নতুন রহস্যে মোনালিসা

শামস্ বিশ্বাস
২০ জানুয়ারী,২০১৩

Mona Lisa

 

‘মোনালিসা’ নিয়ে তর্ক, বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, অনুসন্ধিৎসা সেই ১৫০০ শতক থেকে। চিত্রকলার ইতিহাসে এই চিত্রকর্মটির মতো আর কোনোটি এত আলোচিত ও বিখ্যাত হয়নি। নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যার তীর যেন কেবল একটি প্রশ্নবিন্দুতেই ধাবিত আর তা হলো, এ প্রতিকৃতিতে লিওনার্দোর সৃষ্টি ‘দ্য জিয়োকোনডা স্মাইল’ রচনা নিয়ে। হাসিটা কি করুণ নাকি আনন্দের? সেই কৌতূহলোদ্দীপক হাসির রহস্য সমাধান করতে গিয়ে তামাম দুনিয়ার বিজ্ঞদের যে প্রশ্নে আটকে যেতে হয় তা হলো, কে সে যাকে দেখে ভিঞ্চি সৃষ্টি করেছিলেন এই অপার্থিব সৌন্দর্যকে।

মোনালিসার মতো তার স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কম রহস্যময় নন। কে ছিলেন এই লিওনার্দো দা ভিঞ্চি? পাল্টে বরং প্রশ্ন তোলা যাক, কী ছিলেন না তিনি? তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের বহুমুখী প্রতিভা : ভাস্কর, স্থপতি, উদ্ভাবক, গণিতবিদ, লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ, শারীরবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ভূতাত্ত্বিক, ভ্রুণবিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী। উড়ন্ত যানের নকশা এঁকেছিলেন, আবিষ্কার করেছিলেন জলগতিবিদ্যার সূত্র, আন্দাজ করেছিলেন টেকটোনিক প্লেটের ধারণা, বের করেছিলেন সৌরশক্তি কেন্দ্রীভূত করার কৌশল, উদ্ভাবন করেছিলেন অভিনব সব সমরাস্ত্র, পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করেছিলেন রক্তের সঞ্চালন, দৃষ্টিশক্তির রহস্য ও হাড়ের সংস্থান। এত বিচিত্র সব কীর্তি, যেন একটি মানুষের নয়, অনেক মেধাবীর বর্ণনা। তার বিখ্যাত মুদ্রাদোষ ছিল ছবি অসমাপ্ত রেখে দেয়া। নোটবইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘ছবি আঁকা কখনো শেষ হয় না, আঁকা এক সময় ছেড়ে দিতে হয়।’

Leonardo da Vinci - Self-Portrait

বর্তমানে ইতালির ফোরেন্স প্রদেশের ভিঞ্চির এক গ্রামে, ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল জন্ম নেয়া লিওনার্দো দা ভিঞ্চিই সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বাঁহাতি। নোটবইয়ে সবকিছু লিখতেন উল্টো করে। দা ভিঞ্চি তার মডেলদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নোটবইয়ে টুকে রাখতেন। কিন্তু মোনালিসার চিত্রকর্মটির মডেল সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। কিন্তু কেন?

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে একটি পাইন কাঠের টুকরোর ওপর মোনালিসা ছবিটি আঁকেন। চিত্রকর্মের বাস্তব মানুষটির পরিচয় নিয়ে নানা অনুমান ও ধারণা প্রচলিত আছে। সর্বাধিক প্রচলিত মতটি হলো, ফোরেন্সের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী তার স্ত্রী লিসা দেল জিওকোন্দের প্রতিকৃতি আঁকার জন্য শিল্পীকে দায়িত্ব দেন। আবার কেউ বলেন ভিঞ্চি নিজের স্ত্রীকে অনুকরণ করেই সৃষ্টি করেছিলেন এই অমর সৃষ্টি। কেউ কেউ আবার এর মধ্যে লিওনার্দোর মাকেও দেখতে পান। অনেক গবেষকের মত এই চিত্রকর্মের পেছনে রয়েছে প্রেমিকা লিজা গোরদিনিউ। কেউ কেউ ছবিটিতে খুঁজে পান দা ভিঞ্চির তরুণ সহকারী ‘সালাই’ অর্থাৎ ‘খুদে শয়তান’, গিয়ান ক্যাপ্রোত্তিকে। কোনো কোনো গবেষক শনাক্ত করেছেন, শিল্পী হয়তো নিজেরই প্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন নারী ‘মোনালিসা’ অবয়বের মধ্যে।

দা ভিঞ্চি তার নোটবইতে লিখেছিলেন, ‘কবি তার শব্দাবলীর সাথেই বসবাস করেন, চিত্রকর কি সত্য সত্যই আদর্শের প্রতীককে উপস্থাপন করতে পারে?’ মোনালিসা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় ছবি এবং তিনি সবসময় এটিকে সাথেই রাখতেন। চিত্রশিল্পী ১৫১৯ সালে ৬৭ বছর বয়সে ফ্রান্সের লয়ের ভ্যালিতে মারা গেলে তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। শিল্পীর মৃত্যুর পর প্রতিকৃতিটি ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের করায়ত্তে ছিল। বর্তমানে এটি ফ্রান্স সরকারের সম্পত্তি। প্যারিসের ‘মিউজি ডুলভরি’ বা ল্যুভ জাদুঘরে দেখা মিলবে চিত্রকর্মটির।

মোনালিসার রহস্য জানার জন্য শিল্প বিশেষজ্ঞরা ৫০০ বছর ধরে ধাঁধায় রয়েছেন। সদ্য এই রহস্যের সাথে যোগ হয়েছে আরেক রহস্য। সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক মোনালিসা ফাউন্ডেশন প্রকাশ্যে এনেছে মোনালিসারই আরো একটি প্রতিকৃতি ‘ইজেলওয়ার্থ মোনালিসা’। এই সংস্থার দাবি, এই প্রতিকৃতিটিও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা এবং ল্যুভ মিউজিয়ামে রাখা ‘মোনালিসা’ থেকে অন্তত ১০ বছরের পুরনো। তাদের দাবি, মোনালিসা বলে যে প্রতিকৃতিটি সারা বিশ্ব চেনে, তার আসল রূপ এই পুরনো মোনালিসা। আর তা প্রমাণ করতে, এই প্রতিকৃতি উপস্থাপনা ছাড়াও, প্রায় তিন দশক ধরে গবেষণালব্ধ তথ্য সামনে এনেছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর (২০১২) ‘মোনালিসা : লিওনার্দোজ আর্লিয়ার ভার্সন’ নামক ৩০০ পাতার সচিত্রগ্রন্থ প্রকাশ করেছে এই সংস্থা। এর ফলে মোনালিসা নিয়ে বিতর্কে যোগ হলো নতুন মাত্রা।

১৯১৩ সালে এই ‘ইজেলওয়ার্থ মোনালিসা’কে খুঁজে পেয়েছিলেন ইংরেজ চিত্র সংগ্রাহক হিউ ব্লেকার। তিনি ইংল্যান্ডের সামারসেট এলাকার এক বাসিন্দার কাছ থেকে এই ছবিটি কিনেছিলেন। তারপর প্রতিকৃতিটিকে তার ইজেলওয়ার্থ স্টুডিওতে রেখেছিলেন। সেই কারণেই যমজ মোনালিসার নামের আগে বসে যায় ‘ইজেলওয়ার্থ’ শব্দটি। তারপর কয়েক হাত ঘুরে আসে সুইজারল্যান্ডের এই কনসোর্টিয়ামের কাছে।

দুই মোনালিসা ছবির প্রেক্ষাপট, আবেগ, ভার এবং কল্পনা প্রায় একই, যা শুধু ভিঞ্চির পক্ষেই রঙ-তুলি দিয়ে এই মুগ্ধতা, এই সম্মোহনী জাদু সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে পার্থক্য বলতে, ল্যুভে রাখা প্রতিকৃতি থেকে এটা খানিকটা বড়। প্রতিকৃতিতে ১০ বছরের পার্থক্য বিদ্যমান, চুলের ঢালেও রয়েছে পার্থক্য। ছবির পশ্চাৎপট আলাদা। সবচেয়ে বড় খটকাটা হলো, দ্বিতীয় এই মোনালিসা আঁকা হয়েছে ক্যানভাসে। দা ভিঞ্চি সাধারণত ছবি আঁকতেন কাঠের ওপর। তা হলে এই ইজেলওয়ার্থে মোনালিসা ক্যানভাসে কেন? ধারণা করা হচ্ছে, দা ভিঞ্চি ল্যুভ মিউজিয়ামে রাখা সেই মোনালিসাকে আঁকার কথা দীর্ঘ দিন ধরেই মনের মধ্যে সংগোপনে রেখেছিলেন। সেই কারণেই কিছুটা হয়তো ‘রিহার্সাল’ হিসেবে প্রথম মোনালিসা এঁকেছিলেন ক্যানভাসে। সেটি তারা পছন্দ হয়নি। তাই ১০ বছর পর অভ্যস্ত কাঠের ওপর সৃষ্টি করলেন অমর মোনালিসাকে।

দুই মোনালিসা নিয়ে বিতর্কে অর্থনৈতিক মূল্যও কম নয়। শুধু ল্যুভ-মোনালিসার জন্য ফ্রান্স দুনিয়ার পর্যটন মানচিত্রে যে জায়গা দখল করেছে, তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক শুধু মোনালিসাকে দেখার জন্য ল্যুভে যায়। এখন এই ‘ট্যুরিজম ইকোনমি’তে ভাগ বসাবে ইজেলওয়ার্থ মোনালিসার ‘মালিক’ সুইজারল্যান্ড। ইজেলওয়ার্থ মোনালিসা যে রেনেসাঁ যুগের লিওনার্দো দা ভিঞ্চিরই সৃষ্টি সে ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু প্রমাণ রয়েছে সুইজারল্যান্ডের চিত্রবিশেষজ্ঞদের হাতে। তারা শিগগিরই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লিওনার্দো স্টাডিজ বিভাগে তা জমা দেবেন। এই বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, ছবিটি যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চিরই আঁকা সে ব্যাপারে অঙ্কনশৈলীর ধারাবাহিকতার প্রমাণ দেয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত কিছু প্রমাণও পেশ করবে। ইতোমধ্যে দাবিগুলোকে সমর্থন করতে এগিয়ে এসেছেন বেশ ক’জন লিওনার্দো বিশেষজ্ঞ।

মোনালিসা ফাউন্ডেশনের দাবি যদি ‘সত্যি’ হয়, তবে যা অবশ্যম্ভাবী তা হলো, দুই মোনালিসার হাসির রহস্যময়তা এবং সৌন্দর্যের তুলনা। আরো একবার সেই সাথে উঠে আসবে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কের মানবিক দিক নিয়ে বিতর্কও। কারণ লিওনার্দো দা ভিঞ্চিই জানিয়েছেন, তার এই সৃষ্টি, অসমাপ্ত। তাহলে তিনি কেন একাধিকবার একই নারীর ছবি এঁকেছেন? ৫০০ বছর ধরে বিশ্ব যে দু’টি প্রশ্নে আটকে আছে তা আবার বড় করে দেখা দিয়েছে : কে-ই বা ছিল এই মোনালিসা? আর তার এই রহস্যময় হাসির রহস্যই বা কী?

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সালেহ মাহমুদ UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# মোনালিসা সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় বেশ উপকৃত হলাম। ধন্যবাদ লেখককে।
শামস্ বিশ্বাস আপনাকেও ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
এফ, আই , জুয়েল # সুন্দর রোমাঞ্চকর বর্ননা ।
নৈশতরী সত্যি চমৎকার রকম ভালো লাগলো...।
রনীল N/A UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL# জমজমাট একটা আর্টিকেল। লেখককে অনুরোধ করবো- এমন আরো গবেষণামূলক আর্টিকেল আমাদের জন্য পোস্ট করার জন্য ...

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

ফেব্রুয়ারী ২০২৪ সংখ্যার বিজয়ী কবি ও লেখকদের অভিনন্দন!i