১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের স্বর্ণ যুগ। ওখানকার পড়ালেখার মান তখন কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের মানকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে। ১৯৪৬ কিম্বা ১৯৪৭ সালে আমার বাবা ওই কলেজের ছাত্র। তো সেখানে ইংরেজী সাহিত্য পড়াতেন অসম্ভব বিনীত এবং লাজুক একজন শিক্ষক। তিনি খুব যত্ন করেই পড়াতেন কিন্তু এই অতিরিক্ত বিনয়ের কারনে পড়াবার সময় ছাত্রদের দিকে খুব একটা চোখ তুলে তাকাতেন না। আমার বাবা এবং অন্যান্য ছাত্ররা এই নিতান্তই নিরীহ এবং গোবেচারা শিক্ষকটিকে চিনতেন জে ডি নামে। এই বিনয় দিয়েই তিনি একটা প্রাইভেসীর সীমা রেখা টেনে দিয়েছিলেন, সে কারনে তার ব্যাপারে ছাত্ররাও খুব বেশী জানতে আগ্রহ বোধ করেনি।
আরেকজন শিক্ষকের কথা বলি। ১৯৮৫ অথবা ১৯৮৬ সাল। আমার বাবা নিজেও তখন ঢাকা বিশব্বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন । সেই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে থাকতাম। বেশীরভাগ শিক্ষকের ছেলেরাই বন্ধু। তখনকার রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের বাসায় তার ছেলের জন্মদিনের ঘরোয়া দাওয়াত। দেখা গেলো আমন্ত্রিত অতিথি তিনজনঃ আমি, আমার অকালপ্রয়াত বন্ধু জিয়া (আমার তখন মাত্র হাই স্কুল লেভেলের ছাত্র) এবং কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একজন প্রায়-মধ্যবয়সী শিক্ষক। বৈঠকখানায় সবাই বসে আছি। ওই মধ্যবয়সী শিক্ষক কারো সাথেই কোন কথা বলছেন না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বুক শেল্ফ থেকে একের পর এক বই নিয়ে গভীর মনোযোগে পড়ে যাচ্ছেন। ভাবলাম উনি কী জন্মদিনে এসেছেন না পাবলিক লাইব্রেরীতে? এরপর বহুবার ওই শিক্ষককে দেখেছি ফুলার রোডে রিকশা দিয়ে আসতে যেতে । প্রতিবারই তার হাতে কোন না কোন বই এবং যথারীতি নিবিষ্ট মনে পড়ছেন।
আমার বাবার যে শিক্ষকের কথা প্রথমেই বলেছিলা তার পুরো নাম জীবনানন্দ দাস- বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবিদের একজন। কেউই তখন বলেনি যে ওই জে ডি-ই হলো the জীবনানন্দ দাস।
দ্বিতীয় যে শিক্ষকের কথা বললাম, তিনি আমাদের অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ। যখনকার কথা বলছি তার চার পাঁচ বছরের ভেতরেই তিনি খাতির শিখরে উঠে যাবেন।
এনাদের দুজনের কাছ থেকে দুটো শিক্ষা নেয়া যায়ঃ বিনয় এবং বই পড়া। ইদানীং এ দুটোরই অভাব নিজের এবং আশেপাশের অনেক লেখকের ভেতরেই টের পাই।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।