শূন্যতা আছড়ে পড়ে চাবুকের মতো

শামস্ বিশ্বাস
১৯ জানুয়ারী,২০১৩

ছবি: শূন্য অঙ্ক
পরিচালনা: গৌতম ঘোষ
অভিনয়ে: প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়, কোঙ্কণা সেনশর্মা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ললিতা চট্টোপাধ্যায়, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অরিজিৎ দত্ত, প্রিয়াঙ্কা বসু।

 

শুরুতেই বলার, আপাতভাবে’শূন্য অঙ্ক’ রাজনৈতিক সিনেমা মনে হলেও, আসলে মোটেও তা নয়। অথচ, খুব কাছাকাছি সময়ে মুক্তি পাওয়া’চক্রব্যূহ’ কিংবা’সাংহাই’-এর থেকেও রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ, অনেক বেশি সরাসরি। এতটাই যে, ছবি দেখে মনে হতেই পারে বুঝি কোনও রাজনৈতিক দলের ইশতেহার। কিন্তু এই ভুল তখনই ভাঙে যখন আমরা প্রবেশ করি ছবির অনেক গভীরে। তখন মনে হয় আসলে সিনেমাটি সনাতন ভারতীয় গভীর এক বোধের কথাই বলতে চেয়েছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।

কাহিনীর সনাতন ভারত
আর এই কারণেই আমাদের চোখের সামনে পরিচালক গৌতম ঘোষ মেলে ধরেন’ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’-র একটা ভিন্নতর চেহারা। অথচ ছবির কাহিনী কেবলই ঘোরাফেরা করেছে এক পাহাড়ঘেরা রুক্ষ আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল এবং হিমাচলের দুর্গম এলাকায়। হাঁড়ির একটা চাল টিপলেই যেমন গোটা হাঁড়ির খোঁজ পাওয়া যায়, তেমনই মাত্র এই দুই জায়গায় বিচরণ করেই গৌতম গোটা ভারতের আসল চেহারার সন্ধান দিয়েছেন। এই ভারত -সন্ধান আমরা চাক্ষুষ করি অগ্নি বসু (প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায় ) নামের এক যুবকের চোখ দিয়ে।

 

কখনও অঙ্ক, কখনও’অ্যাক্ট’
ছবির কাহিনীকে দশটা টুকরোয় ভাগ করেছেন গৌতম। অনেকটা গ্রিক ট্র্যাজেডির ঢঙে বিবিধ’অ্যাক্ট’-এ ভেঙে। কিন্তু যেহেতু এটা সিনেমা, এবং সময়টা আধুনিক তাই প্রাচীন গ্রিক নাটকের চলন হুবহু অনুসরণ করেননি গৌতম। গৌতমের ছবির দশম বা শেষ’অ্যাক্ট’-এর নাম’অ্যাক্ট জিরো’ বা’শূন্য অঙ্ক’। এই’অ্যাক্ট জিরো’-ই হয়ে ওঠে গ্রিক ট্র্যাজেডির’এক্সোডস’ যেখানে আমরা শুনতে পাই’ওয়ার্ডস অফ উইজডম’ বা গভীর সনাতন বোধের বার্তা। ছবিতে’শূন্য’ এসেছে অন্য ভাবেও। প্রাচীন ভারতীয় বোধের প্রতীক হিসেবে। এই ভারত থেকেই গণিতের অলীক সংখ্যা’শূন্য’-র জন্ম।

ছবির চরিত্ররা
● অগ্নি বসুর চোখ দিয়ে আমরা গোটা ছবিটা দেখি। সেই ছবির সূত্রধর। অগ্নি কাজ করে এক বহুজাতিকে, যারা পূর্ব ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় বক্সাইট খননের কাজে লিপ্ত।
● অগ্নির স্ত্রী ঝিলিক (প্রিয়াঙ্কা বসু) প্রাক্তন এয়ারহোস্টেস। নাগরিক উচ্চবিত্ত অন্তঃসারশূন্য জীবনে বোরড গৃহবধূ।
● রাকা (কোঙ্কণা সেনশর্মা) এক দৈনিক সংবাদপত্রের ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক। তার মনে হয় আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এইভাবে পাহাড় খুঁড়ে বক্সাইট বের করে আনা আদিবাসীদের প্রতি অন্যায়। তার মনে হয় দেশের প্রশাসনই প্রকারান্তরে আদিবাসীদের মধ্যে সন্ত্রাস চালাচ্ছে।
● প্রবাল রায় (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ) মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রকাশে বিশ্বাসী। নাগরিক মানুষ। কিন্তু কোনও এক আদর্শে প্রাণিত হয়ে তিনি এখন আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করছেন চিকিৎসক হিসেবে।
● অর্জুন মুণ্ডা (অরিজিৎ দত্ত )। মূলত আদিবাসী, কিন্তু শিক্ষা কনভেন্ট স্কুলে। হিউম্যান রাইটস গ্রুপের সক্রিয় কর্মী।
● কবির চৌধুরী (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ) বিজ্ঞানী। যুদ্ধলিপ্সু দেশের সাইবার জগতে গোপনে প্রবেশ করে তিনি পৃথিবীতে শান্তি আনার স্বপ্ন দেখেন। তাঁর এই স্বপ্ন-সফরের একমাত্র হাতিয়ার’শূন্য’।

বোধের সঙ্গম
‘দারা শিকো’,’শূন্য’, লালন এবং রবীন্দ্রনাথ। গৌতমের ছবিতে বড় হয়ে উঠেছে এই চারটি প্রসঙ্গ। এদের হাত ধরেই গৌতম তাঁর’শান্তি’র বার্তা রেখেছেন। সম্রাট শাহজাহান -এর বড় ছেলে দারা শিকো। গৌতমের ছবিতে দারা শিকো হয়ে ওঠেন প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের অন্যতম শিক্ষক। তাঁর’মাজমা -উল -বাহরেন’ ছবিতে হয়ে ওঠে ভারতীয় বোধের আকরগ্রন্থ। যেখানে দারা জানিয়েছেন,’কুরআন’ আর’পুরাণ’-এ ফারাক নেই কোথাও।’সুফি’ এবং’বেদান্ত’ একই মুদ্রার আলাদা দুই পিঠ। শুধুমাত্র এই বোধের কথাই যদি প্রচারিত হয় তাহলেই দেশের ভিতরে সাম্প্রদায়িক শান্তি অটুট থাকবে। হিংসা দিয়ে এর সমাধান হয় না। ভারতবর্ষই যে গণিত শাস্ত্রে’শূন্য’ ধারণার জনক, এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। কিন্তু মতবিরোধ নেই যে ব্যাপারে সেটা হল আর্যভট্টই সেই মানুষ যাঁর’নাম্বার সিস্টেম’-এ শূন্যর উপস্থিতি প্রথম পরিলক্ষিত হয়’প্লেস হোল্ডার’ হিসেবে। গৌতমের ছবিতে বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী চাইছেন এই শূন্য সংখ্যা দিয়েই তিনি যুদ্ধবাজ দেশের সাইবার ওয়ার্ল্ড ধ্বংস করবেন। আসলে গৌতমের ছবিতে’শূন্য’ একটা রূপক। প্রাচীন ভারতীয় উইজডমের প্রতীক এই শূন্য। গৌতমের মতে ভারতীয় এই জ্ঞান দিয়েই আসতে পারে পৃথিবীর বুকে শান্তি। অর্থাৎ,’দারা শিকো’ আর’শূন্য’ ছবিতে এসেছে দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে শান্তি স্থাপনের সূত্র হিসেবে। এরই পাশাপাশি গৌতম উল্লেখ করেছেন দুই ভারতীয় কবির নাম। একজন লালন, অন্যজন রবীন্দ্রনাথ। যুদ্ধ এবং সন্ত্রাস বিরোধিতার দুই দেশজ আইকন। এইভাবেই এই চারটি প্রসঙ্গের হাত ধরে গৌতম নির্মাণ করেন তাঁর ছবির অর্ন্তনিহিত বার্তা।

ফ্রম’রিয়েল’ টু’রিল’
ছবির ঘটনা এবং চরিত্ররা অনেকেই উঠে এসেছে বাস্তবের জগত থেকে। যেমন ড. প্রবাল রায় অনেকটাই যেন বাস্তবের ড. বিনায়ক সেনের ছায়া। এখানেও ঠিক একই পরিস্থিতিতে প্রবাল রায় সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গ্রেফতার হন। ছবিতে বক্সাইটের খোঁজে যে এমএনসি কাজ করছে সেটি হল’যুগান্ত গ্রুপ’। বাস্তবে’বেদান্ত গ্রুপ’ নামের এক এমএনসি ঠিক একই কাজ করছিলেন ওড়িশার কালাহান্ডিতে। কোন্দ উপজাতি বিশ্বাস করত কালাহান্ডির সেই পাহাড় ওদের দেবতা, যে পাহাড় খুঁড়ে বক্সাইট বের করা হচ্ছিল। তারা প্রতিবাদ করেছিল দলবদ্ধভাবে। এর পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। রাকা নামের যে মেয়েটি ছবিতে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট, ঠিক হুবহু তার ঢঙেই এই সাংবাদিকতাই করেছিলেন বাস্তবে অরুন্ধতী রায়, জঙ্গি আদিবাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। এইভাবে বাস্তবের নানা চরিত্র এবং ঘটনা চলচ্চিত্রের কাহিনীতে এনে গৌতম তাঁর ছবিটিকে করে তোলেন এতটাই বাস্তবঘেঁষা যে মনেই হয় না কোনও সিনেমার বানানো গল্প বুঝি। আর এই কারণেই গৌতমের ছবি হয়ে ওঠে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
রাজনৈতিক ছবি নয়, অথচ রাজনীতি রয়েছে। তাহলে কী ধরনের ছবি’শূন্য অঙ্ক’? এক কথায় যুদ্ধ-বিরোধী ছবি। শান্তির ছবি। ঠিক যে অর্থে’গু-গা -বা -বা’ যুদ্ধ বিরোধী, ঠিক সেই অর্থে। তাই ছবিতে কবিরের স্ত্রী সোফিয়া (ললিতা চট্টোপাধ্যায় )-কে কখনও আমাদের মনে হয়’ম্যাকবেথ’-এর লেডি ম্যাকবেথ, আবার কখনও মনে হয়’বিসর্জন’-এর অপর্ণা। রক্তপাত এই দু’জনকেই ঠিক যেভাবে বিচলিত করে, সোফিয়াকেও ঠিক একইরকম। সে রক্ত দেখতে পায় কখনও ঘরের মেঝেতে, কখনও তুষারাবৃত প্রান্তরে। সাদা তুষারে ঢাকা প্রান্তরে ছোপ -ছোপ রক্ত ছড়িয়ে থাকে গোটা পর্দা জুড়ে, ডিজলভ করে যায় হাওয়ায় উড়তে থাকা সারি সারি সাদা শান্তির পতাকায় লাল ফুলের দৃশ্যে। এরকম দৃশ্য চমকে দেয় আমাদের।

অনেকদিন বাদে’সিনেমা’
বেশ কিছুদিন পর বাংলা ভাষায়’শূন্য অঙ্ক’ নামের একটি’সিনেমা’ তৈরি হল। এতদিন’সিনেমা’ বলে যা চলে আসছিল তা যে আসলে এক -একটি মনোরম’টেলিফিল্ম’ ব্যতীত কিছু নয়, সেটা প্রমাণ করলেন গৌতম ঘোষ।

 

মূল লেখা: অনিরুদ্ধ ধর

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) ভাই এটা কি আপনার নিজের লেখা?
শামস্ বিশ্বাস কপি পেস্ট- সিনেমাটা আর লেখাটা ভালো লাগার জন্য!!!
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১৩

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

মার্চ ২০২৪ সংখ্যার বিজয়ী কবি ও লেখকদের অভিনন্দন!i