বাংলা সিনেমা নিয়ে কোনো কিছু লিখতে গেলে আমার মাঝে সিরিয়াসনেস কম, স্যাটায়ার ভাবটাই বেশি কাজ করে। তবে আজ যে ছবির পোস্টমর্টেম করব, তাতে সিরিয়াস না হয়ে উপায় নেই, এর কারণ এই ছবির কাহিনী।
সিরিয়াল কিলারদের বৈচিত্র্যময় খুন করার কৌশল এর আগেও সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি হয়েছে, কিন্তু ২২ শে শ্রাবণ চলচ্চিত্রের ক্রমিক খুনি যেন এক ভিন্নতা নিয়েই ছবির পর্দায় আবির্ভূত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে খুন করা এবং খুন শেষে সেই কবির বিখ্যাত একটি কবিতার কিছু লাইন ঘটনাস্থলে রেখে যাওয়া- পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে কেবল স্বকীয় নয়, অনন্যও মনে হয়েছে। কাহিনীকার সৃজিত মুখার্জী চিত্রনাট্যে যতোটানা মুগ্ধ করেছেন, তার চেয়েও বেশি মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন পরিচালনায়। কাব্যের সাথে কাহিনীর যে সংযোগ তিনি ঘটিয়েছেন তা নির্দ্বিধায় অসাধারণ। যেমন প্রথম খুনের ঘটনাটিই ধরা যাক- রাত্রি ঘুমে ডুবে থাকা কলকাতার অলিগলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক ক্লান্ত-শ্রান্ত নিশিকন্যা, ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যাচ্ছে জীবনানন্দের “বনলতা সেন” থেকে উদ্ধৃত কিছু লাইন-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
দৃশ্যটির চিত্রায়ন দেখে মনে হবে কবি জীবনানন্দের হাত থেকে এই লাইনগুলো যেনো উক্ত আবহকে ফুটিয়ে তুলতেই রচিত হয়েছে । তবে অভিনেতা পরমব্রত চ্যাটার্জীর কণ্ঠে এই কবিতার আবৃত্তি খুব একটা মানায়নি, কেননা আবৃত্তির জন্য যে বলিষ্ঠতার প্রয়োজন- তা ছিল তার কণ্ঠে অনুপস্থিত। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে ছবির ষষ্ঠ এবং শেষ খুনের ঘটনাটিও উল্লেখ করার মতো। ছবির নামকরণের সার্থকতাও সেখানে লুকায়িত।
ছবিতে সাসপেন্সের অংশটুকু জমজমাট মনে হলেও রাইমা সেন আর পরমব্রত চ্যাটার্জীর ব্যাক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে। রাইমার সাথে ছবির মূল গল্পের সম্পৃক্ততা খুব কম-ই ছিল। তবে যেসব দর্শক ছবিতে গ্ল্যামার খোঁজেন কিংবা শারীরিক আবেদনের সুড়সুড়ি লাগিয়ে দেহটাকে চাঙ্গা করতে চান তাদের জন্য ওদের “লিভ টুগেদার” সম্পর্ক মাখন দিয়ে পাউরুটি খাওয়ার মতোই সুস্বাদু মনে হতে পারে। ছবিটি সম্পর্কে আরেকটি অভিযোগ এর সংলাপে। অশ্রাব্য শব্দের মাত্রাতিরিক্ত ও খোলামেলা ব্যবহার গল্পের শৈল্পিকতাকে চটুল করে তুলেছে। গালিগালাজের বিচারে এ যেনো কলকাতার ‘Delly Belly’!
এবার আসি অভিনয়ে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে প্রসেনজিত থাকলেও সবচেয়ে দ্যুতিময় ছিল গৌতম ঘোষের অভিনয়। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই ঊনত্রিশ বছর পর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বলা বাহুল্য, ক্যামেরার পেছনে তিনি যেমন দুর্দান্ত, সামনেও ঠিক তেমন-ই জীবন্ত। খ্যাপাটে ও ব্যর্থ এক কবি নিবারণ চক্রবর্তীর রহস্যময় চরিত্রে তাঁর অভিনয় ও আবৃত্তি- একেবারে দশ-এ-দশ! প্রসেনজিত অভিনীত প্রবীর রায় চৌধুরীর চরিত্রটিতে বৈচিত্র্য ছিল। অভিজিৎ চরিত্রে পরমব্রতর অভিনয় ক্ষেত্রবিশেষে ছেলেমানুষি মনে হয়েছে। আগেও বলেছি, রাইমা সেনের উপস্থিতি ছবিতে মূলত গ্ল্যামারের খাতিরে আর তার সহকর্মীর চরিত্রে আবির চ্যাটার্জী ছিলেন লোড শেডিং এক মুহূর্তে জেনারেটর দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের মতো। জুটি হিসেবে গুরু-শিষ্য প্রসেনজিত-পরমব্রতর রসায়ন ছিল উপভোগ্য।
“আমাকে আমার মতো থাকতে দাও ...” খ্যাত অনুপম রায়ের জীবনধর্মী কথা ও সুরে ছবির গানগুলো ছিল শ্রুতিমধুর এবং সেগুলোর দৃশ্যায়ন ছিল শৈল্পিক। বিশেষ করে রূপঙ্কর বাগচীর কণ্ঠে বৃষ্টিস্নাত সমাপ্তি সংগীত “গভীরে যাও” হৃদয়য়ের গভীরতা ছুঁয়ে যাবে।
এককথায় বাংলা সাহিত্যের প্রতি যাদের ভালোবাসা রয়েছে তাদের ছবিটি দারুণ লাগবে।
আমার রেটিং- ৪.৫ / ৫
পরিশেষে এটুকুই বলব, কলকাতার ছবিতে একটা পরিবর্তনের পূর্বাভাস পেয়েছিলাম অনেক আগেই। কিন্তু তা যে টালিউডকে এভাবে আমূল বদলে দিবে তা ভাবিনি । সেই পরিবর্তন দেখে এপার বাংলায় বসে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলার ইমো দেই আর ভাবি, ঢালিউডে সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া কবে লাগবে, আমাদের চলচ্চিত্র কেবল প্রচারে নয়, প্রসারেও এগিয়ে থাকবে।
সম্পূর্ণ ছবিটি ডাউনলোড করতে ক্লিক করুনঃ
http://www.youtube.com/watch?v=3nnns-pvDMs
(বি. দ্র. লেখাটি প্রিয় ভাইটিকে উৎসর্গ করলাম, যে কখনোই আমার কাছে কিছু চায়নি। এবার একটা অনুরোধ করেছে, আমি কি তা না রেখে পারি? বিশেষ ধন্যবাদ মামুন ভাইকে, আপনি না বললে হয়তো ছবিটি দেখাই হতো না!)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।