সেনানায়ক থেকে সুফিসাধক: মির্জা আলী কুলি বেগ

শামস্ বিশ্বাস
০২ মার্চ,২০১২

সুফিসাধক মির্জা আলী কুলি বেগ (র.)-এর মাজার শরীফ

 রাজশাহীতে হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (র.)-এর মূল সমাধিসৌধের প্রবেশদ্বারের চৌকাঠের ওপর ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ × ৩৬ ইঞ্চর  কালো ব্যাসাল্ট পাথরে উৎকীর্ণ ও নাশতালিক বর্ণমালায় ফারসি ভাষায় লিখিত একটি শিলালিপি স্থাপিত আছে। ১৯৪৯ সালে শিলালিপিটির প্রথম পাঠোদ্ধার করেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন পরিচালক শামসুদ্দিন আহমদ। পরে তা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের বরেন্দ্র গবেষণা পত্রিকায় 'বরেন্দ্রের প্রাচীন মুমেন্ট' শীর্ষক প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়। ফারসি শিলালিপিটির বাংলা ভাষান্তর : 'সৈয়দ সনদধারী, মরহুম মগফুর, খুদা-সন্নিধানপ্রাপ্ত, মহা সম্ভ্রান্ত বংশজ অসীম ক্ষমতাশীল মহোত্তম আদর্শের প্রতীক, শাহ্ রূপোশের কবরের ওপর গম্বুজ নির্মাণের সৌভাগ্যপ্রাপ্ত (আলী কুলি বেগ); মহাসম্মানিত সম্রাট ইউসুফ সদৃশ প্রভু, মহাসম্মানিত শাহানশাদের প্রিয়তম সঙ্গী, সুলতানের ভূষণ, সৈয়দুল মুরসালিন রাসূলুল্লাহ (স.) ও আমিরুল মুমিনীন হজরত আলী (রা.)-এর আঙিনার কুত্তাসদৃশ প্রহরী, সাফাভী বংশোদ্ভূত শাহ্ আব্বাস হুসাইনী (র.)-এর ভৃত্য আলী কুলি বেগ কর্তৃক এই গম্বুজ ১০৪৫ হিজরি সালে নির্মিত হল। অস্তিত্বের চিরস্থায়িত্ব নেই জেনেও স্মৃতি রক্ষার্থে এই গম্বুজ নির্মাণ করা হল।' এখানে লক্ষণীয় যে, এই লিপিটি সম্রাট শাহজাহানের (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রি.) শাসনামলে অংকিত হলেও তৎকালীন প্রথানুযায়ী তাতে সম্রাটের নামের কোন উল্লেখ নেই। অথচ মির্জা আলী কুলি বেগ ওই লিপিটিতে পারস্যের শাহ আব্বাস সাফাভীর নামই শুধু উল্লেখ করেননি, উপরন্তু নিজেকে আব্বাস সাফাভীর একজন দাস ও ভক্ত-অনুসারী বলে পরিচয় দিয়েছেন। মোগল সাম্রাজ্যে বসে দিল্লিশ্বরকে বাদ দিয়ে শুধু পারস্যাধিপতির প্রতি ভক্তির কারণ হতে পারে দিল্লির প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না, কিংবা গোঁড়াপন্থি সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে তার কোন সদ্ভাব ছিল না, অথবা রাজকীয় প্রথা অবজ্ঞা করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতাধর ছিল শাহ মোকাররম মির্জা আলী কুলি বেগ (র.)-এর। তার সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তিনি ১০৪৫ হিজরিতে পারস্যাধিপতি শাহ আব্বাস সাফাভীর (১২৮৭-১৩২৯ খ্রি.) পক্ষে হজরত শাহ্ মখদুম রূপোশ (র.)-এর মাজার জিয়ারতের জন্য শাহ নূর (র.)-কে সাহায্য করার জন্য রাজশাহীতে আসেন। তিনি ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে হজরত শাহ্ মখদুম রূপোশ (র.)-এর অসিয়ত অনুসারে তার সমাধির ডান পাশে শাহ্ নূর (র.)-এর সমাধির জন্য স্থান রেখে গম্বুজসহ মাজার নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়াও মাজার-প্রাঙ্গণে মসজিদ, মুসাফিরখানা, ইমামবাড়ি ও হিন্দু ভক্তদের জন্য নহবতখানা নির্মাণ করেন। চান্দিসোনার সাজসরঞ্জাম দিয়ে একটি তাজিয়া চিরস্থায়ীভাবে তৈরি এবং 'মহররম' পালনের বন্দোবস্ত করে দেন। এ সময় তিনি প্রবলভাবে সুফি দর্শনে প্রভাবিত হয়ে সংসারধর্ম ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরে না গিয়ে মাজারের খেদমত ও এবাদত-বন্দেগিতে রত হয়ে পড়েন। প্রবাদ আছে, তিনি হজরত শাহ্ মখদুম রূপোশ (র.)-এর দর্শন লাভ করে তার মুরিদ হয়েছিলেন। মাজারের পাশে পশ্চিম দিকে একটা হুজরাখানা তৈরি করে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করতেন। প্রায় ১০ বছর মাজারের খাদেম থাকার পর তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য অলৌকিক আদেশপ্রাপ্ত হয়ে গোদাগাড়ী উপজেলার কোঁওরপুরের (বর্তমানে কুমারপুর কিংবা কুমরপুর) জঙ্গলাকীর্ণ একটি টিলায় আস্তানা গাড়েন। এখানেই সারাক্ষণ ধ্যান করতেন। মাঝে মাঝে লোকালয়ে সাধারণ লোকদের হেদায়েত দিতেন। তার সম্পর্কে প্রচলিত আছে, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, শুধু পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে তিনি বিশাল জনপদকে পদ্মার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করেন। কথিত আছে, তিনি জীবিত অবস্থায় তার আস্তানায় তার সমাধির স্থান নির্দিষ্ট করে তার ওপর গম্বুজঘর ও মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তার মুরিদানের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, তাকে ওই সমাধিতে মৃতাবস্থায় সমাধিস্থ করা হয়, কেউ কেউ বলেন, তিনি সশরীরে ওই সমাধির মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। ওই সমাধির একটি নির্দিষ্ট পাথরের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে কত রঙবেরঙের ফুলবাগ ও ঘরবাড়ি দেখা যায়। সমাধির পায়ের দিকের একটি ছিদ্রের মধ্যে কংকনকণা বা ছোট্ট ঢিল ফেললে কিছুক্ষণ পরে কোন সুগভীর পানিতে পড়ার মতো 'টুবুক' শব্দ শোনা যায়। প্রতি নামাজের ওয়াক্তে তার অজু করে যাওয়ার সম্পূর্ণ পদচিহ্ন দেখা যায়। প্রচলিত আছে, পারস্য থেকে নিয়ে আসা তার ধনরত্ন এই মাজার কম্পাউন্ডে কোথাও লুকানো আছে। তার অলৌকিক কেরামতে ও বুজর্গিদর্শনে স্থানীয় অনেকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আলী কুলি বেগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হল, বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব থেকে স্বধর্মাবলম্বীদের রক্ষা। হোসেন শাহী (১৪৯৪-১৫৩৮ খ্রি.) আমলে শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৬৩৩ খ্রি.) আবির্ভাব ঘটে। গৌড়ে যে ইসলাম বিস্তারের প্রতিক্রিয়ারূপে বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভব হয়েছিল, তা ঐতিহাসিক সত্য। গৌড়ের কেন্দ্র রামকেলীর প্রচারক যথা নিত্যানন্দ, অদ্বৈতাচার্য, নরহারি সরকার প্রভৃতি ভক্ত এবং পরবর্তীকালে রাজশাহীর বাজুহাত অন্তর্গত গড়েরহাট পরগনার জমিদার কৃষ্ণানন্দ দত্তের একমাত্র সন্তান খেতুরী গ্রামের (পদ্মার তীরে প্রেমতলীর সন্নিকট) নরোত্তম দাস দত্ত (নরোত্তম ঠাকুর) প্রমুখের (১৫৩১-১৬১১ খ্রি.) আবির্ভাব ঘটে। তাদের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে বৈষ্ণবমতের ক্রমোন্নতি হতে থাকলে মুসলমানদের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে নবদীক্ষিত মুসলিমদের অনেকে বৈষ্ণব ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এ সংকটময় সময়ে শাহ মোকাররম মির্জা আলী কুলি বেগ (র.) নরোত্তমের ঘোর প্রতিদ্বন্ধীরূপে আবির্ভূত হন। পারস্যের সাবেক সেনাপতি আবার তার অস্ত্রের ভাষায় ফিরে না গিয়ে, সুফিবাদের অহিংস পথে হাঁটেন। তার কুমারপুরের আস্তানাটি ছিল নরোত্তম ঠাকুরের সাধনপীঠ খেতুর দেড় মাইল পূর্বে ও পৈতৃক বাড়ির কাছে। তাকে কেন্দ্র করে সে সময় বহু সুফি-দরবেশের আবির্ভাব হয়েছিল। বৈষ্ণববাদের বিপরীতে সুফিসাধকরা সুফিবাদের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণী প্রচার করেন। এর ফলে মুসলমানদের বিশ্বাস আরও শক্ত হয়; বহু বৈষ্ণব এবং হিন্দু ইসলামে দীক্ষিত হন। ইসলামের সুমহান শক্তি দিকে দিকে বিস্তৃত হলে এ অঞ্চলের বৈষ্ণব প্রচার কেন্দ্র চিরতরে নিভে যায়। শাহ মোকাররম মির্জা আলী কুলি বেগ (র.)-এর মাজারটির সংস্কার প্রয়োজন। সদিচ্ছার অভাব আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল ছোবলে কোনমতে টিকে রয়েছে কয়েকটি সমাধি, কালো পাথরের তৈরি প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী আর একটা ইটের ঘরের ভগ্নাবশেষ। ঘরটার ছাদ সেই কোনকালে ভেঙে গেছে, জীর্ণ দেয়ালগুলো কোন রকম দাঁড়িয়ে আছে। এই ঘরের ভেতর ছয়-সাতটি কষ্টিপাথর দিয়ে বাঁধানো সমাধিতে শায়িত আছেন শাহ মোকাররম মির্জা আলী কুলি বেগ (র.)। এই সমাধিসৌধের গঠনরীতি অভিনব এবং উপরে একটি গোল গম্বুজ ছিল বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত তা সপ্তদশ শতকে মোগল আমলে নির্মিত। এখানকার ব্যবহৃত কষ্টিপাথরের মতো পাথর সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭ খ্রি.) ও শাহজাহানের (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রি.) আমলে দিল্লি এবং আগ্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। এই সমাধিতে তিনটি লিপি উৎকীর্ণ আছে। তার মধ্যে প্রথম দুটি হল সূরা আর রাহমানের ১৬ ও ২৭ নম্বর আয়াত, যার অর্থ_ 'পৃথিবীর সব কিছুই লয়প্রাপ্ত হয়ে যাবে কেবল পরম সৌভাগ্যশালী আল্লাহ্‌ তায়ালার মহিমা, সম্মান ও বদান্যতা অক্ষুণ্ণ থাকবে।' অপরটি ফারসি, যার অর্থ : 'যদি কেউ এই ঘর (সমাধি) থেকে একটি প্রস্তরখণ্ড স্থানান্তরিত করে, তাহলে ইহকাল ও পরকালের জন্য পবিত্র কোরআন তার দুশমন হবে; তার ওপর হাজারো অভিশাপ (গজব) বর্ষিত হবে এবং সে দোজখের আগুনে পুড়বে।' পরবর্তীকালে সুফিসাধক শাহ মোকাররম মির্জা আলী কুলি বেগ (র.)-এর নামানুসারে ওই জায়গার নামকরণ করা হয় কুমুরপুর। ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন। রাজশাহী শহর থেকে নয় মাইল পশ্চিমে গোদাগাড়ী উপজেলার কুমারপুর গ্রামের এক টিলায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পারস্য সেনানায়ক ও বাংলার অন্যতম খ্যাতিমান সুফিসাধক শাহ মোকাররম মির্জা আলী কুলি বেগ (র.)। প্রতি ফাল্গুনের শেষ বৃহস্পতিবার তার ওরশ অনুষ্ঠিত হয়।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) অনেক সুন্দর আর তথ্যবহুল একটা লেখা. এমন লেখা আপনার কাছ থেকে আরো চাই!

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

ফেব্রুয়ারী ২০২৪ সংখ্যার বিজয়ী কবি ও লেখকদের অভিনন্দন!i