"নিজের প্রয়োজনে অনেক সময় অনেক ওয়েব সাইট আমাকে দেখতে হয় । গতকাল (২২.০২.২০১২) দৈনিক প্রথম আলো এর ফিচার পাতা "সপ্ন নিয়ে" দেখছিলাম। আমার মনে হল এই বিষয়টি গল্পকবিতা-র বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা যায়।"
=================================
শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসেন কেউ কেউ। ভালোবাসেন শব্দের পর শব্দ সাজাতে, গাঁথতে শব্দের মালা। যে মালা মলাটবন্দী হয়ে নাম ধারণ করে ‘বই’। আর কে না জানে, একটি বই হাতে নিয়ে স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যান পাঠক। কখনো হাসেন, কখনো কাঁদেন কখনো বা ডুবে যান গভীর কোনো ভাবনায়। পাঠকের আবেগ নিয়ে এমন খেলা খেলেন যাঁরা, তাঁরাই তো শব্দের কারিগর কিংবা শব্দ-শ্রমিক। তাঁদের আরেক পরিচয় ‘লেখক’। তবে নির্দয় সত্য হলো এই, সব লেখক পারেন না পাঠককে নিয়ে এমন খেলা খেলতে। পারেন না সত্যিকারের লেখক হয়ে উঠতে। শোনা যাক পূর্বসূরিদের কথা, যাঁরা সত্যিকারের লেখক হয়ে উঠেছেন।
সৈয়দ শামসুল হক
তরুণ প্রজন্মের যারা লেখক হতে চায়, তাদের জন্য আমার একটাই পরামর্শ—পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। লেখক হওয়ার জন্য পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে তোমার পড়াটা হতে হবে বিশ্লেষণধর্মী। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একটা লেখাকে পড়তে হবে। এতে তোমার অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হবে। মনে রেখো, অন্তর্দৃষ্টি শাণিত না হলে তোমার লেখা কখনো মানোত্তীর্ণ হবে না। কালোত্তীর্ণও হবে না। অনেকে আবার বলে থাকেন, সুসাহিত্যিক হতে হলে অবশ্যই ধ্রুপদি সাহিত্য পড়তে হবে। আমি অবশ্য এমনটা মনে করি না। কারণ, লালন তো ধ্রুপদি সাহিত্য পড়েননি। তিনি বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ কিংবা শেক্সপিয়ার কিছুই পড়েননি। তাই বলে কি লালন কোনো সাহিত্যিক নন ? তবে হ্যাঁ, ধ্রুপদি সাহিত্য পড়া থাকলে সাহিত্যের বাঁক বদলটা জানা যায়।
আর একটা কথা। লেখালেখি কিন্তু গুরুমুখী বিদ্যা। কাউকে না কাউকে গুরু মেনেই তোমার লেখালেখির শুরুটা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রশিক্ষণ-ট্রশিক্ষণ কোনো কাজ দেয় বলে আমার মনে হয় না। মূল কথা হলো, জানার আগ্রহ নিয়ে লেখালেখির কারিগরি দিক বিশ্লেষণ করে অন্যের লেখা বেশি বেশি পড়তে হবে।
সেলিনা হোসেন
আমি মনে করি, তরুণ লেখকদের তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত— পর্যবেক্ষণ, পড়াশোনা ও পরিশ্রম। অর্থাৎ প্রথমত তোমার চারপাশের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শিখতে হবে, যেন তোমার লেখায় বিবরণটা অনুপুঙ্খ হয়। দ্বিতীয়ত তোমাকে প্রচুর পড়তে হবে।
কবি হতে চাইলে যে কেবল কবিতাই পড়তে হবে এমন নয়; বরং দর্শন, ইতিহাস, চিত্রকলা থেকে শুরু করে সব বিষয়ে জানতে হবে। জানার পরিধি সীমিত হলে লেখক হওয়া যায় না। সবশেষে শ্রম। তোমাকে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হবে, যদি তুমি সত্যিকার অর্থেই লেখক হতে চাও। একটি লেখার পাঠোদ্ধার করার জন্য তোমাকে দু-তিনবার লেখাটি পড়তে হতে পারে। একটি লেখার মানোন্নয়ের জন্য পাঁচবার, সাতবার অথবা দশবারও লেখাটি কাটতে হতে পারে। তাই নিজের মাঝে পরিশ্রম করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আর যেটা করতে হবে সেটা হলো ধ্রুপদি সাহিত্য পড়তে হবে। নিজের ঐতিহ্য না জেনে, নিজের শিকড় না জেনে নিজেকে নির্মাণ করা খুবই কঠিন। ইদানীং দেখছি, অনেক তরুণ লেখক ছাত্রাবস্থাতেই নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বই বের করছে। এটা অত্যন্ত খারাপ প্রবণতা। বই প্রকাশ করার আগে নিজেকে পাঠকমহলে পরিচিত করানো জরুরি। সে জন্য পত্রপত্রিকা ও ব্লগে লিখতে হবে প্রচুর পরিমাণে।
আর লেখক হওয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। আমি এটা বিশ্বাস করি না যে লেকচার দিয়ে কাউকে সাহিত্যিক বানানো সম্ভব। তবে প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে যে উপকারটা হয়, তা হলো পড়ার প্রতি আগ্রটা বাড়ে। লেখকদের মাঝে আন্তযোগাযোগ বাড়ে। ফলে নানান বিষয় নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা হয়। এই আলোচনাটা লেখালেখিতে বেশ কাজে দেয়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
লেখার প্রধান বাহন হচ্ছে ভাষা। শিল্পীর যেমন রং, ভাস্করের যেমন কাদা বা পাথর তেমনি লেখকের প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। তাই ভাষার ওপর দখল আনতে হবে সবার আগে। কোন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করব, তা একজন লেখককে জানতে হয় প্রথমে। সে জন্য পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। বহু বিচিত্র বিষয়ে পড়তে হবে। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস, দর্শন সবই পড়তে হবে। শচীন কত বড় মাপের খেলোয়াড়, তা জানার জন্য শচীনের খেলা দেখতে হয়। তেমনি পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছে কতশত সাহিত্যিক, তাঁরা কে কোন মাপের লেখক, তা জানার জন্য তাঁদের লেখাপড়া জরুরি।
তারপর নিজের ভাবনা প্রকাশের জন্য বেছে নিতে হয় উপযুক্ত ভাষাভঙ্গি। এ ক্ষেত্রে গভীরভাবে খেয়াল রাখতে হয়, নিজের লেখার ধরন যেন অন্য কারও মতো না হয়ে যায়। অর্থাৎ অনুকরণ করা যাবে না। নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে হবে।
আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠান তরুণ লেখকদের জন্য লেখালেখি বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। এসব আয়োজন সর্বাংশে উপকারী না হলেও একজন নবীন লেখকের প্রস্তুতি পর্বের জন্য একটুখানি সহায়ক তো বটেই। কীভাবে সহায়ক আমি বলি, এখানে অনেকগুলো তরুণ লেখক একত্রিত হয়। তারা পরস্পর ভাবের আদান-প্রদান করে। নানান বিষয় নিয়ে বিতর্ক করে। বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে। এতে চিন্তার শৃঙ্খলা তৈরি হয়। তারপর এ সুশৃঙ্খল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের লেখায়। তাই আমি মনে করি, ভালো প্রতিষ্ঠান এবং ভালো প্রশিক্ষক হলে প্রশিক্ষণ নেওয়া দোষের কিছু নয়।
তবে এই সময়ের তরুণ লেখকদের নিয়ে আমি খানিকটা হতাশ। আমি দেখছি, ফি বছর তারা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বই বের করছে। এটা আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা একটা অসুস্থ মোহের পেছনে ছুটছে, অলীক খ্যাতির পেছনে ছুটছে। এসব না করে তরুণ লেখকদের উচিত পত্রপত্রিকা ও ব্লগে লেখালেখি করে হাত পাকানো।
(সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ফিচার পাতা সপ্ন নিয়ে।)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।