উত্তরাধুনিক পর্যায়
আশির দশক থেকে এই দেশে যে উত্তরাধুনিক কবিতার চর্চা হয়েছে সে ধরণের কবিতা বা শিল্পের বিভিন্ন নাম আছে- যেমন ডাডাইজম, সুররিয়ালিজম, নিও ক্রিটিক প্রভৃতি। প্রথম যুদ্ধ সূচনাকালে ডাডাইজমের মাধ্যমে এটার সূত্রপাত হয় ১৯১৬ এর দিকে। এই ধারার মূল বিষয় ছিল 'বিরাজমান সংস্কৃতি যুদ্ধের জন্ম দেয়; কাজেই এর বিরোধিতা করা উচিত। শিল্পকে হতে হবে বিমূর্ত । কেননা, এটি পরিকল্পনা ও যৌক্তিক চিন্তাধারার বিপরীত। পরিকল্পনা ও যৌক্তিক চিন্তাধারা জন্ম দেয় যুদ্ধের আবহ।' কবিতাকে অন্যান্য শিল্পের মত বিমূর্ত করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ধারাটি ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এই ধারাটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে দুই বাংলার দুটো প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমবঙ্গের কৌরব প্রকাশনী এবং বাংলাদেশের জোনাক রোড প্রকাশনী। বাংলাদেশের আন্দালিব আমীন, মুক্তি মন্ডল, কানাডাপ্রবাসী মেজবাহ আলম অর্ঘ্য, হীরা, পশ্চিমবঙ্গের- বারীন ঘোষাল, সব্যসাচী সান্যাল প্রমুখ কবিদের হাতে এই শিল্পটি বেশ পাখা মেলতে শুরু করে। বিমূর্ত করার পাশাপাশি এটা কবিতার সব ধরনের কাঠামোকে অস্বীকার করে। কবিতা ছন্দ কিংবা কোনরকম ফরম্যাটেই লেখা হবে না। কবিতা হতে হবে সব ধরনের বাধন থেকে মুক্ত এমনকি বিষয়েরও। এইসব ধারণার একটা হল ডেথ অব অ্যান অথর। অর্থাৎ কবিতা লেখার পর থেকেই কবি অনুপস্থিত। পাঠকরা যে যার মত অর্থ করে নেবেন। আসলে মুক্তির বোধ হয় কোন সীমারেখা নেই। কবিতার এই চর্চা থেকে আগেও বলেছি সবই থেকে গেছে শুধু সাধারণ পাঠকরাই কবিতা থেকে দূরে সরে গেছেন।
প্রশ্ন হল আমরা কবিতা ও পাঠককে একীভূত করতে প্রয়াসী হব কিনা? এ বিষয়ে আসলে নানাবিধ মতবাদ আছে। কেউ বলেন কবিতা লিখতে হবে শিল্পের প্রতি দায় থেকে। পাঠকের কথা চিন্তা করে যারা লিখবেন তারাই ব্যর্থ হবেন। কেউ বলেন পাঠক যদি নাই পড়ল তাহলে কবিতাকে কবিতা বলবে কে? এ প্রশ্নের মীমাংসা বোধ হয় হয়নি আজো। তবে আমরা একটা ব্যাপার দেখেছি- জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদেরা সাধারণ্যে পরিচিত হয়েছেন মূলত কিছু সাধারণ পাঠকপ্রিয় কবিতার মাধ্যমেই।
আশির দশক থেকে যে আমরা কোন কবিকে চিনে উঠতে পারছি না এর পেছনে এই সাধারণ পাঠকপ্রিয় কবিতার অভাবই মুখ্য কারণ। আবার পাশাপাশি একথাও সত্য যে জীবনানন্দ দাশ তার সময়ে কবি হিসেবে পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। মৃত্যুর আগে তিনি নাকি মানুষকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তার কোন কবিতাই কি কবিতা হয়নি? ভাবুন দেখি যাকে আমরা শুদ্ধতম কবি বলে দাবী করি, যার ’বনলতা সেন’ বাংলা ভাষায় সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং পঠিত কবিতা- তার এই অবস্থা। কাজেই এই আলোচ্য বিষয়টিতে আমি বরাবরই দ্বিধাগ্রস্ত।
সাধারণ পাঠক আর বোদ্ধা পাঠক এরকম একটা বিভাজনরেখাও তৈরি হয়ে গেছে কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে। জনপ্রিয় সাহিত্য সচরাচর সমালোচকপ্রিয় হয় না। জনপ্রিয়তা আর শিল্পমান দুটো দুই প্রান্তে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু আমরা দেখি শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েও সমালোচকপ্রিয় সাহিত্যক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ছিল তার নিজের সময়ে। তবু কথা থেকেই যায় যে কোন রচনা থেকে রস গ্রহণের ক্ষমতা সবার সমান হয় না। যে রচনা থেকে সাধারণ পাঠক রস পান সেটা থেকে বোদ্ধা পাঠক রস না পেতেই পারেন আবার উল্টোটা তো বেশীরভাগ সময়েই সত্য। আবার এই যে বিভাজনটি করলাম, সেটাও এত সরল না।
ছোটবেলায় গল্প পড়ার সূচনা হয়েছিল 'নিশি অবসান' নামে একটা রাজপুত্র রাজকন্যার প্রেমকাহিনীভিত্তিক উপন্যাস পড়ার মাধ্যমে। বলা যায় রীতিমত মুগ্ধ হয়ে যাই। এরপর অনেকদিন পরে বইটা আবার হাতে আসে। পুরনো মুগ্ধতার স্মৃতি জমানো ছিল নিওরনে। তাই আবার খুলি বইয়ের পাতাটা। কিন্তু ততদিনে অনেক পড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। রুচির যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে সেটা টের পেলাম- নতুন করে বইটা হাতে নিয়ে। এমন সস্তা একটা লেখা পড়ে মজা পেয়েছি ভেবেই হাসি পেল। তো এরকম পাঠকরুচি সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়। এবং এই রুচির অনেক পর্যায় থাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা এর কোন মুখেই কোন সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়নি। আবার অনেক লেখকের হয়ত ক্ষমতা থাকে সমালোচক এবং বেশীরভাগ পাঠক দুপক্ষকেই তুষ্ট করে সাহিত্য রচনার।
আমরা বরং সাম্প্রতিক সময়ে কবি আল মাহমুদের এ মন্তব্যটি শুনি। তিনি বলেছেন, ‘বাংলা কবিতার একটা মোড় ফেরা উচিত’। মোড় ফেরানো বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন জানি না। হতে পারে কবিতাকে পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়াকে বুঝিয়েছেন। হতে পারে অন্য কিছু। তবু এখনকার অন্তর্জাল সাহিত্যের সময় কবিতা এবং যে কোন সাহিত্যেরই একটা অন্য ধারায় পরিবর্তনের সূচনা এমনিতেই হওয়া স্বাভাবিক। আমরা শুধু অপেক্ষা করে থাকতে পারি সেই নতুন সময়ের কবিদের জন্য।
শেষ সংলাপ
সবশেষে নবীন কবিদের জন্য কিছু পরামর্শ। এটা আপনাকে গ্রহণ করতেই হবে এমন না। তবে যুক্তিগ্রাহ্য হলে ভেবে দেখতে পারেন। সেটা হল, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে আপনাকে কেউ আলাদা করে চিনবে না। মানে হোক, বক্তব্যে হোক, আঙ্গিকে হোক, ভঙ্গীতে হোক আপনাকে অবশ্যই নতুন কিছু করে দেখাতে হবে। এই ফেসবুক, সোশাল মিডিয়া, ওয়েবজিন, লিটল ম্যাগ, কবিতা ফোরামের যুগে অনেক কবিরা বেরিয়ে আসেন কিন্তু টিকে থাকতে পারেন না স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন বলে। অথচ ভিড় থেকে আলাদা হওয়ার জন্যই সুকান্ত ভট্টাচার্য খুব বেশী উঁচু মানের কবি না হয়েও সবার নজরে পড়েছিলেন। তিনি তার বক্তব্য দিয়ে একেবারে স্বতন্ত্র একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন। এই ভিড়ের স্রোতে মিশে যাবার জন্যই শেষ তিন চার দশকে আমরা আলাদা করে অনেক কবিকেই চিনতে পারছি না। সুতরাং যাই লিখুন স্রোতকে অনুসরণ না করে নতুন কিছু করুন। আর নতুন কিছু করতে হলে অবশ্যই পুরনোকে ভালভাবে চিনতে হবে। পুরনো ঘরগুলোকে না চিনলে, পুরনো ঘরগুলোর ডিজাইন, কাঠামো, অবস্থান ইত্যাদি না জানলে আপনি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারবেন না। যা সৃষ্টি হবে তা কোন না কোনভাবে পুরনোকেই অনুসরণ করবে। এজন্য আপনাকে প্রথমত অনেক জানতে হবে, অনেক পড়তে হবে। আর নতুন সৃষ্টির প্রক্রিয়াটাও একটা প্রবহমান বিষয়। প্রতিনিয়ত নিজের গড়ে তোলা আঙ্গিক, অবস্থান থেকেও নিজেকে বেরিয়ে আসতে হবে অর্থাৎ পর্যাপ্ত বৈচিত্র্য থাকতে হবে লেখায়, চিন্তায়, উপস্থাপনায়। এবং এটা কবিদের উদ্দেশ্য করে বলা হলেও যে কোন সৃজনশীল শিল্পের ক্ষেত্রেই এই বক্তব্য প্রযোজ্য।
(যারা লেখাটি পড়লেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি কারো যৌক্তিক দ্বিমত থাকে তাকেও স্বাগতম। এখানে কিছু সংগৃহিত তথ্য যেমন আছে, তেমন কিছু ব্যক্তিগত চিন্তার জায়গাও আছে। তথ্যে যেমন ভুল থাকতে পারে তেমন আমার ব্যক্তিগত ধারণার সাথে সবাই একমত হবেন এমন ভাবনাও আমাকে তাড়িত করে না। শুধু একটাই সনির্বন্ধ অনুরোধ, পুরো লেখাটার মূল টোন না বুঝে কেউ দয়া করে বিরোধিতার স্বার্থে অন্ধ বিরোধিতা করবেন না। এটা কোন লেখক বা কবিকে ছোট বা বড় করার জন্য লেখা হয়নি। মাস কয়েক আগে একটা লিটল ম্যাগের বিষয় হিসেবে লেখাটার সূচনা করেছিলাম- আগেই বলেছি বন্ধু সূর্যর অনুরোধে। সে সময়ে শেষ করতে না পারায় লিটল ম্যাগটির পরবর্তী সংখ্যাকে টার্গেট করে লেখাটা শেষ করলাম।)
(সমাপ্ত)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।