প্রথম ভারতীয় সাহাবী হযরত তাজউদ্দীন চেরামান পেরুমল (রাঃ)

Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon)
০২ অক্টোবর,২০১২

 

চেরামান পেরুমল উপমহাদেশের সর্বপ্রথম নাগরিক যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর পবিত্র সাহচর্য লাভ করে সাহাবী হবার গৌরব অর্জন করেন। উনার নিবাস ছিল ভারতের কেরালা প্রদেশের মালাবার অঞ্চলের কদুঙ্গাল্লুর এলাকায়। উনি উক্ত অঞ্চলের মহারাজা ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক উনার ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রাচীন বইয়ের মধ্যে এম. হামিদুল্লাহ রচিত “মুহাম্মাদ রসূলুল্লহ” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

‘চক্রবতী ফারমাস’ যা চেরামান পেরুমল এর অন্য একটি উপাধি, নিজ অঞ্চলে থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা বা অলৌকিক ঘটনা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেণ। এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা আরবের মক্কা নগরীতে সংগঠিত হয়। এ থেকে চেরামান পেরুমল অবগত হন মক্কা নগরীতে শেষ নবীর আবির্ভাব সম্পর্কে। উনি উনার পুত্রকে সম্যক অবগত হবার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে পাঠিয়ে দেন। ঘটনা সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হবার পরে উনি স্বয়ং দীর্ঘপথ ভ্রমন করে মক্কা নগরীতে গমন করে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। সেখানে মহানবীর সাহচর্যে কয়েকদিনে অবস্থান করে এবং হজ্জ পালন করে স্বীয় দেশে ফেরার পথে ওমানের ‘সালালা’ নামক অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন)। এই মহাত্মা সাহাবী (রাঃ) কে সেখানেই সমাহিত করা হয়।

 

 

(মহারাজা হযরত তাজউদ্দীন চেরামান পেরুমল (রাঃ) এর কবর) 

 

পবিত্র কোর’আনের সূরা-ক্বমার এ এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজার কথা উল্লেখ আছে। তাফসিরে মা’আরিফুল কোর’আনে উক্ত সূরার ব্যাখ্যায় এই পূন্যাত্মা সাহাবীর ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কথা উল্লেখ আছে। ওখানে আরো বলা আছে যে, মালাবারের এই মহারাজা ডায়েরী লিখতেন। যেদিন এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা সংগঠিত সেই, উনি সেইদিনের ঘটনা সবিস্তারে তারিখ সহ লিখে গেছেন। উনার রচিত সেই ডায়েরী এখনও সংরক্ষিত আছে।

 

ইন্দো-আরব সম্পর্কের সূচনা ঠিক কবে থেকে তা সঠিক ভাবে বলা মুশকিল। এটি প্রায় ২২০০ বছর পূর্ব থেকে ছিল বলে ইতিহাসে কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। তৎকালীন দিনে আরবরা কেরালা অঞ্চলে আসত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। এই অঞ্চলে তারা কাগজ, চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত ইত্যাদি বিক্রি করতো। তাদের এই বাণিজ্য মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্মের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ইসলাম প্রসারের পূর্বে আরবদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইহুদী ও খ্রিস্টীয় মতবাদের সূচনা হয়। ইসলামের প্রসারতা যখন ব্যাপক হারে বেড়ে যায় তখন আরবের সাথে কেরালা অঞ্চলের সম্পর্ক আরো বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। সেই সময়ে একদল আরব কেরালায় আসেন। তারা সেলন (বর্তমানে শ্রীলঙ্কায়) অঞ্চলে ভ্রমনে আসে যেখানে হযরত আদম (আঃ) এর পায়ের ছাপ রয়েছে। সেলন আসার পথে উনারা কেরালায় আগমন করেন।

 

মালাবারের কদুঙ্গাল্লুরের রাজা চেরামান পেরুমল চন্দ্রদ্বিখন্ডনের ঘটনার সত্যতা যাচাই এর জন্য সফররত ঐ আরবদের নিকটে লোক প্রেরণ করেন। ভ্রমনকারী আরবগণের মধ্যে শেখ সাহিরুদ্দিন ইবনে বাকিউদ্দিন আল-মাদানী (রাঃ) ছিলেন। উনি বলেন, ‘আমরা আরব এবং আমরা মুসলমান। আমরা সেলন যাবার পথে এখানে এসেছি’। মহারাজা চেরামান পেরুমল যিনি আগে থেকেই ইসলাম সম্পর্কে অবগত ছিলেন, আরো অধিক উৎসাহী হলেন উনাদের মুখ থেকে চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজার ঘটনার কথা নিজেই শোনার জন্য। কেননা এই আরবরা খোদ ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মদীনার অধিবাসী ছিলেন। সাহিরুদ্দিন (রাঃ) মহারাজার সব প্রশ্নের উত্তর সন্তোষজনক ভাবে প্রদান করেন। মহারাজা চেরামান পেরুমল  অতিশয় উৎফুল্ল হন এবং উপস্থিত আরবগণের নিকটে ধর্মান্তরিত হবার কথা ঘোষণা দেন। ঐতিহাসিক আহমেদ জেইনুদ্দিন মাখদুম উনার বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘তুহফাতুল মুজাহিদিন’ এ এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। অন্য একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘কেরালোলপাথি’ তে উল্লেখ আছে যে, চেরামান পেরুমল এরপরে মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে গমণ করেন। চেরামান পেরুমল উনার এই ধর্মান্তর হবার কথা গোপন রাখেন আর আগত আরবদেরকেও গোপন রাখতে বলেন। বিদায় নেবার প্রাক্কালে উনি আরব সফরকারীদের অনেক উপঢৌকন প্রদান করেন আর আরব সফর থেকে ফিরে উনাদের সাথে আবার সাক্ষাতের আশা ব্যক্ত করেন।

 

মহারাজা চেরামান পেরুমল নিভৃতে জীবনযাপন করতে লাগলেন। জীবনের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কেরালাতে অবস্থানরত আরবদের সাথে করে চললেন তাদের দেশে। পথে তারা ‘কয়লান্দি’ নামক জায়গায় অবস্থান করলেন। এরপর সেখান থেকে ধর্মপটনম। তিনদিন ছিলেন সেখানে। ওখান থেকে ‘শেহর মুকাল্লা’ গেলেন। ওখানে পৌছে তারা হজ্জে গমনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। মহারাজা ইসলাম কে প্রচারের উদ্দেশ্যে এরূপ সফর করলেন। এরপরে হজ্জ্ব পালন শেষে তাদের মালাবার ফেরত আসার কথা ছিল। কিন্তু ফেরার পথে রাজা অসুস্থ হয়ে গেলেন। আর ওমানের সালালা নামক স্থানে পৌছে মৃত্যুবরণ করেন। আর তার সফর সঙ্গীরা রাজার লেখা শেষ চিঠি নিয়ে মালাবার পৌছে। মহারাজা তখন ওমানের ভুমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত।

 

চেরামান পেরুমলের কাহিনী ‘থেয়ুম’ সঙ্গীতে এখনও মানুষ স্মরণ করে গর্বের সাথে। এই গানের কয়েকটি পংক্তি এরূপ- ‘পেরুমল যাত্রা করল তার সম্রাজ্যকে ধর্মপটনমে সমুদিরি কে দিয়ে। তার সাথীরা তার সাথেই ছিল। মহানবী তখন ছিলেন জেদ্দায়। পেরুমল সেথা গেলেন নবীজীর সাক্ষাতে। বাইয়াত হলেন নবীর হাতে। নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ‘তাজউদ্দীন’। আরাক্কাল উপাখ্যানেও উল্লেখ আছে যে, রাজা পেরুমল মক্কা ছেড়ে আসার পরে, নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘তাজউদ্দীন’। এইভাবে চেরামান পেরুমল সাহাবী হবার গৌরব অর্জন করলেন। মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় হবার আগেই কেরালায় ইসলাম ধর্মের এভাবে সূচনা হয়। সি.ভি. কুনহিরমন তার ‘কার্তিকোদায়াম’ পুস্তকে এই ঘটনা উল্লেখ করেছেন এইভাবে- ‘চেরামান পেরুমল ইসলাম গ্রহন করার পরে মক্কা থেকে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হন। স্বদেশ ছেড়ে মক্কা গমনের পূর্বে উনি তিরুভাঞ্চিকুলাম মন্দিরে, উনার সম্রাজ্যকে জামাতা আর কতিপয় আত্মীয়ের মাঝে বন্টন করে দেন । এই ঘটনা ঘটে ১৪০০ বছর আগে’।

 

মহারাজা চেরামান পেরুমল মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্য উপহার নিয়ে যান যা হাদীসে বর্ণিত আছে। হাদীস সঙ্কলনকারী হাকিম (রঃ) তার ‘মুস্তাদরাক’ নামক কিতাবে হাদীসটি সঙ্কলন করেছেন। হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী চেরামান পেরুমল (রাঃ) কে ‘মালিকুল হিন্দ’ তথা ‘ভারতীয় মহারাজ’ বলে সম্বোধন করেন।  

 

হযরত আবু সাঈদ সা’দ বিন মালিক বিন সিনান আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘ভারতীয় মহারাজ নবীজী (সাঃ) এর জন্য এক বয়াম আচার নিয়ে আসলেন যার মধ্যে আদার টুকরা ছিল। নবীজী (সাঃ) সেই টুকরাগুলা তার সাথীদের কে ভাগ করে দিলেন। আমিও খাবার জন্য একটি টুকরা ভাগে পেয়েছিলাম’।

 

সমগ্র উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে সাহাবীদের সীমাহীন মর্যাদা পবিত্র কোর’আন ও হাদীসে বিভিন্ন রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে। এক হাদীসে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য। তাদের কোন একজনকে অনুসরণ করলে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হবে’। হেদায়েতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের উপমহাদেশে উদিত হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য অতিশয় আনন্দের।   

 

 

 

 

 

তথ্যসূত্রঃ

 

১। http://www.jaihoon.com/454.htm

২। http://en.wikipedia.org/wiki/Cheraman_Perumal

৩। http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_non-Arab_Sahaba

৪। http://www.youtube.com/watch?v=IOV2spgVKXk

৫। http://www.youtube.com/watch?v=LmdZYGSnz9U

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Mohammad Farhad মাশাল্লাহ!!! অনেক ধন্যবাদ.
নৈশতরী রহস্যময় পৃথিবী মাঝে মাঝে চোখে মুখে ঘোর লেগে যায় ! ধন্যবাদ অনেক ধন্যবাদ এইরকম একটা চমকপ্রদ তথ্য উপহার দেবার জন্য !
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) ধন্যবাদ আপনাকে! ছড়িয়ে দিন এই তথ্যকে!

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

মার্চ ২০২৪ সংখ্যার বিজয়ী কবি ও লেখকদের অভিনন্দন!i