে কমাতে এক পর্যায়ে একদোম বন্ধোকোরে দ্যায়। দ্রুত বন্যার পানি গুটিয়ে যায় ভাটিতে। জেগে ওঠে গ্রাম-গঞ্জ, বিল-খাল-নদী। বর্ষার গোমড়া অভিমানকাতর আকাশ হোয়ে ওঠে ঝকমক আলোভরা বিশাল আর পান্নানীল। উত্তর থেকে গড়িয়ে আসে ফিকে হিম হাওয়া, সন্ধ্যার আকাশ থেকে নেমে আসে হালকা রহস্যময় কুয়াশা যা রাত বাড়ার সাথে ঘন হোয়ে ওঠে, উঠতেই থাকে যতক্ষণ না সূর্য এসে তাদের শুষে নেয় ...।
হঠাৎ হাওয়ার সব মুখ থেকে একটাই কথা বেরোতে থাকে, তা হচ্ছে একের পর এক প্রতিটা যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হোচ্ছে।
আকবরকে হাশেম একটা খবর কয় ফিসফিসিয়ে ‘শুনিছো, সাবডিভিশনের চারপাশের কয়েক গিরামে মুক্তিবাহিনী আইছে।’
আকবর বুঝতে পারে না মুক্তিযোদ্ধারা আসলে কি হবে?
তার ফাতিমা আর তার মা, পরীবানু তার বাবা-মা, তার লুট হওয়া কৌমার্য আর শান্তির জীবন, সংসার অথবা তাদের মত হাজার লক্ষ মানুষ কি ফিরে পাবে তাদের খুন হওয়া স্বজনদের? না পাবে না। তবে মুক্তিযোদ্ধারা এই জঘন্য অপরাধের বিচার কোরবে। আর তারা আসলে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর এই বিভৎস অত্যাচার আর হবে না। মানুষ শান্তি ফিরে পাবে। যে কারণে সে টান টান আগ্রহে অপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের আসার!

হঠাৎ এক দুপুরে মহির বাড়ি গ্রামের ক্যাম্প গুটিয়ে পাকিস্তানি আর্মি আর রাজাকাররা চলে যায় শহরে। তারপর দিনই মহির বাড়ি গ্রামের ছেলে আলতু মিয়ার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা গ্রামে আসে। তারা এসেই খুঁজতে থাকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ইছুপ মওলানা, ফজলু মীর আর তার শালা হরমুজ, হারুন ডাকাত, আফছার শেখ, শফি মৃধা, হারুন ডাকাত সহ অন্যান্য রাজাকারদের।
সে রাতেই চারপাশের গ্রাম থেকে বেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহর আক্রমণ করে।
আর সকালের সাথে সাথে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়। সারা অঞ্চল মুখর হোয়ে ওঠে স্বাধীনতার আনন্দে। এই আনন্দের অংশ হিসেবেই মহির বাড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষ ফজলু মীর, হারুন ডাকাত আর ওমর জল্লাদকে ধরে এনে গ্রামের হাটখোলার বটগাছে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে ...।
মহির বাড়ি গ্রামে যারা রাজাকার ছিলো পর্যায়ক্রমে তাদের সবাইকে পাওয়া গেলেও ফজলু মীরের শালা শত শত খুন ধর্ষণের হোতা হরমুজকে কোথাও দ্যাখা যায়নি। আজও না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ কবির হোসেন আপনার গল্পটি হৃদয় ছুয়ে গেল. ধন্যবাদ.
মোঃ আক্তারুজ্জামান ভাব বর্ণনার অসাধারণ গল্প| রানা ভাই অনেক অনেক শুভ কামনা জানবেন|
রবিউল ইসলাম অনেক বড় লেখা পড়ে ক্লান্ত...........
এশরার লতিফ অসামান্য গল্প...এই গল্প পড়লে বোঝা যায় কেন রাজাকারদের উপযুক্ত শাস্তি দরকার. (প্রথম অপহরণের ঘটনা মূল গল্প থেকে কিছুটা বিচ্যুত মনে হয়েছে. গল্পের ওই অংশে কবিরাজের একটা মন্তব্য ছিল :‘আমরা তো খুনি রাজাকার না, যে খালি খালি মানুষ মারবো।' তার মানে কি প্রথম অংশটি যুদ্ধের পরের ঘটনা ?)
আহমেদ সাবের অসাধারণ গল্প। হরমুজের ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে সত্য উদঘাটনের জন্য। অসাধারণ একটা গল্পের জন্যে আন্তরিক অভিনন্দন।
নাইম ইসলাম গল্পে দীর্ঘসূত্রতা থাকলেও ক্লান্তি লাগেনি, অনেক ভালো লেগেছে । ...অনেক শুভো কামনা রানা ভাই ।
মিলন বনিক অনেক দীর্ঘ গল্প...গল্পের ধারাবাহিকতা, বুনন চমৎকার....মাঝে মাঝে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে ছেদ পরলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখকের পাকা গাথুনি সেটাকে উতরে যেতে সক্ষম হয়েছেন। যেহেতু গল্প আর একটা সীমাবদ্ধতাও আছে (৩০০০শব্দের) সেই হিসাবে দাড় করলে আরও পাঠকপ্রিয়তা থাকতো বলে আমার বিশ্বাস...
অদিতি ভট্টাচার্য্য লেখাটা সুন্দর কিন্তু অনেক বড় হয়ে geche
তাপসকিরণ রায় এ তো দেখি উপন্যাস লিখে ফেলেছেন,ভাই!গল্পের শাখা প্রশাখার ভিড় হয়ে আছে।লেখাটি বর্ণনা মূলকও বটে।প্রতিযোগিতার শব্দ সীমার অনেক বাইরে চলে গেছে না? লেখাটি ভালো লেগেছে বটে তবে অনেক ধৈর্য ধরে পড়তে হয়েছে।তার কারণ হোল পাঠক হিসাবে আমরা জানি যে ৩০০০ শব্দের বেশী পড়তে হবে না।যাই হোক,বড় হলেও সুন্দর লেখা দেবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ আপনাকে ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য।
এফ, আই , জুয়েল # রানা ভাই চমৎকার লিখেছেন । রঙ বদলের খেলা---কিভাবে সময়ের সাথে পাকা খেলোয়ারেরা রঙ বদল করে আখের গুছিয়েছে ---এর সুন্দর বর্ননা ফুটে উঠেছে । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।।

০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪